করোনাকালে স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার যে ক্ষতি, সেটি জীবন রক্ষার তাগিদে আরও কিছুদিন মেনে নিতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
করোনাকালে দ্বিতীয় বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে সরকারপ্রধান শিক্ষা নিয়ে তুলে ধরলেন তার ভাবনা।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বারবার বাড়ানো হচ্ছে ছুটি। এক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর গত জুনে খোলার ঘোষণা দিয়েও চালু করা যায়নি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে। বরং সরকার মানুষের চলাচলের বিধিনিষেধ আরও বাড়িয়ে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
শনিবার বাজেটের সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শিক্ষাঙ্গন নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘আমি বলব, একটু ক্ষতি হচ্ছে। টিকা দিয়েই আমরা কিন্তু সব স্কুল খুলে দেব। একটা ছেলেমেয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে, এখন তো শিশুদেরও হচ্ছে। আমরা জেনেশুনে লেখাপড়া শিখব, কিন্তু এর জন্য মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব কি না, এটা বুঝে দেখবেন।’
স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও পড়াশোনা চালু আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা পড়াশোনা করবে, এটা আমরা চাই। আমি বলব, হ্যাঁ, স্কুল বন্ধ আছে। কিন্তু পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয়, সে জন্য টেলিভিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লাস প্রচার হচ্ছে। তা ছাড়া রেডিও আমরা উন্মুক্ত করে দিয়েছি। রেডিওর মধ্যে যাচ্ছে সুযোগ, অনলাইনে যাচ্ছে, যে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে ক্লাস চালিয়ে রাখতে আমরা চেষ্টা করছি।’
‘তাদের তো স্কুল-কলেজে যাওয়ার মতো সন্তান নেই’
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে যারা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তাদের স্কুল-কলেজে পড়ার মতো সন্তান নেই বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
বলেন, ‘স্কুল-কলেজ খোলার ব্যাপারে কথা উঠেছে। যাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে বা সন্তানরা স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যায়, সেই মা-বাবাই কিন্তু চান না তাদের বাচ্চাটাকে স্কুলে পাঠাতে। তবে এটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার যাদের বাচ্চারা স্কুলে যায় না, পড়ার মতো ছেলেমেয়ে যাদের নাই। যারা যায় তারা তো চাচ্ছেন না।’
জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রীসবাইকে টিকা দিয়েই শিক্ষাঙ্গন চালু করার পরিকল্পনার কথা আবার তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে শিক্ষকদের টিকা দিয়েছি। আমরা ছাত্রদেরও টিকা দিতে চাই। কিন্তু আপনি জানেন মাননীয় স্পিকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিজস্ব কয়েকটি নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। এখানে কোন টিকা কোন বয়স পর্যন্ত দেয়া যাবে, তার একটা পরামর্শ তারা দেয়, এটা আমাদের মানতে হয়।’
‘অনেকেই নিষেধ শোনেননি’
করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের বিধিনিষেধ না মেনে চলায় সংক্রমণ বেড়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে যে, জনগণকে গত ঈদুল ফিতরে বারবার অনুরোধ করলাম যে, আপনারা আপনাদের জায়গা ছেড়ে যাবেন না। কিন্তু অনেকেই তো সে কথা শোনেননি। সবাই তো ছুটে চলে গেলেন।
‘এর ফলাফলটা কী হলো? এবং যারা বাইরে ছিলেন তারাও, পুরো বর্ডার এলাকা, বিভিন্ন জেলায় করোনাটা ছড়িয়ে পড়ল। তখন যদি আমাদের কথাটা শুনতেন, তাহলে হয়তো এমনভাবে করোনা ছড়াত না, এটা হলো বাস্তবতা। তারপরেও মানুষ আসলে যেতে চায়, এটাই সমস্যা।’
পাশে থাকবে সরকার
করোনার বিধিনিষেধে বিপাকে পড়া মানুষের পাশে সরকার থাকবে বলে আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি মানুষের পাশে দাঁড়াতে। শুধু সরকার না, আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা মানুষকে করে যাচ্ছি। আমরা বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিয়েছি। আমরা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছি।
‘এমন কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই যাদের আর্থিক সহায়তা না দেয়া হয়েছে। এখন যেহেতু আবার করোনা বাড়ছে, আমরা সাধ্যমতো আবার সহযোগিতা দেব। কারো খাদ্য প্রাপ্তিতে যাতে অসুবিধা না হয়, সেটা আমরা দেখব।’
‘৮০ ভাগ মানুষ আসবে টিকার আওতায়’
দেশে টিকা নিয়ে আর কোনো সংকট হবে না বলে সংসদে আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ক্রমান্বয়ে ৮০ ভাগ মানুষেকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা হবে।
তিনি বলেন, ‘টিকা নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছিল, আমি আগেও বলেছি। আমাদের সংকট দেখা দিয়েছিল। আমরা যখনই টিকা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়, তখন সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। ভারত থেকে যখন পেলাম, তখন নগদ টাকা দিয়ে কিনেই ফেললাম।
‘ভারতে যে আকারে করোনা মহামারি দেখা দিল, তখন তারা টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিল। এ কারণে কিছুদিন আমাদের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে টিকা চলে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘ফাইজারের যে টিকা এসেছে, আমি বলেছি বিদেশে আমাদের শ্রমিক যারা যাচ্ছেন তাদের অগ্রাধিকার থাকবে এ টিকা পাওয়ার। ইতিমধ্যে মর্ডানা ও সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। মর্ডানা থেকে ২ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন চলে এসেছে। আর সিনোফার্মের ২ মিলিয়ন এসে গেছে।
‘সিনোফার্মেরগুলো কিন্তু আমরা ক্রয় করেছি। এর আগে চীন থেকে আমাদের কিছু উপহারও পাঠানো হয়েছে। ভারতও আমাদের কিছু উপহার দিয়েছে। এ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে যেখানে টিকা পাওয়া যাচ্ছে, আমরা কিন্তু যোগাযোগ করছি। আরও টিকা আমরা নিয়ে আসব কিনে।’
টিকার জন্য আলাদা বাজেট রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যত লাগে আমরা কিনব। এ জন্য আলাদা বাজেটে টাকাই রাখা হয়েছে। এর জন্য কোনো চিন্তা হবে না। আমরা চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া সব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যেখানেই পাওয়া যাচ্ছে আমরা নিয়ে নিচ্ছি।
‘আমাদের নিজেদের বিমান পাঠিয়ে চীন থেকে সিনোফার্মের টিকা নিয়ে এসেছি। এভাবেই আমরা টিকা সংগ্রহ করছি। আর আমেরিকা থেকে যেটা পাঠিয়েছে মর্ডানার, সেটাও দেশে এসেছে। একটা রাত ১১টায়, একটা ১টার পরে, আরেকটা ভোর ৫টার পরে।’
টিকার জন্য বাজেটে ৩২ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘আরও ১০ হাজার কোটি টাকা রাখা আছে রিজার্ভ, যদি প্রয়োজন হয় সে জন্য ব্যবস্থা রেখেছি।’
‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট’
চলতি অর্থবছরের বাজেটকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট বলেও অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘যে বাজেটটা দিয়েছি, এটাতে একদিকে যেমন করোনা মোকাবিলাকে আমরা সামনে রেখেছি। পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসা এবং স্বাস্থ্যসেবার বিষয়গুলোকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এ বাজেটে।’
অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই করোনার মধ্যেও তিনি ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছেন, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৫০। করোনার মধ্যেও যে আমরা আমাদের অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখতে পেরেছি, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।’