‘আপনারা এসেছেন, সবাইকে ধন্যবাদ। আমি জানি আমাকে নিয়ে অনেক কমপ্লেইন আছে। সত্যি কথা বলতে, আমি অপেক্ষা করছিলাম যে আপনারা আগে সিনেমাটি দেখেন; আমি আপনাদের সঙ্গে মিট করতাম আরও আগেই, কিন্তু ভাবলাম সিনেমাটি দেখে কথা বললে সেটি আরও ইন্টারেস্টিং হবে।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে ক্যামেরার সামনে এসে এভাবেই শুরু করেন পরিচালক আবদুল্লাহ মোহম্মদ সাদ। তার পরিচালিত রেহানা মরিয়ম নূর সিনেমা দেশে মুক্তি পেয়েছে শুক্রবার।
মুক্তির আগে সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতে প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন সাদ। সেখানে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন, তাদের করা প্রশ্ন এবং নিউজবাংলার করা প্রশ্ন দিয়ে সাজানো হলো এ সাক্ষাৎকার।
- সিনেমা নিয়ে অন্য সবার বিশেষ করে রেহানার জার্নি আমরা শুনেছি। আপনার জার্নিটা শুনতে চাই।
প্রশ্নটা শুনতে অনেক সহজ প্রশ্ন মনে হয় কিন্তু এটার উত্তর খুবই কঠিন ও জটিল।
একটা ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট আছে। আমি আমার সেকেন্ড ফিল্ম হিসেবে আরেকটা বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করছিলাম ২০১৭ সালে। ওই আইডিয়াটা নিয়ে পাঁচ মাস কাজ করার পর সামহাউ আমার মনে হয়েছে এটা নিয়ে আমার ডিপার আন্ডারস্ট্যান্ডিং নাই। বিষয়টা যখন বুঝতে পারলাম, তখন ভাবলাম যে এটা করা উচিত না। এরপর আমি রেহানাতে ব্যাক করলাম।
রেহানার কথা চিন্তা করা শুরু করছি আমার প্রথম সিনেমার আগে থেকেই। আইডিয়াটা, ক্যারেক্টারটা আমার কাছে ওই অর্থে পরিষ্কার ছিল না, আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না বিষয়টি কোন দিকে যাচ্ছে এবং এটা আমি তুলে রাখি এবং লাইভ ফ্রম ঢাকা সিনেমাটি করি।
এরপর আমি যখন রেহানাতে কনসেনট্রেট শুরু করি, সেখানে অনেকের ইনফ্লুয়েন্স আছে। আগে কয়েকটা জায়গায় বলেছি যে, আমার আপুদের অনেক ইনফ্লুয়েন্স আছে সিনেমায়।
আমি ওদেরকে দেখেই বড় হইছি। ওদের পরিবর্তনগুলো দেখেছি এবং বড় আপু হিসেবে কেমন, ওদের প্রফেশনাল লাইফ, মা হওয়ার পর কেমন।
এভাবে রেহানার জার্নিটা শুরু।
- বাঁধনকে কেন, কীভাবে মূল চরিত্রে চূড়ান্ত করলেন?
বাঁধনের নাম আমাকে প্রথম সাজেস্ট করে আমাদের কাস্টিং ডিরেক্টর ইয়াসির আল হক।
ওনার সঙ্গে যখন আমরা প্রথম মিট করি, ওনার অ্যাপ্রোচ বা আমি যখন তাকে প্রশ্ন করেছি জীবন নিয়ে কিংবা সাধারণ যেসব কথাবার্তা হয়, তখন আমরা সেই ফিলিংসটা পেয়েছি। এটা কীভাবে পেয়েছি সেটা ব্যাখ্যা করা মুশকিল।
আমরা যখন লুক টেস্ট করি, আমাদের কস্টিউম ডিজাইনার অনেক আগে থেকেই করা ছিল, রেহানার কস্টিউমে যখন বাঁধনকে ক্যামেরায় প্রথম দেখি তখনই মনে হয়েছে সে রেহানা করতে পারবে। রেহানার যে ইমেজ ছিল ওটা আমি পাইছি। এটা ছিল প্রথম পয়েন্ট।
এর পর যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বাঁধন এত কমিটেড কি না, আমাদের অত বেশি পাত্তা দেবে কি না বা ওই পরিশ্রমটা করবে কি না, পরে কয়েকবার কথা বলে সেটা আমরা বুঝতে পেরেছি।
রেহানাকে বাঁধন খুব আর্লি স্টেজ থেকেই কানেক্ট করতে পেরেছে, যেটা আমাকে খুব ইন্সপায়ার করছে যে ঠিক আছে আমি আমার রেহানাকে পেয়েছি।
- আপনার মুখ থেকে শোনা হয়নি যে বিষয়টি, সেটা হলো- আপনি আড়ালে থাকেন কেন?
