করোনায় ক্ষতি হওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক করতে ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কাজ করছে সরকার। এর মধ্যে শিল্প ও ব্যবসা সংশ্লিষ্ট সাতটি প্রণোদনা প্যাকেজ রয়েছে, যা বাস্তবায়নে সরকারকে ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে খরচ করতে হচ্ছে ৮৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে এই প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর ৮৩ ভাগ বাস্তবায়িত হয়েছে।
মূলত এসব প্রণোদনা প্যাকেজে ভর করেই দেশ সামলে ওঠে করোনার প্রথম ধাক্কা। এতে বন্ধ শিল্পের চাকা যেমন আবার ঘুরতে শুরু করে, পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক সেবা, উৎপাদন, সরবরাহ এবং বিপণনসহ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতি ফিরে আসে। সর্বোপরি জীবন-জীবিকাও স্বাভাবিক হয়।
কিন্তু প্রণোদনা পেয়ে বছরজুড়ে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীর ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে প্রাণ ফিরলেও সরকারকে দীর্ঘমেয়াদে এর মাশুল গুনতে হচ্ছে।
আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের সম্ভাব্য বাজেটকে সামনে রেখে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে সরকারের সম্ভাব্য অতিরিক্ত ব্যয়ের একটি আভাস দিয়েছে।
কাউন্সিল জানিয়েছে, করোনা মোকাবিলায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তার অনুকূলে ৮৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে বিতরণের কারণে এর ওপর ধার্যকৃত সুদের অর্ধেক দায় সরকারই বহন করছে। এ জন্য চলতি অর্থবছরসহ আগামী তিন অর্থবছর জুড়ে সরকার স্বাভাবিক ব্যয়ের অতিরিক্ত মোট ১২ হাজার কোটি টাকার সুদ পরিশোধের চাপ বয়ে বেড়াবে।
সরকারের অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক পরবর্তী তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা ভাইরাসের স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় সরকার চারটি নীতি কৌশল গ্রহণ করেছে। এর প্রথমটি হলো সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি; দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ক্ষতি পুনরুদ্ধারে প্রণোদনা প্রদান; তৃতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং চতুর্থত, মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
পরিকল্পনার আওতায় চার নীতি কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সরকার ইতোমধ্যে ১৫ দশমিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ২৩টি আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, স্থানীয় টাকায় যার পরিমাণ মোট ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এই অর্থ চলতি বাজেটে টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, সরকার এই ১ লাখ ২৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকার অতিরিক্ত খরচ দুইভাবে বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে ১৬টি প্যাকেজের আওতায় ৪০ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা সরাসরি বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
অপর সাতটি প্রণোদনা প্যাকেজে ৮৭ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা অর্থায়ন পেতে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থার দ্বারস্থ হয়েছেম যা সরকার আগামী তিন অর্থবছর জুড়ে পরিশোধ করবে। আর এ পরিমাণ অর্থায়ন নিশ্চিত করতে এই তিন বছরে সরকারকে ১২ হাজার কোটি টাকার সুদ ভর্তুকি পরিশোধ করতে হবে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও জনকল্যাণে সরকারকে আগের যে কোনো বছরের তুলনায় করোনার এই সময়ে অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে। এতে একদিকে সরকারের খরচের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে খরচের প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান পেতে বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নের আকারও বড় করতে হচ্ছে।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর এই ঘাটতি ৬ শতাংশের মধ্যে থাকলেও আগামী ২০২১-২২ অর্থবছর ঘাটতির আকার আরও বড় হবে। আর এই ঘাটতি অর্থায়নের সংস্থান করতে সরকারকে অতিরিক্ত সুদ পরিশোধের চাপ বহন করতে হচ্ছে।
অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের প্রতিবেদনে আশার কথাও বলা হয়। উল্লেখ করা হয়, এসব কর্মকাণ্ডের ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিল্প ও সেবাখাতের চাঙ্গাভাব সৃষ্টিতে সহায়ক হচ্ছে। এতে আগামী অর্থবছরগুলোতে বাড়বে জিডিপির প্রবৃদ্ধি। এছাড়া আমদানিও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। দাবি করা হয়, শিল্পখাত বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ও সেবা খাতের চাঙ্গাভাব বজায় রাখতে পারলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বৃদ্ধি পাবে, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবে।
উল্লেখ্য, করোনায় ক্ষতি হওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি মোকাবিলা এবং জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক করে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সরকারকে নিতে হয়েছে মহাপরিকল্পনা। এ পরিকল্পনার আওতায় গত বছর ২৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার পাঁচটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। পরে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতা ও অর্থায়নের আকার পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হয়।