সূরা আহযাব, পর্ব ১
অনুবাদ
(১) হে নবী! আল্লাহকে ভয় করো। আর কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ করো না। আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। (২) আর তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমার প্রতি যে ওহী নাযিল করা হয়, তার অনুসরণ করো। নিশ্চয় আল্লাহ তোমরা যা করো সে ব্যাপারে পূর্ণ অবগত। (৩) আর আল্লাহর উপর ভরসা করো। ভরসাস্থল হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।
মর্ম ও শিক্ষাপূর্ব সূরার শেষ দিকে বলা হয়েছে, রাসূল (স) ও সত্যপন্থিরা যেন বাতিলপন্থিদের এড়িয়ে যায় এবং সত্যপন্থী ও বাতিলপন্থিরা নিজ নিজ পরিণামের জন্য অপেক্ষা করে। এরপর সূরা আহযাব শুরু হয়েছে এমন একটি প্রেক্ষাপট দিয়ে যেখানে বাতিলপন্থিরা রাসূল (স)-এর নিকট এক প্রকার সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই সমঝোতার সারকথা হলো পৌত্তলিকতা ও ইসলাম ধর্ম উভয়টিকেই গ্রহণ করা এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কোন কিছু না বলা। সে পরিপ্রেক্ষিতে এখানে রাসূল (স) ও সত্যপন্থিদের আল্লাহ বলে দিয়েছেন, তাদের সমঝোতার প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাদের কথায় কর্ণপাত করা যাবে না। আর তা করতে গিয়ে সত্যপন্থিদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। ভয় করতে হবে একমাত্র আল্লাহকে। উভয় পক্ষের পরিণাম আল্লাহর হাতেই রয়েছে। সুতরাং এ সূরায় বর্ণিত খন্দক বা আহযাব যুদ্ধের মাধ্যমে সে পরিণাম পরিস্কার হয়ে গেছে। তিন হাজার লোকের মুসলিম বাহিনীর হাতে বার হাজার সশস্ত্র সৈন্যের শত্রু বাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করেছে। সেহেতু সূরাটির শুরুতেই বলা হয়েছে, ভয় করতে হবে আল্লাহকে। অন্য কাউকে নয়। শত্রু বাহিনী যত বড়ই হোক, তাদেরকে ভয় করার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ সত্যের সহায়ক ও সাহায্যকারী। প্রেক্ষাপট ও কাহিনী: চতুর্থ বা পঞ্চম হিজরীতে সংঘটিত খন্দক যুদ্ধের পূর্বের ঘটনামক্কা থেকে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, ইকরামা ইবনে আবু জাহল ও আমর ইবনে সুফিয়ান সালমি মক্কা থেকে মদীনায় এসে মুনাফেকদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল এর সাথে দেখা করে। সেখানে রাসূলের নিকট একটা সমঝেতা প্রস্তাব দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তাদের সাথে আরো একত্রিত হয় কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ইহুদী। এরপর এ দলটি রাসূল (স)-এর সাথে দেখা করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন উমর ইবনে খাত্তাব। তারা এসে বললো, আমরা একটা সমঝোতা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। তা হলো এই যে, আপনি আমাদের দেব-দেবতার বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না, আর আমরাও আপনার প্রভু ও দীনের বিরুদ্ধে কিছু বলল না। এভাবে আমরা সহাবস্থান করব এবং শান্তিতে বাস করব। মুনাফেকদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বার বার রাসূল (স)-কে অনুরোধ করে, যেনো তিনি সমঝোতা প্রস্তাব মেনে নেন, যাতে করে গোটা অঞ্চল ও দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। তা না হলে যুদ্ধ ও বিরোধ চলতেই থাকবে। গোটা আরবের লোকেরা যদি মুসলিমদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, তাহলে অনেক রক্তপাত হবে। গোটা আরবের সাথে মদীনার মুসলিমদের টিকে থাকা দুরুহ হতে পারে। টিকে থাকলেও জান মালের প্রচুর ক্ষতি হবে। এসব কথা বলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই চেষ্টা করে যাচ্ছিলো যাতে রাসূল (স.) রাজি হয়ে যান। এ অবস্থা দেখে উমর (রা.) রাসূল (স)-এর নিকট তাদের সবাইকে হত্যা করে দেয়ার অনুমতি চাইলেন। রাসূল (স) তাতে সায় দিলেন না। বরং বললেন, তাদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেয়া হোক। পরে তাদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেয়া হলো। তাদের উপর আঘাত করা হলো না এবং কোন প্রকার শাস্তি দেয়া হলো না।