সরকারের কঠোর সতর্কতার প্রভাব নেই আলুর বাজারে। সেই আগের দামেই কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। খুচরা, পাইকারি বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, হিমাগারে দাম কমেনি।
হিমাগারে প্রশাসনের অভিযানেও প্রমাণ মিলেছে। জরিমানাও হচ্ছে। তবু কাজ হচ্ছে না।
আলুর দাম প্রথমে বেঁধে দেয়া হয়েছিল গত ৭ অক্টোবর। কৃষি বিপণন অধিদফতর সেদিন ‘যৌক্তিক মুনাফা’ বিবেচনা করে খুচরায় ৩০ টাকা, পাইকারিতে ২৫ আর হিমাগারে সর্বোচ্চ দাম ২৩ টাকা ঠিক করে।
তবে দাম কমেনি। আর বাস্তবতা বিবেচনায় মঙ্গলবার ‘যৌক্তির মুনাফা’ বাড়ায় অধিদফতর। হিমাগারের আলুতে বাড়তি চার টাকা মুনাফার সুযোগ দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় ২৭ টাকায় বেচবেন তারা। পাইকারিতে দাম হবে ৩০, আর খুচরায় ৩৫।
- আরও পড়ুন: আলুর দাম বাড়াল সরকার
তবে ক্রেতার কোনো লাভ হচ্ছে না। হিমাগার মালিকরা সরকারের সঙ্গে বৈঠকে ২৭ টাকা দাম মেনে নিয়ে এখন বলছেন, ‘পোষায় না’।
সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি খোলা বাজারে ৮০টি ট্রাকে করে যে আলু বিক্রি করছে, সেটাও তারা হিমাগার থেকে কিনতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা।
টিসিবি ২৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছে ট্রাকে করে
তিনি জানান, তারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশিতে আলু কিনছেন। পরে ভর্তুকিতে বিক্রি করা হচ্ছে তা।
কারওয়ান বাজারের আড়তদার দ্বীন ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হিমাগারে মাল আছে। তারা ছাড়ে না। আমাদের কেজিতে পড়ে ৩৫ টাকার মতো। আমরা বেচি ৩৯ থেকে ৪০ টাকায়। এর থেকে পাঁচ টেহা লাভ কইরা খুচরারা বেঁচে ৪৫ টেহায়। এলাকার দোকানদাররা ৫০ টেহাতেও বেঁচে। যে যেমন কিনে, সেই দামেই লাভ রেখে বেঁচে। কমে কিনতে পারলে বেচতামও কম।’
হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মোশাররফ হোসেন স্বীকার করেছেন, তাদের পর্যায়ে দাম কমেনি। তিনি বলেন ‘অ্যাসোসিয়েশন থেকে সব হিমাগার মালিককে ২৭ টাকায় আলু ছাড়তে বলে দেয়া হয়েছে।’
- আরও পড়ুন: জরিমানার ভয়ে আলু বিক্রি বন্ধ
তবে এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না, সেটা অস্বীকার করছেন না মোশাররফ। নানা যুক্তিও দেখান তিনি। বলেন, ‘অনেক হিমাগার মালিক এলাকায় থাকে না। তিনি হয়তো ফোনে দায়িত্বশীল কাউকে বলে দিল আলু ছাড়ার। কিন্তু যাকে দায়িত্ব দেয়া হলো, দেখা গেল তিনি হয়তো কিছুটা বেশি দামেই বিক্রি করছেন।’
‘আপনাদের দায় কী?’
