বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার পর অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই সূচকের ওপর চাপ কমাতে এক দিনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর একটি হচ্ছে- দেশের ব্যাংকগুলো এখন তাদের আমদানির খরচ মেটাতে অফশোর ব্যাংকিং কার্যক্রম থেকে ঋণ নিতে পারবে। প্রথমবারের মতো এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। আরেকটি হচ্ছে- আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হবে।
আর সবশেষটি হলো- রপ্তানিকারকের রিটেনশন বা প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবে জমা করা বিদেশি মুদ্রার ৫০ শতাংশ অনতিবিলম্বে নগদায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে এই কোটার হিসাবে নতুন করে জমা রাখার হার অর্ধেক করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আলদা এই তিনটি সার্কুলার জারি করা হয়।
অফশোর ব্যাংকিং বিষয়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে জারি করা সার্কুলারে বলা হয়েছে, বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী স্থানীয় ব্যাংকগুলো তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ করতে ছয় মাস মেয়াদের জন্য অফশোর ব্যাংকিংয়ের মোট মূলধনের ২৫ শতাংশ ঋণ নিতে পারবে। তবে এই অর্থ শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল এবং সরকারের আমদানি বিল পরিশোধে খরচ করতে হবে।
এই সিদ্ধান্ত চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে সার্কুলারে উল্লেখ করা হয়েছে।
অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের অভ্যন্তরে পৃথক ব্যাংকিং সেবা। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয় না। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল মুনাফায়।
এ ছাড়া রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আরও দুটি আলাদা সার্কুলার জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আমদানি ঋণপত্র বা এলসি খোলা সংক্রান্ত সার্কুলারে বলা হয়েছে, বিদেশি মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েব পোর্টালে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অপ্রয়োজনীয় আমদানি রোধ এবং আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না- সে বিষয়টি জানতে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সরকারি আমদানি ছাড়া অন্য যেকোনো আমদানি ৫ মিলিয়ন ডলারের বেশি হলেই এই রিপোর্ট করতে হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ইআরকিউ বিষয়ক আরেক সার্কুলারে রপ্তানিকারকের রিটেনশন বা প্রত্যাবাসন কোটা (ইআরকিউ) হিসাবে জমা করা বিদেশি মুদ্রার ৫০ শতাংশ দ্রুত নগদায়ন করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে এই কোটার হিসাবে নতুন করে জমা রাখার হার অর্ধেক করা হয়েছে।
প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয়ের নির্দিষ্ট অংশ ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখা যায়। স্থানীয় মূল্য সংযোজনের মাত্রা অনুযায়ী রিটেনশন কোটার হার ১৫ শতাংশ কিংবা ৬০ শতাংশ হতে পারে। তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই হার ৭০ শতাংশ।
বৃহস্পতিবারের সার্কুলারে রিটেনশন কোটা হিসাবে বিদেশি মুদ্রা জমার মাত্রা ৫০ শতাংশ কমিয়ে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ এবং ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তও চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বলবৎ থাকবে বলে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নামার পর বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়াতে এক দিনে এই তিন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেশ কিছুদিন ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’আনতে বিভিন্ন উদ্যোগের অংশ হিসেবে এ সব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। রপ্তানি আয় বাড়লেও তা ডলারের সংকট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়াচ্ছে, দুর্বল হচ্ছে টাকা। এর পরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজিভাব।
বাংলাদেশ ব্যাংক যে দামে ডলার বিক্রি করছে, বাজারে তার চেয়ে ৩-৪ টাকা বেশি দরে কেনাবেচা হচ্ছে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
বুধবারও টাকার মান আরেক দফা কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে আরও ৫০ পয়সা দর হারিয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রা।
আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বুধবার এক ডলারের জন্য ৯৩ টাকা ৯৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছে; মঙ্গলবার লেগেছিল ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা।
গত এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে ১০ দশমিক ৮০ শতাংশ।
মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া ও চাহিদা বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দেয়। আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক নানা পদক্ষেপ নেয়ার পরও ডলারের বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও দামে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। বাজার ‘স্থিতিশীল’রাখতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১৩ দিনে (১ থেকে ১৩ জুলাই) ৫৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
অথচ করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তারই ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর।
সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আমদানি ব্যয়ের লাগাম টানতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমদানি ব্যয় কমাতে গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, স্বর্ণসহ ২৭ পণ্যে শতভাগ এলসি মার্জিন নির্ধারণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ, রপ্তানি বিল পাওয়ার এক দিনের মধ্যে নগদায়ন, বিদেশ ভ্রমণে কড়াকড়িসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।