হক ও বাতিলের মধ্যে আপস হতে পারে না আলোচ্য ঘটনার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ রাসুল (স) এবং মুসলিমদেরকে অবহিত করে দিয়েছেন যে কাফির মুশরিকরা কুমতলব নিয়ে আপোস করার কথা বলবে এবং শান্তি প্রস্তাব নিয়ে আসবে। কিন্তু ভিতরে ও নেপথ্যে থাকবে ষড়যন্ত্র এবং ইসলাম ও মুসলিমদেরকে ঘায়েল করার ষড়যন্ত্র। আল্লাহ এখানে তাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন কাফের, মুশরিক ও মুনাফিকদের প্রস্তাবে সাড়া না দেয় এবং তাদের কথা না শুনে। এখানে কয়েকটি বিষয় বিবেচ্য। প্রথম, দীন ও আদর্শের ব্যাপারে আপস নেই, যেমন সূরা কাফিরুনে স্পষ্টভাবে বলা দেয়া হয়েছে। কারণ সাংঘর্ষিক আদর্শে সমঝোতা হওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয়, সংঘর্ষিক আদর্শিক ব্যাপারে সমঝোতা না হলেও সংঘর্ষ কাম্য নয়। তৃতীয়, সামাজিক ও বৈষয়িক বিষয়ে সমঝোতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সহঅবস্থানের নীতি অবলম্বন করতে হবে, যাতে একটা সুখী সুন্দর সমাজ গড়ে উঠতে পারে। এগুলি হলো ইসলামি সমাজব্যবস্থার অন্যতম মূলনীতি।হক ও বাতিলের মধ্যে কেন আপোষ হতে পারে না, এ বিষয়টির একটু যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আসলে যৌক্তিক কারণেই সাংঘর্ষিক আদর্শের মধ্যে আপস সম্ভব নয়। যখন মুসলিমরা বলে, আল্লাহ এক একক ও অদ্বিতীয়, তখন একই সাথে তারা বলতে পারেনা যে স্রষ্টা ও প্রতিপালক একাধিক ও অসংখ্য। সারকথা, একেশ্বরবাদী মুসলিম এবং বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসীরা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান করতে পারে, কিন্তু সাংঘর্ষিক ধর্ম বিশ্বাসকে একই সঙ্গে গ্রহণ করতে পারে না।ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা জ্ঞান বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ ও কল্যাণময়আয়াতে কাফির ও মুনাফেকদের কথামতো না চলার নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে বলা হয়েছে, আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ প্রচলিত বাতিল ধর্ম-বিশ্বাসের বিপরীতে আল্লাহ যে দীন দিয়েছেন, সে ইসলাম হলো সর্বজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর দেয়া দীন ও জীবন-ব্যবস্থা। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা দিয়েছেন। তা অনুসরণে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানেই কল্যাণ পাবে। নির্ভুল জ্ঞানের উৎস হলো ওহী জ্ঞানের উৎস হলো দুটি। প্রথম, ওহী ভিত্তিক জ্ঞান ও জীবন-ব্যবস্থা। দ্বিতীয়, মানব রচিত জ্ঞান ও জীবন-ব্যবস্থা। সর্বজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে মানুষের জন্য জ্ঞানভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থা দান করেছেন, যাতে রয়েছে মানুষের কল্যাণ। ওহীর মাধ্যমে তারই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যা মানুষের জন্য কল্যাণকর, তাই নিষেধ করা হয়েছে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। অপরপক্ষে মানুষ নিজ অভিজ্ঞতা ও চর্চার কারণে যে জ্ঞান লাভ করে, তা ক্ষণিকের জন্য কল্যাণকর মনে হতে পারে, কিন্তু পরেই তার ভুল প্রমাণিত হয়। এজন্যই দেখা যায়, বিজ্ঞানীরা অনেক তথ্য দেন, যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়। একমাত্র ইসলাম বা ওহী ভিত্তিক জ্ঞান কখনো ভুল বলে প্রমাণিত হয় না। সুতরাং দেখতে হবে মানুষের অর্জিত জ্ঞান ওহীভিত্তিক জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা। যদি তা ওহীভিত্তিক জ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তা পরিত্যাগ করতে হবে।
ওহীভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থা ইসলাম হলো ওহী ভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থা, যা আল্লাহ থেকে নাযিলকৃত। অন্যান্য মতবাদ বা ধর্ম বিশ্বাসের কোনটির উৎসে ওহীভিত্তিক থাকলেও পরে তা মানব রচিত হয়ে গেছে। যেমন, ইহুদি ও খ্রিষ্টান ধর্মে কতটুকু ওহীভিত্তিক আর কতটুকু মানব রচিত, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ তাতে যথেষ্ট পরিবর্তন আনা হয়েছে। একমাত্র কোরআনই অপরিবর্তিত আছে এবং একমাত্র এটাই নিখাঁদ ওহীভিত্তিক জীবন-ব্যবস্থা পেশ করে।রাসূলের আদর্শ ওহীভিত্তিক কোরআন ও রাসূলের আদর্শ উভয়টি ওহীভিত্তিক। ওহী দুপ্রকার। একটি হলো শব্দ ও অর্থসহ ওহী, যা কোরআনের অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়, যা শব্দসহ নাযিল হয়নি, বরং বক্তব্যেটি আল্লাহর তরফ থেকে বটে, কিন্তু রাসূল (স.) নিজের ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন, তা হলো সুন্নাত। সেটাও ওহীভিত্তিক জ্ঞান। কোরআনে বলা হয়েছে, রাসূল (স.) নিজ থেকে বানিয়ে কিছু বলেন না, তা নিখাদ ওহী। সুতরাং ওহী ভিত্তিক জ্ঞান দুই প্রকার। একটি হলো কোরআন, আরেকটি হলো রাসুলের আদর্শ।বাতিলের শক্তিতে ভীত না হওয়া কাফির ও মুনাফিকদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ওহীভিত্তিক ইসলামী জীবনব্যবস্থা অনুসরণের নির্দেশের সাথে সাথে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে সত্যপন্থীরা যেনো আল্লাহকে ভয় করে, অন্য কাউকে ভয় না করে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও মক্কা থেকে আগত পৌত্তলিক নেতৃবৃন্দ ইহুদীদের সাথে মিলে বিরোধী শক্তির ভয় দেখাচ্ছিল। সমঝোতা না হলে ঝগড়া বিবাদ ও যুদ্ধ লাগতে পারে। তখন গোটা আরবের মোকাবেলায় গুটি কয়েক মুসলমানের টিকে থাকা কঠিন হবে। কিন্তু আল্লাহ এখানে মুসলিমদেরকে নির্ভয় দিচ্ছেন যে, তারা যেনো আল্লাহকে ভয় করে, অন্যকে ভয় না করে। কারণ আল্লাহ সত্যের পক্ষে আছেন। আর আল্লাহ যাদের পক্ষে আছেন, তাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। তাওয়াক্কুল ও ভরসা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর উপর বাতিলপন্থিদেরকে ভয় করে সাংঘর্ষিক ক্ষেত্রে আদর্শিক সমঝোতা ঠিক নয়। এছাড়া আল্লাহর দীনের উপর অটল থাকতে হলে এবং দীনের দাওয়াত দিতে হলে নির্যাতন অবধারিত। নির্যাতন কম বা বেশি হতে পারে। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যতো নবী এসেছেন, যতো সত্যপন্থি দাওয়াত দিয়েছেন, তাদের উপর নির্যাতন এসেছে। মানসিক নির্যাতন, দৈহিক নির্যাতন এবং এমনকি প্রাণও দিতে হয়েছে। সকল অবস্থায় আল্লাহর উপরই ভরসা রাখতে হবে। বাতিলপন্থিদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকাএখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। বাতিলপন্থিদের সুন্দর কথার আড়ালে ষড়যন্ত্র থাকতে পারে। মক্কার বাতিলপন্থিদের নেতৃবৃন্দ রাসূলের নিকট এসে বাহ্যত সুন্দর একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তার গভীরে ছিল এক কঠিন ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রের সারমর্ম ছিল এই যে, রাসূল (স) ও সত্যপন্থিরা মানুষকে সত্যের পক্ষে দাওয়াত দিবেন না। বরং দাওয়াত দেয়া বন্ধ করে দেবেন। কারণ সত্যের দাওয়াত দিতে হলে বলতে হবে যে, বহু দেবতায় বিশ্বাস সত্য নয় বরং তা মিথ্যা। সুতরাং সে বিশ্বাস ত্যাগ করে বাতিলের যুক্তিহীনতা তুলে ধরতে হবে। সারকথা, তাদের সুন্দর প্রস্তাবের আড়ালে ছিল সত্য প্রচার বন্ধ করার ষড়যন্ত্র। কাজেই পরবর্তী যুগেও যখনই বাতিলপন্থিদের নিকট থেকে কোনো প্রস্তাব আসে, তা বাহ্যত সুন্দর হলেও পর্যালোচনা করে দেখা উচিত তার অভ্যন্তরে কিছু আছে কিনা।