মোশাররফ বলেন, ‘কোনো হিমাগার মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে অ্যাসোসিয়েশন তার সঙ্গে থাকবে না। সরকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করব।’
আমাদের বগুড়া প্রতিনিধি খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, অবৈধভাবে আলু মজুদ ও অতিরিক্ত দাম রাখায় শুক্রবার বগুড়ায় শাহ সুলতান কোল্ডস্টোরেজকে ৪০ হাজার ও আফাকু কোল্ডস্টোরেজকে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, বেঁধে দেয়ার দামে আলু বিক্রি না করে কয়েকজন হিমাগার মালিক তাদের প্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে রেখেছেন। বাকিরাও নির্ধারিত দামে বিক্রি করছেন না।
- আরও পড়ুন: লাভ হলো না দাম বাড়িয়েও
একটি হিমাগারের মালিকের দাবি, তারা নন, কৃষক দায়ী। তিনি বলেন, ‘কৃষকরা আলু বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় বাজারে আলুর সরবাহ তেমন বাড়ানো যাচ্ছে না।’
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে সরবরাহ অনেক কম
‘হিমাগারে আলু রাখে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। কিন্তু কেউ বিক্রি করতে রাজি না হলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না’, বলছিলেন তিনি।
কিন্তু আপনাদের আলুই তো বেশি- এমন মন্তব্যের পর তিনি বলেন, ‘আমাদের মজুদ সবটাই ছাড়ার চেষ্টা করছি।’
গজারিয়া কৃষি কর্মকর্তা তৌফিক আহমেদ নূর জানান, তারা প্রতিটি হিমাগার পরিদর্শন করে কী পরিমাণ আলু মজুদ রয়েছে, তার তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
সিলেট প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিলেট নগরের সোবহানীঘাট ও কালীঘাট পাইকারি বাজারে অভিযান চালিয়ে ছয়টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে।
অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্যামল পুরকায়স্থ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের অবশ্যই সরকার নির্ধারিত মূল্যে আলু বিক্রি করতে হবে।’
পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা প্রশ্ন তুলছেন, অভিযান কেন তাদের লক্ষ্য করে।
অভিযানের ভয়ে ঢাকার পাইকারি বাজারে আলু বিক্রি বন্ধের ঘটনাও ঘটেছে চলতি সপ্তাহে
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মাসুম আরেফিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কেইস টু কেইস ভিত্তিতে হিমাগারগুলোতেও অভিযান চালাচ্ছি। একাধিক জেলার কয়েকটি হিমাগার মালিককে জরিমানাও করা হয়েছে।’
কৃষি বিপণন অধিদফতর সহকারী পরিচালক মজিবর রহমান বলেন, ‘দাম মনিটরিং করা হচ্ছে। তার বাইরে গিয়ে কেউ বেশি দামে বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
রাজধানীর বাজার চিত্র
টিবিসির ওয়েবসাইটে ১০ শতাংশ দাম কমার তথ্য থাকলেও তার কোনো প্রমাণ মেলেনি বাজারে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার, মহাখালী, রায়ের বাজার, জিগাতলা নতুন কাঁচাবাজার, মোহাম্মদপুর, পশ্চিম রাজাবাজার, হাতিরপুলসহ বিভিন্ন বাজারে আগের মতোই খুচরা পর্যায়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দামেই আলু বিক্রি হচ্ছে।
জিগাতলা নতুন কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী রিপন ভুঁইয়া বলেন, ‘আল্লাহর কিরে, ৫০ টাকার নিচে বেচলে আমাদের লস হয়া যায়। কেনা দরই পড়ে বেশি। আর আলুও নাই বেশি। কারওয়ান বাজারে যা আসে আমরা ভাগেচুগে নিই।’
আরও পড়ুন: ‘আলু নিয়া তারা তামাশা করতাছে’
মিরপুরের কালশি কাঁচাবাজারে সবজি কিনতে আসা মরিয়ম বেগম বলেন, ‘টিভিতে দেখি দাম কমছে। কিন্তু বাজারে একই। দাম কমার ভিডিও সব কারওয়ান বাজারের। দুই কেজি আলু ৩৫ টাকায় কিনতে নিশ্চয়ই কারওয়ান বাজার যাব না। তাই দাম বেশি হলেও এলাকা থেকেই নিতে হইতেছে।’
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, গত মৌসুমে চাহিদার চেয়ে বেশি ছিল উৎপাদন
কারওয়ান বাজারে আলুর দোকানগুলোতে কেজি প্রতি ৩৫ টাকা দরের বোর্ড টানানো। পাশে কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
যতক্ষণ ক্যামেরা সেখানে, ততক্ষণ ব্যবসায়ীরা হাঁক দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘সরকারি রেট ৩৫, সরকারি রেট ৩৫।’
ক্যামেরা চলে গেলেই সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন একজন। বলেন, ‘আজাইরা কাম এগো।’