প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ৫ টাকা বাড়ানোর খবরে মাঠপর্যায়ে কাঁচা চামড়ার সংগ্রহকারী বিক্রেতারা গতবারের চেয়ে বেশি মূল্যে চামড়া কিনে আড়তে নেয়ার পর লোকসান দিয়েছেন।
রাজধানীর সায়েন্সল্যাবের অস্থায়ী হাটে দিনভর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৯০০ টাকায়। কিন্তু একই চামড়া পোস্তার আড়তগুলোতে বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৬৫০ টাকায়।
আর ছাগলের চামড়া অনেক আড়ত কিনতেই চায়নি। যারা কিনেছেন তার মূল্য দেয়া হয়েছে আকৃতিভেদে ২০-৩০ টাকার মধ্যে। অভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে আমিনবাজার ও হেমায়েতপুরের আড়তগুলোতেও।
এই দুই জায়গায় বিক্রি হওয়া গরুর বেশিরভাগ কাঁচা চামড়ার দর মিলেছে ৪০০-৬০০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০-২৫ টাকার মধ্যে।
গত বছর কোরবানির ঈদের পর চামড়ার দাম পড়ে যাওয়া নিয়ে দেশে হুলস্থুল হয়েছে। কোথাও কোথাও চামড়া বিক্রি না করে রাগ করে সেগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলতেও দেখা গেছে। নদীতেও ফেলা হয়েছে শত শত চামড়া।
এবার সরকার গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম বর্গফুট প্রতি ৫ টাকা করে বাড়িয়ে ঢাকায় ৪০ থেকে ৪৫ টাকা আর ঢাকার বাইরে ৩৩ থেকে ৩৭ টাকা করেছে। আর ছাগলের চামড়ার দাম ঠিক করা হয় বর্গফুটপ্রতি ১২ থেকে ১৭ টাকা।
সাধারণত গরুর চামড়া সর্বনিম্ন ২২ থেকে সর্বোচ্চ ২৬ বর্গফুট পর্যন্ত হয়। তবে গরু থেকে চামড়া পাওয়ার গড় হার হচ্ছে ২৪ বর্গফুট। আর ছাগল-খাসির চামড়ার গড় হার হচ্ছে সাড়ে ৪ বর্গফুট।
এই হিসেবে ঢাকায় গরুর চামড়া একেকটি ৯৬০ থেকে ১০৪০ টাকা পড়তে পারত। তবে এখানে লবণের খরচ আছে আর একেকটি গরুতে আট থেকে ১০ কেজি লবণ লাগে। একেক কেজির দাম ১১ থেকে ১২ টাকা হলে এ ক্ষেত্রে খরচ ১১০ থেকে ১২০ টাকার মতো। ছাড়লের চামড়ায় লবণ লাগে ৫০ থেকে ৬০ টাকার মতো। এই হিসাব করেই আড়তদাররা চামড়া কেনার কথা জানিয়েছেন।
আর এই লবণের হিসাব না করেই লোকসানে পড়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
ঈদের দিন বুধবার বিকেল গড়ানোর আগে থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে সংগ্রহ করা চামড়া বিক্রি করতে আনা হয় রাজধানীর লালবাগের পোস্তা, আমিনবাজার ও সাভারের হেমায়েতপুরের আড়তগুলোয়। কিন্তু কোনো আড়তেই মিলেনি বিক্রেতাদের প্রত্যাশিত দাম।
সরকার কোরবানির পশুর রক্তজাত বা কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ না করে দেয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
অন্যদিকে আড়তদাররা জানিয়েছেন, গুণগতমান না থাকলে চামড়া আরও কম দামে কিনেও লাভ হবে না।
একজন বলেন, ‘আমরা চামড়া বুঝে মূল্য দেই। তাছাড়া সরকার লবণযুক্ত চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করেছে, তার থেকে তাদের প্রক্রিয়াজাত খরচ হাতে রেখে কাঁচা চামড়া কিনতে হয়েছে। এই ক্ষেত্রে যে যে দামে পেরেছে সেই দামেই কিনেছেন।’
দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার এই বাকযুদ্ধে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কাঁচা চামড়ার বড় সংগ্রাহক মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষার্থীরা।
পোস্তায় কেউ একবার আড়ত এলাকায় ঢুকলে এবং সেখানে দর না মিললে ফের চামড়া নিয়ে বের হওয়ার সুযোগ কারও নেই। কারণ, এলাকায় প্রবেশ পথের সবকটি রাস্তাই এতোটাই সরু যে স্বাভাবিক সময়েও সেখানে হাটাচলায় ধীরগতি থাকে।
ঈদের দিনেও প্রবেশ পথগুলোয় ছিল নিয়মিত চলাচল করা গণপরিবহণ, ব্যক্তিগত যানবাহন ও রিকশা। এর সঙ্গে চামড়াবাহী অসংখ্য ট্রাক, মিনি ট্রাক ও ভ্যান পোস্তামুখী হওয়ায় হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হয়। আবার শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বা আড়তদারদের মনোনীত প্রতিনিধিদেরও তেমন জোরদার উদ্যোগ ছিল না।
শান্তিনগর উম্মে হাবীবা হাফেজিয়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ১২০ পিস চামড়া নিয়ে আসে পোস্তা এলাকায়। মাদ্রাসার মুহতামিম আব্দুল আজিজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৭৪টিই ছিল বড় গরুর চামড়া। শুনেছি বড় গরুর চামড়া কোথাও কোথাও ৭০০-৮০০ টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। কিন্তু পোস্তায় চামড়া এনে আমাদের বিক্রি করতে হয়েছে গড়ে ৬০০ টাকায়। মাঝারি আকৃতির বাকি ৪৬ পিস চামড়া গড়ে বিক্রি করতে হয়েছে ৪৫০ টাকায়।’
চামড়ার আড়তদার মোতালেব ট্রেডার্সের মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, ‘আমরা ৫০০-৬০০ টাকার মধ্যে চামড়া কিনছি। এর বেশি দিলে পড়তা পড়ে না। কারণ, কেনার পড়ে আরও অনেক খরচ আছে।’
রিয়াজউদ্দিনের আড়তে ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। আর গরুর চামড়ায় মান বুঝে তিনি দাম দেন বলে জানান।
জামিল মিয়ার আড়তে গরুর চামড়া কেনা হয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়।
চামড়ার সার্বিক মূল্য পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) মহাসচিব টিপু সুলতান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে এবার দেশের চামড়া ক্রয় পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে ভালো। এবার চামড়া নিয়ে কোনো অসন্তোষ হয়নি। তুলনামুলক দামও পেয়েছে বেশি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, গরুর একেকটি চামড়া কেনার পর তাতে সব মিলে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ পড়ে। এই দাম বাদ দিয়ে লবণযুক্ত চামড়ার সঙ্গে দাম সমন্বয় করে যার যে দামে পড়তা পড়ে সে সেই দামেই চামড়া কিনেছে।