আমি খুবই দুঃখিত, বিশ্বাস করেন এটা আমার ইনটেনশন না।
আমি আসলে ক্যামেরার সামনে না, পেছনে থাকতে চাই। ক্যামেরার সামনে আমি খুব আনকমফোরটেবল ফিল করি। আমি ট্রাই করি যেন কাজটা ঠিকমতো করতে পারি। আমি আশা করছি আজকের পর এ কমিউনিকেশন হবে না।
আমি শুনেছি অনেকে আমার ওপর রাগ করে আছেন, মন খারাপ করে আছেন। বিশ্বাস করেন আমরা একদমই আঘাত করতে চাইনি আপনাদেরকে।
কিন্তু বিষয়টা খুবই কষ্টকর আমার জন্য এবং আমি নার্ভাস হয়ে যাই আপনাদের সামনে। তা ছাড়া ভালো করে গুছিয়ে কথাও বলতে পারি না।
- আপনার সিনেমার চরিত্রগুলো সংকটপূর্ণ। আপনি এমন সংকটপূর্ণ চরিত্র নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী কেন?
মানুষের চরিত্রগত কমপ্লেক্সিটি নিয়ে আমি খুবই ইন্টারেস্টেড। আমাদের মধ্যে এত কন্ট্রাডিকশন। কখনও আমাদের ইনটেনশন ঠিক তো অ্যাকশন ঠিক না, আবার অ্যাকশন ঠিক তো ইনটেনশন ঠিক না।
এসব কমপ্লেক্সগুলোর নানা লেয়ার বা শেডস প্রকাশ পায় যখন মানুষ সমস্যা বা বিপদে পড়ে।
সবকিছু মিলিয়ে হিউম্যান ন্যাচারের কমপ্লেক্সিটি নিয়ে আমি সব সময় খুব ফ্যাসিনেটেড। তাই আমার রাইটিংয়ে তার প্রভাব পড়ে।
- সিনেমার গল্পটি এই সময় বলতে চাইলেন কেন?
এই গল্পটা তো অনেক আগে ভেবেছিলাম। কাজও শুরু হয়েছে অনেক আগে, কিন্তু দর্শকরা দেখছেন এখন।
এর আলাদা কোনো কারণ নেই। যদিও সিনেমা যে বিষয় সেটি নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। তবে এটা কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে।
- সিনেমার এডিটিং স্টাইল বা ক্যামেরা অপারেশনের স্টাইল কিংবা কালার টোন এমন কেন?
আমার এডিট স্টাইলটা কঠিন, এটার কারণ হলো, আমি চাই না আমার ন্যারেটিভ সেন্টিমেন্টাল হোক এবং আমি সব সময় ইন্টারপ্রিটেশন স্পেস রাখতে চাই আমার দর্শকের কাছে।
আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো আমি ইন্টারেস্টিং ইনসাইট এবং ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন তুলতে পারছি কি না।
আমি আমার প্রোটাগনিস্টকে যে ইনভেস্টিগেশন করছি তার লাইফটাও অনেক কঠিন। তাই এডিটিং, ক্যামেরার কাজ এবং সিনেমার রং সেভাবে সেট করা হয়েছে।
অনেক এলিমেন্ট দিয়েই তো একটা পরিবেশ তৈরি করতে হয়। তো আমি যে পরিবেশটা তৈরি করতে চেয়েছি, তার জন্যই বিষয়গুলো এমন।
- সিনেমার একটি জায়গায় রেহানা হাসপাতালে ভর্তী থাকেন। সেখানে তার আশে পাশের চরিত্রগুলোর কণ্ঠে নারী-পুরুষের নাস্তা বানোনো নিয়ে যে তর্ক বা কথোপকথন, সেটা আরোপিত মনে হয়েছে। কী বলবেন?
