বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে প্রায় ২৮ বছর ধরে কাজ করছেন তৌফিক রহমান। তিনি জার্নি প্লাস নামে একটি ট্যুর অপারেটর কোম্পানির স্বত্বাধিকারী।
করোনা সংক্রমণের কারণে গত বছর মার্চ থেকে পর্যটন খাতে অচলাবস্থা শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটক আনাগোনা। এ অবস্থার মধ্যেও আগস্ট পর্যন্ত নিজের অফিসটি চালিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে গুটিয়ে নিতে হয় অফিস।
তৌফিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি গত বছরের আগস্ট পর্যন্ত অফিস চালিয়েছি। তারপর দেখলাম, মাসে অফিস ভাড়াই যাচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। স্টাফ বেতন মিলিয়ে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ।
‘যেহেতু আমার এক পয়সা আয় নেই, আমি অফিস গুটিয়ে নিয়েছি। মানে আমার বাসায় অফিস নিয়ে এসেছি। একভাবে বলা যায়, আমি বেকার হয়ে গেলাম। পরে আমি অন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। আমার অফিসের যারা স্টাফ ছিল, তাদের অনেককেই ছেড়ে দিতে হয়েছে। কয়েকজনকে আমার অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়েছি।’
তৌফিক বলেন, ‘আমরা যারা পর্যটনের সাথে জড়িত, তাদের মোটামুটি ৪০ থেকে ৫০ ভাগই মূল অফিস বন্ধ করে দিয়েছে। ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কর্মীকে অন্য পেশায় চলে যেতে হয়েছে।
‘৫০ থেকে ৬০ ভাগ যারা এ ব্যবসাকে উপজীব্য করেই বেঁচে ছিলেন, তারা অন্য ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছেন। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, যারা এখান থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন তাদের অনেকেই হয়তো আর এ পেশায় ফিরবেন না।’
দেশি ট্যুর অপারেটরদের শীর্ঘ সংগঠন ট্যুর অপারেটস অ্যাসোসিয়েশন (টোয়াব) বলছে, দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন খাতের মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ৪০ লাখ মানুষের। করোনার কারণে গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা অচলাবাস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত তাদের প্রায় সবাই।
দেশে সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় পর্যটন মৌসুম। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও টোয়াবের হিসেবে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর দেশে গড়ে বিদেশি পর্যটক আসে ৫ লাখের মতো। এর বাইরেও বছর জুড়ে দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে আনাগোনা থাকে ৬০ থেকে ৭০ লাখ অভ্যন্তরীণ পর্যটকের। গত বছর করোনার মধ্যেও ৫ হাজার সাতশ কোটি টাকা আয় করেছে পর্যটন খাত।
এ বছরের এপ্রিল থেকে শুরু করে করোনার দ্বিতীয় সংক্রমণ অব্যাহত থাকলে এ বছর ২০ হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছে টোয়াব। সংগঠনের সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কফিনে তো পেরেক ঠোকা হয়েছে বহু আগেই। পর্যটন খাত তো সবার আগেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আবার ক্ষতি কাটবেও সবাই করার অন্তত এক বছর পর।
‘ইতিমধ্যে তো ১৭-১৮ মাস হয়ে গেল, ট্যুর অপারেটরদের মধ্যে কোনো প্রাণের সঞ্চার নেই। অফিস বন্ধ কিন্তু খরচের খাতা তো থেমে নেই। আমাদের অবস্থা অত্যন্ত জটিল।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, এবারও অভ্যন্তরীণ পর্যটনের কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হবে। এটা শুরু হয় সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ বা অক্টোবরের শুরুর সপ্তাহে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সাধারণত মৌসুমটা চলে। সেই সময়ে দেশি পর্যটকরা ভ্রমণ করে কিন্তু মনে হয় এ বছর এ সুযোগটাও আমরা পাবো না।
‘আর ইনবাউন্ড আউট বাউন্ড তো পুরোপুরিই বন্ধ। সারা বিশ্ব স্বাভাবিক না হলে এটা হবে না। এক দুই বছরেও হবে কিনা সন্দেহ। আমাদের পরিস্থিতি এখন এমন মনে হচ্ছে আমরা সিজনটা পাবো না। এটা না পেলে শিল্প সংশ্লিষ্ট যেমন লজিং ইন্ডাষ্ট্রি, ট্রান্সপোরটেশন, ক্যাটারিং, লোকাল ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইড সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং টিকে থাকাই তাদের জন্য কষ্ট হয়ে যাবে।’
এ পরিস্থিতিতে এ খাতকে খাদের কিনার থেকে তুলে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৩ জুলাই যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন, তাতে এ খাতের অনুকূলে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা। এর আওতায় পর্যটন খাতের হোটেল, মোটেল, থিম পার্কের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে ৪ শতাংশ সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সহায়তা দেয়া হবে।
টোয়াব সভাপতি বলেন, ‘ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে প্রধানমন্ত্রীয় যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন, এটি ভালো একটি উদ্যোগ। যদিও এটি এখনও আমরা হাতে পাইনি। তবে এটি পেলে আমরা অন্তত আমাদের অফিস খরচ ও কর্মচারিদের বেতনগুলো দিতে পারব।’
ট্রাভেল এজেন্সিগুলো অবস্থাও করুণ। দেশি ট্রাভেল এজেন্টদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস (আটাব) বলছে, ৯০ ভাগ ট্রাভেল এজেন্সির অবস্থাই খারাপ।
সংগঠনটির সভাপতি মনসুর আহমেদ কালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১০ ভাগের অবস্থা মোটামুটি। ৯০ ভাগের অবস্থা ছিন্নবিচ্ছিন্ন, ভেরি ব্যাড শেপ। তারা অফিসও খোলে না, লোকবলও নেই, মানে অফিস চালাতে পারছে না।
‘আমাদের নিবন্ধিত সদস্য ছিলো সাড়ে ৩ হাজার। এখন এই মুহূর্তে ২ হাজার আছে কিনা সন্দেহ। এরা মূলত টিকতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়েছে। আমাদের সদস্যপদ নবায়নের জন্য একটি রিনিউয়াল ফিস আছে। খুব সামান্য, বছরে আড়াই হাজার টাকা। এটা দেয়ার ক্ষমতাও অনেকের নাই। তাহলে অবস্থাটা নিশ্চই অনুমান করতে পারেন।’
এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে দূরবর্তী গন্তব্যের পর্যটক পাওয়া যাবে না। তাই এ খাত টিকিয়ে রাখতে লক্ষ্য স্থির করতে হবে আঞ্চলিক পর্যটনকে এগিয়ে নিতে।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) সেক্রেটারি জেনারেল তৌফিক রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে দূরবর্তী পর্যটন কম হবে। হলেও খুব কম হবে। এর ফলে স্বল্প দূরত্বের বা আঞ্চলিক পর্যটনগুলো হবে।
‘আঞ্চলিক পর্যটনের জন্য সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, কম্বোডিয়া ও নেপালকে লক্ষ্য করা যেতে পারে। এখান থেকেই যদি আমরা প্রচারণা চালাতে পারতাম, তাহলে ইনবাউন্ড ট্যুরিস্টের যে ঘাটতি, সেটা মোটানো যেত।
‘একটা মানুষ যখন কোথাও যায়, দু বছর আগে পরিকল্পনা করে। আমরা যদি এখন থেকেই প্রচারণা চালাতে পারি, তাহলে তাহলে ২০২৩ নাগাদ কিছু পর্যটক পেতে পারি। এর জন্য সরকার ও ট্যুরিজম বোর্ডকে উদ্যোগী হতে হবে।’
পর্যটন খাতের স্থবিরতা কাটাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়েও পরিকল্পনা চলছে বলে জানান বিটিবি প্রধান নির্বাহী। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশ এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আমরাও এখন এ পদ্ধতি ব্যবহার করে লিমিটেড আকারে করার কথা চিন্তা করছি।
‘যেমন কেউ কক্সবাজার যাবে, তার জন্য একটি নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু করা হবে। যেতে হলে আগে থেকেই নিবন্ধিত হতে হবে। এভাবেই আমরা ভাবছি। ব্যাপক হারে যেতে না দিয়ে আমরা যদি সীমিত আকারে মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে জীবন ও জীবিকা বাঁচবার সম্ভাবনা আছে এবং অনেক দেশই এমনটা করছে।’