লকডাউনের শুরু থেকে পুঁজিবাজারে উত্থানের কারণে যে শেয়ার কেনার ধুম তৈরি হয়েছে, তার প্রভাবে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেনের রেকর্ড রক্ষা পেল একটুর জন্য।
ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হয়ে শেয়ার কেনা বাড়িয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার লেনদেন হলো দুই হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। এর আগে চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি লেনদেন হয় দুই হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৬ কোটি টাকার কারণে এক দশকে রেকর্ডের লেনদেন হলো না।
ওই মাসের ১৪ জানুয়ারি মার্জিন ঋণের সুদহার ১২ শতাংশ বেঁধে দেয়ার পর থেকেই মূলত পুঁজিবাজার দীর্ঘ সংশোধনে যায়, যা চলে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত।
১৪ জানুয়ারি পাঁচ হাজার ৯০৯ পয়েন্ট থেকে সূচক কমে ৪ এপ্রিল হয় পাঁচ হাজার ৮৮ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে লেনদেন কমে তিনশ কোটি টাকার নিচে নামে।
তবে লকডাউন আতঙ্ক কাটিয়ে ৫ এপ্রিল থেকে পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব দেখা দেয়। আর এটি টানা প্রায় দুই মাস ধরে চলমান থাকায় হাত গুটিয়ে থাকা বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হতে শুরু করেন।
প্রথমে বিমা খাতের, পরে মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এরপর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সব শেষে বস্ত্র খাতে ব্যাপক উত্থানের কারণে বিনিযোগকারীদের লোকসানি বিও হিসাবগুলোর অনেকগুলো লাভে চলে আসে। মার্জিন ঋণের সুবিধা বাড়ানোর কারণে আরও বেশি বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়।
সেই সঙ্গে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসিও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। আর এর প্রভাবে ঈদের আগ থেকে শেয়ার কেনা বাড়িয়ে দেন বিনিয়োগকারীরা।
ঈদের পর আরও বেশি সক্রিয় হতে শুরু করেন ব্যক্তিশ্রেণির পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। ২০১০ সালের মহাধসের পর ঈদ শেষে এত বেশি শেয়ার কেনার ইতিহাস দেখা যায়নি।
এর পর্যায়ে গত ১৯ মে লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়। এরপর আবার কয়েকদিন দর সংশোধন হতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি কমিয়ে দেন। ফলে কমতে থাকে লেনেদেন। চার কার্যদিবস পর ২৫ মে আবার দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়ায় লেনদেন।
পরদিন বৌদ্ধ পূর্ণিমার ছুটি শেষে বৃহস্পতিবার লেনদেন শুরুর সোয়া এক ঘণ্টার মধ্যেই এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হওয়ার সময়ই বোঝা যাচ্ছিল লেনদেন নতুন উচ্চতায় যেতে পারে। তবে দিন শেষে রয়ে গেল ৩০ কোটি টাকার আক্ষেপ।
অবশ্য ২০২০ সালের ২৮ জুন একবার দুই হাজার ৫৪৩ কোটি টাকার শেয়ার হাতবদলের ইতিহাস আছে, যদিও সেটি একটি বিশেষ কারণে।
তবে ওইদিন জেএসকে বিডি লিমিটেডের শেয়ার ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ারের কাছে হাতবদলই ছিল এর বড় কারণ। এটা বাদ দিলে সেদিন সাধারণ লেনদেন এত ছিল না। ফলে তা নিয়ে আলোচনাও হয়নি।
তিন বছর আগে ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি দুই হাজার ৬৪ কোটি টাকার লেনদেন হয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে।
তার আগে সবশেষ এ পরিমাণ লেনদেন হয়েছিল ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর। মূলত তারপর থেকেই দীর্ঘস্থায়ী মন্দার কবলে পড়ে পুঁজিবাজার।
‘বেড়েছে’ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ
গত জানুয়ারি থেকে পুঁজিবাজারে লেনদেন যখন লেনদেন কমছিল, তখন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ খুঁজতে মার্চের শেষে বৈঠকে বসে বিএসইসি। মার্চেন্ট ব্যাংক অ্যাসোসিয়েশন এবং ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশন, ডিবিএ সেই বৈঠকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়ানোর বেশ কিছু বাধা দূর করার প্রস্তাব করে।
ডিবিএ সভাপতি শরিফ আনোয়ার হোসেন সে সময় বলে, তারা বলেন, ব্রোকারহাউজগুলো তাদের ডিলার অ্যাকাউন্টে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী আগে গ্রাহকের অর্ডার বাস্তবায়ন করতে হয়। পরে ডিলার একাউন্ট থেকে ক্রয় আদেশ দিতে হয়। ১৯৮৭ সালে প্রণীত এই আইনের কারণে ডিলারদের বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে।
বিএসইসি কমিশনার শামসুদ্দিন আহমেদ সে সময় বলেন, আইনের এই শর্তটি লংঘন করার কারণে এখনও কারও বিরুদ্ধে নন-কমপ্লায়েন্স অভিযোগ আনা হয়নি, এবারও বিষয়টিকে নন-কমপ্লায়েন্স হিসেবে গণ্য করা হবে না।
সেই বৈঠকের পর বিএসইসি মার্জিন ঋণ নেয়ার সুযোগ আরও বাড়ায়।
৪ এপ্রিল বিএসইসি জানায়, পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৭ হাজার পয়েন্ট পর্যন্ত ১:০.৮ অনুপাতে ঋণ পাবেন বিনিয়োগকারীরা। অর্থাৎ বিনিয়োগ ১০০ টাকা হলে তাকে শেয়ার কেনার জন্য ৮০ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারবে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজ বা মার্চেন্ট ব্যাংক।
এরপর থেকে লেনদেন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আবার এপ্রিল থেকে বিমার শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করেছেন তারা বিপুল মুনাফা করেছেন। ব্যাংক, বস্ত্র ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডও বেশ মুনাফা দিয়েছে। এ কারণে বিও হিসাবগুলো আরও বেশি মার্জিন ঋণ পাওয়ার সুবিধা পেয়েছে।
পাশাপাশি ব্যাংক, বিমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ বাড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছায়দুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অবস্থা কখন কী, তা যাচাই করা কঠিন। তবে দুই হাজার কোটি টাকা লেনদেন প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘গত কয়েকমাস ধরে একটি সেক্টরের শেয়ারের দর ক্রমাগত বেড়েছে। এখন সে সেক্টরের শেয়ার দর কমে ব্যাংকের শেয়ারের দর বাড়ছে, নন ব্যাংক খাতের শেয়ারের দর বাড়ছে, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, বস্ত্র, প্রকৌশল খাতের শেয়ারের দর বাড়ছে। ফলে বলা যায়, বিনিয়োগকারীরা এখন পুঁজিবাজার থেকে মুনাফা উত্তোলন করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছে।’
সুদহার কমও একটি কারণ বলে মনে করেন ছায়দুর। বলেন, ‘ব্যাংকে এখন টাকা রাখলে সুদের হার কম, সঞ্চয় পত্রের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধি নিষেধ দিয়ে সে জায়গটিকে ছোট করা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগের জন্য ভালো জায়গা হচ্ছে পুঁজিবাজার।’
সেই সঙ্গে অপ্রদর্শিত আয় এখানে বিনিয়োগের সুযোগ আছে। আগামী বাজেটে কী হবে তা স্পষ্ট না হওয়ায় এখন অনেকেই এসব টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে বলেও মনে করেন তিনি।
পুঁজিবাজারের এমন উত্থানে ঝুকি আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পুজিবাজার বিনিয়োগ মানেই ঝুঁকি। এখানে শেয়ারের দর যেমন বাড়তে পারে তেমনি কমতেও পারে। তবে বিনিয়োগের আগে কোম্পানি সম্পর্কে জেনে বিনিয়োগ করা উচিত, তাহলেও ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা যাবে।’