হসপিটালে রোগীকে দেখতে যাওয়ার পর যেটা হয়, রোগীর খোঁজ খবর নেয়ার পর আলাপ অন্য জায়গায় চলে যায়। যে মানুষটি বা যে ঘটনাটি কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক না, সেটা নিয়েই তুমুল আলোচনা চলতে থাকে।
আমি তেমন একটা ঘটনা বা পরিবেশ তৈরি করা বা দেখানো চেষ্টা করেছি। তবে আমি দুঃখিত যে দৃশ্যটিকে আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারিনি; আরোপিত মনে হয়েছে।
- সিনেমাটি কয়েকটি জায়গা থেকে গ্র্যান্ড পেয়েছে। তবুও শোনা যায় যে এ সিনেমার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়েছে।
আমরা কোনো প্রোডাকশন বাজেট পাইনি। আমরা একটা গ্র্যান্ড পেয়েছি, যেটা ছিল স্ক্রিপ্ট লেভেলে, আরেকটা পেয়েছি পোস্ট প্রোডাকশনে, কিন্তু প্রোডাকশনের কোনো গ্র্যান্ড আমরা পাইনি। অনেক জায়গায় আবেদন করেছিলাম কিন্তু সবাই রিজেক্ট করেছে।
তবে লাইভ ফ্রম ঢাকা সিনেমার চেয়ে এবার একটু বেশি টাকা পেয়েছি। যেটা দিয়ে কাজটা করেছি।
- আপনি তো একজন দর্শকও। নিজের সিনেমা দেখার পর কেমন লেগেছে? আরও ভালো করার জায়গা ছিল কি?
অনেক কিছু ছিল। আমার অনেক সিদ্ধান্ত হয়তো আমি অন্যভাবে নিতে পারতাম। আমি দেড় বছর বিভিন্ন সময় সিনেমাটা এডিট করছি।
আমি চেষ্টা করছি বেস্ট ভারসনটা দিতে। আমি হয়তো আরও অনেক দৃশ্য অন্যভাবে নিতে পারতাম। তবে আমি আমার টিমের ওপর অনেক খুশি।
সিনেমাটি কানে দেখানো হয়েছে, অস্কারে গেছে, যদি এগুলো পেয়েও যায় তারপরও আরও একটু ভালো করা চেষ্টা যায় না।
- দর্শকদের কাছ থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করেন?
আমরা আমাদের বেস্ট ট্রাই করছি। আমরা যে সিনেমাটা বানাতে চেয়েছি তার জন্য বেস্টটা দিয়েছি। আশা করি আমাদের সিনেমাটাকে অডিয়েন্স একটা চান্স দেবে, একটা অপরচুনিটি দেবে।
দর্শকদের কাছ থেকে আমি এক ধরনের প্রতিক্রিয়া চাই না, আমি আশা করি অনেক ডিফরেন্ট ইন্টারপ্রিটেশন আসবে। আমাদের সিনেমাতে আমরা অনেক ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন রেইজ করতে চেয়েছি এবং সেই সব প্রশ্ন নিয়ে ডিফরেন্ট ইন্টারপ্রিটেশন আসবে বলে আশা করি। সেটার জন্য সিনেমাটা দেখতে আসতে হবে।
- সমালোচনা হলে কতটা নিতে পারবেন?
আমরা আমাদের কষ্টটা করছি, এখন আমরা আশা করি যে অডিয়েন্সে এর রেসপন্স করবে। যদি ভালো লাগে ভালো, না ভালো লাগলে তারা কথা বলবেন।
কেউ যদি বলে যে ভালো লেগেছে তাহলে অবশ্যই ভালো লাগবে, কেউ যদি বলে যে খারাপ লেগেছে তাহলে খারাপ লাগবে।
ভালো না লাগলে আমি জিজ্ঞেস করব যে কেন, কোন কোন জায়গায় খারাপ লেগেছে।
তবে দর্শকদের খারাপ লাগলে যে আমাদেরও খারাপ লাগবে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই।