অর্থনীতির নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এক আলোচনায় পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের মধ্যে বাগযুদ্ধ হয়েছে।
মনসুর অভিযোগ করেন, মূল্যস্ফীতি রোধ ও টাকার মান ধরে রাখতে সরকার কার্যত কিছু করেনি। ফলে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। অন্যদিকে প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশে খুব দক্ষ। কিন্তু তাদের কোনো পূর্বানুমান সঠিক হয় না।
রোববার ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম বা ইআরএফ এই আলোচনার আয়োজন করে। দুইজনের বাহাসে গোটা আয়োজন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।আহসান এইচ মনসুর বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালকও।
অর্থনীতির কিছু বিষয় নিয়ে সমালোচনা করেন মনসুর আর তীর্যকভাবে জবাব দেন প্রতিমন্ত্রী।
মনসুর বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন অর্থনীতির প্রধান সমস্যা। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, এর ফলে আগামী মাসে এই হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যত কিছুই করেনি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণেও ব্যর্থ হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘মনিটারি পলিসি বা মুদ্রানীতি বলতে কিছু নেই। এটি স্রেফ বিবৃতিমূলক রচনাতে পরিণত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি প্রশমিত না করলে বিভিন্ন খাতে মজুরি বৃদ্ধি চাপ বাড়বে।
‘সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। চালের উৎপাদন ভালো নয়। চালের দাম আরও বাড়বে। সরকারকে আরও চাল আমদানি বাড়াতে হবে ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদ হার বাড়ানোর পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমও দীর্ঘ পেশাজীবনে পরিকল্পনা কমিশনে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ছিলেন। অর্থনীতি নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি কাজ করেছেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাতেও।
পরিকল্পনা কমিশনে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি ‘বাংলাদেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনা’ (২০১০-২০২১) ও ‘ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’ (২০১১-২০১৫) প্রণয়ন করেন। তিনি ‘বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্র’ ও ‘সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র’ নীতিমালা প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনবিষয়ক বেশ কিছু প্রতিবেদন, অধ্যয়ন ও গবষণা গ্রন্থ সরাসরি তত্ত্বাবধান ও সম্পাদনা করেন।
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশে দক্ষ। যে কারণে তাদের প্রক্ষেপণ বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। তারা একসময় আশঙ্কা করেছিলেন পদ্মা সেতু হবে না। পদ্মা সেতু সুন্দরভাবে হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা সঠিক হয়নি।’
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি বেশি থাকে। কারণ, এ সময় প্রধান অর্থকরী ফসল থাকে না। আশা করছি আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে।’
তার মতে অর্থনীতি সক্রিয় আছে। কোনো সংকটে নেই। কাজেই ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান, তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাবেক সভাপতি বর্তমানে গবেষণা সংস্থা বিল্ডের চেয়ারপারসন নিহাদ কবির ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিমভী।
বক্তব্যের শুরুতে ব্যবসায়ী নেতা আবুল কাশেম খান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির মূল সংকট এখন জ্বালানি। এর অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যে কারণে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে শিল্প খাত।’
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ খাতে ১০ থেকে ১৫ বছরের জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান করারও পরামর্শ দেন তিনি।
তৈরি পোশাক খাতের নেতা মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘ব্যবসা সহজের পরিবর্তে এখন আরও কঠিন হয়েছে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে আমাদের অর্ডার কমে গেছে।’
এ খাতের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা ধরে রাখতে উৎসে কর হার ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেন তিনি। জ্বালানি সংকট নিরসনে নতুন গ্যাস কূপ খননের পরামর্শ দেন মেট্রো চেম্বার এর সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির।
অর্থনীতি সঠিক পথে আছে বলে দাবি করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ আছে চ্যালেঞ্জ ছিল। তা মোকাবিলা করতে হবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আগামীতেও এটি অব্যাহত থাকবে। অতীতে অনেক সংকট মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি। রিয়েল সেক্টরে আমাদের অর্থনীতি গতিশীল আছে। আর্থিক খাতও তো ভালো চলছে। কাজেই, আমাদের অর্থনীতি সঠিক পথে পরিচালিত হচ্ছে।’