পর পর কয়েকটি প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে যাওয়ার পর নতুন করে আর আইপিও অনুমোদন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।
যদিও সংস্থাটি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিগগিরই আইপিও অনুমোদন দেয়ার মতো কোম্পানির হাতে নেই কমিশনের। একটি কোম্পানি থাকলেও তারা তাদের আর্থিক বিবরণী তৈরিতে আরও সময় চেয়েছে।
ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে ই জেনারেশন, মীর আকতার হোসাইন লিমিটেড, এনার্জিপ্যাক, রবি।
এর বাইরে দেশ জেনারেলের ইন্স্যুরেন্সের ১৬ কোটি ও এনআরবিসি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১২০ কোটি টাকা সংগ্রহে আইপিও আবেদন প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে।।
বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে তালিকাভুক্ত হতে কাট অফ প্রাইস নির্ধারণে নিলাম চলছে বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ারের। একই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাজার থেকে ৫০ কোটি টাকা তুলতে চাইছে ইনডেক্স অ্যাগ্রো লিমিটেড।
দুই মসের মধ্যে এতগুলো আইপিও আসায়ে দুই কারণে পুঁজিবাজারের লেনদেনে টান পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আইপিও অনুমোদন দেয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-বিএসইসি
প্রতিটি আইপিওর ক্ষেত্রে শেয়ারের জন্য ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি আবেদন জমা পড়েছে। লটারির পর বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া হয় ৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে। ফলে বিপুল পরিমাণ টাকা এখনও ফেরত আসেনি বিনিয়োগকারীদের হিসাবে।
এর বাইরে রবি, এনার্জি প্যাক, মীর আকতারে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগ করে বিপুল পরিমাণে লোকসানে আছেন বিনিয়োগকারীরা। এই অংকটা এখন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
- আরও পড়ুন: তিন নতুন শেয়ারেই হাওয়া ১৪০০ কোটি টাকা
বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইপিও এখন একটু ধীর হবে। কারণ আমাদের হাতে দেয়ার মতো এখন কোনো আইপিও নেই। যেগুলো আছে সেগুলো প্রসেস করতে কিছুটা সময় প্রয়োজন হবে।’
তিনি বলেন, ‘কমিশনের কাছে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ফাইল ছিল। তারাও তাদের আর্থিক বিবরণী তৈরিতে সময় চেয়েছে। ফলে আগামীতে আইপিও কিছুটা কমে আসবে।’
গত এক মাস ধরে পুঁজিবাজারে লেনদেনের খরা ও টানা দরপতনের জন্য নানা কারণ রয়েছে। একটি একের পর এক আইপিও অনুমোদনও এর একটি কারণ বলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে।
পুঁজিবাজারের মন্দার কারণে এমন সিদ্ধান্ত কি না প্রশ্নে বিএসইসির মুখপাত্র বলেন, ‘আইপিও পুঁজিবাজারের অংশ। ফলে পুঁজিবাজার মন্দা না ভালো সেটা বিষয় না।’
কত সময় পর আবার আইপিও আসবে সে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক বলা যাচ্ছে না। একটি প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করবে।’
এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আইপিও পুঁজিবাজারের জন্য খারাপ কিছু নয়। তবে ভালো পুঁজিবাজারে আইপিও আসলে সেটা বাজারকে স্থিতিশীল করে। কিন্তু পুঁজিবাজার যদি খারাপ থাকে তাহলে আইপিও গতি কমানো ভালো।’
পুঁজিবাজারে মন্দাবস্থায় আইপিও আপাতত অনুমোদন না দেয়ার সিদ্ধান্তকে সমর্থক করছেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারে থেকে যে মুনাফা উত্তলন করা হয় তা আবার বিনিয়োগের জায়গা তৈরি করে রাখতে হবে। এখন বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের একটি অংশ সংরক্ষণ করেন আইপিও আবেদনের জন্য। বাজার ভালো না হওয়ায় আইপিও প্রতি আগ্রহ বেশি তাদের। কারণ, এখানে দেখা যাচ্ছে লেনদেন শুরু হওয়ার দুই কার্যদিবসের মধ্যে শেয়ারের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।’
বিএসইসি কমিশনার শামসুদ্দিন আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, `আসলে আইপিও অনুমোদনের জন্য কিছু প্রক্রিয়া থাকে। সে প্রক্রিয়াগুলো পর পুঁজিবাজারে আইপিও অনুমোদন দেয়া হয়। আমাদের হাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার মতো এখন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে শিগগিরই কোনো কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের সম্ভাবনা নেই।‘
পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন আইপিও নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে বিনিয়োগকারীদের চাওয়া আর আমাদের পরিস্থিতি এক হয়ে গেছে। আইপিও প্রক্রিয়া শেষ হয়ে আসলে আমরা অবশ্যই সেটির অনুমোদনের জন্য বিবেচনা করব।’
নতুন শেয়ারের সার্কিট ব্রেকার নিয়ে বিভ্রান্তি
নতুন শেয়ার লেনদেনের দিন কোনো সার্কিট ব্রেকার থাকত না। তবে গত কয়েক মাসে প্রথম দুই দিন ৫০ শতাংশ দাম বাড়া যাবে বলে সার্কিট ব্রেকার বসানো হয়।
এই নিয়মে গত পাঁচটি কোম্পানির চারটির ক্ষেত্রে দেখা গেছে পর পর দুই দিন ৫০ শতাংশ করেই দাম বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে কোম্পানির স্বাস্থ্য বিবেচনা করা হয়নি।
একমাত্র কোম্পানি যেটি দ্বিতীয় দিন ৫০ শতাংশ দাম বাড়েনি, সেটা হচ্ছে মীর আকতার। তবে এর কারণ, ৫০ টাকা প্রিমিয়াম।
কোম্পানিটি শেয়ার প্রতি ৬০ টাকায় ও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৬৫ টাকা করে পেয়েছেন।
বহু বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারণা আছে, কোনো শেয়ার প্রথম দুই কার্যদিবস ৫০ শতাংশ বাড়বে। আর এই সর্বোচ্চ দামে শেয়ার কিনে বিপুল পরিমাণ লোকসানে আছেন বিনিয়োগকারীরা।
টানা বেড়ে ১০ টাকার রবি ৭৭ টাকা, ৩১ টাকার এনার্জিপ্যাক ১০১ টাকা, ১০ টাকার তাওফিকা অ্যাগ্রো (লাভেলো আইসক্রিম) ২৭ টাকা, ৫৪ টাকার মীর আকতার ১১৭ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সবগুলোতেই এখন বিপুল লোকসানে বিনিয়োগকারীরা।
চলতি বছর এখন পর্যন্ত তাওফিকা ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রো পুঁজিবাজার থেকে তুলেছে ৩০ কোটি টাকা।
২০২০ সালের শেষ প্রান্তিকে রবি ৫২৩ কোটি, ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি, ডমিনোস স্টিল বিল্ডিং সিস্টেমস লিমিটেড ৩০ কোটি, এসোসিয়েট অক্সিজেন ১৫ কোটি, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স ২৬ কোটি টাকা তুলেছে।
বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে চলতি বছর মীর আকতার ১২৫ কোটি, অ্যানার্জিপ্যাক ১৫০ কোটি টাকা তুলেছে।
২০২০ সালে ওয়ালটন ১০০ কোটি আর এডিএন টেলিকম তুলেছে ৫৭ কোটি টাকা।