‘ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে,
দিকে দিগন্তরে ভুবনমন্দিরে শান্তিসঙ্গীত বাজে’
লাল আভা ছড়িয়ে জেগে উঠেছে নতুন দিনের সূর্য, নিয়ে এসেছে নতুন বছরের আগমনী বার্তা। বাঙালির জীবনে এসেছে পয়লা বৈশাখ। জীর্ণ-পুরোনো, অশুভ, অসুন্দর পেছনে ফেলে নূতনের কেতন উড়ানোর দিন আজ বাঙালির। বর্ষপঞ্জিতে যোগ হলো নতুন বছর ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।
পয়লা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন। পৃথিবীতে প্রচলিত বেশিরভাগ বর্ষপঞ্জি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, তবে বাংলা নববর্ষ পুরোটাই স্থানিক। এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব প্রয়োজনের তাগিদ থেকেই বাংলা বর্ষগণনার সূচনা।
কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে এ বর্ষপঞ্জির যাত্রা শুরু। ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসাব কষার বিষয়টিও ধীরে ধীরে যুক্ত হয় এর সঙ্গে। আর তাই পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতির অংশ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাংলা ভূখণ্ডের সব মানুষ তাই মেতে ওঠে বর্ষবরণের উৎসবে।
এবারের পয়লা বৈশাখ বাঙালির জীবনে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত দুই বছর বৈশাখের রঙ ছিল ম্রিয়মাণ।
বর্ষবরণের বর্ণিল উৎসবের পরিবর্তে বাঙালিকে আটকে থাকতে হয়েছে ঘরের চার দেয়ালে। রমনার বটমূলে ধ্বনিত হয়নি প্রভাতী সংগীত। চারুকলা ছিল নিষ্প্রাণ, নিষ্প্রভ।
এবার বসন্তের সজীবতা গায়ে মেখে গ্রীষ্মকে জানানোর উৎসব দেশজুড়ে। মহামারির অভিঘাত পেছনে ফেলে রমনা বটমূলে ছায়ানটের সংগীতে বরণ হয়েছে বছরের প্রথম ক্ষণ।
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক’ ধ্বনির সমবেত মূর্ছনায় বছরের প্রথম রবির কিরণকে স্বাগত জানিয়েছেন শিল্পীরা। পুরোনো গ্লানি ভুলে নতুনের আবাহন ধ্বনিত হয়েছে সবার কণ্ঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সকাল ৯টায় শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। অমঙ্গল তাড়ানোর এই শোভাযাত্রার এবারের প্রতিপাদ্য: ‘তুমি, নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’। ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে; পেয়েছে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি।
পয়লা বৈশাখে উৎসবের শুরুর দিকটি ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। গ্রামীণ মেলা, লোকজ খেলাধুলা ও নাচ-গান ছিল প্রধান আকর্ষণ। দিনে দিনে শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে উৎসব।
বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও আয়োজন হচ্ছে বৈশাখী মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি আর বর্ণিল পাঞ্জাবি গায়ে তরুণ-তরুণীরা মেতে উঠেছেন প্রাণের উচ্ছ্বাসে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী
দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আনন্দঘন এ দিনে দেশ ও দেশের বাইরে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান রাষ্ট্রপ্রধান।
মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘বৈশাখ শুধু উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আত্মবিকাশ ও বেড়ে ওঠার প্রেরণা। বাঙালি জাতির অসাম্প্রদায়িক চেতনায় চিড় ধরাতে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি সামরিক সরকার বাংলা নববর্ষ উদযাপনসহ সব গণমুখী সংস্কৃতির অনুশীলন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
‘সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ধর্মীয় ও গোষ্ঠীগত ভেদাভেদ ভুলে নববর্ষ উদযাপনে এক কাতারে শামিল হন। সে সময় বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মুক্তিসাধনায় পহেলা বৈশাখ ছিল মূল শক্তি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সংস্কৃতির এই শক্তি রাজনৈতিক চেতনাকে দৃঢ় ও বেগবান করেছিল।’
দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতা ভুলে সবাইকে নব আনন্দে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ বাঙালির সম্প্রীতির দিন; বাঙালির মহামিলনের দিন। এই দিন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণে, নব-অঙ্গীকারে। সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতাকে ভুলে সবাইকে আজ নব আনন্দে জেগে ওঠার উদাত্ত আহ্বান জানাই।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিগত বছরের গ্লানি, পুরাতন স্মৃতি, দুঃখ-বেদনা, অসুন্দর ও অশুভকে ভুলে গিয়ে নতুন প্রত্যয়ে আমরা এগিয়ে যাব। এবারের নববর্ষে এ হোক আমাদের প্রত্যয়ী অঙ্গীকার।’
কবিগুরুর ভাষায় তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি/যাক অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক, যাক যাক/এসো হে বৈশাখ এসো, এসো...’