বর্তমান যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সংবাদ প্রচারের প্রধান মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম প্রতিদিন সীমাহীন সংবাদ পৌঁছে দেয় সাধারণ জনগণের কাছে। বিশেষভাবে তৃণমূল সংবাদ, যা স্থানীয় ও দৈনন্দিন জীবনের খবর নিয়ে গঠিত, এই মাধ্যমগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের এই সুবিধার সঙ্গে রয়েছে গুজবের দ্রুত বিস্তার। কোনো খবরের সত্যতা যাচাই না করেই তা ভাইরাল হওয়ার কারণে সমাজে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং কখনও কখনও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাই সঠিক তথ্য ও মিথ্যা তথ্যের মধ্যে পার্থক্য বোঝার জন্যে এবং জনগণকে ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রদান এখন সময়ের দাবি। ১. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থান ও প্রভাবঃ ১.১ সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদ প্রচার: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফেসবুক: ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৫,৫০০,০০০। হোয়াটসঅ্যাপ: গ্রুপ চ্যাট ও ব্রডকাস্টে স্থানীয় খবর দ্রুত ছড়ায়। টুইটার ও ইউটিউব: রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রচারে ব্যবহৃত হয়। সামাজিক মাধ্যমের এই শক্তি জনগণকে সজাগ ও সচেতন রাখার পাশাপাশি তৃণমূল সংবাদ পৌঁছে দেওয়ায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ১.২ প্রভাব: ডিজিটাল সংবাদ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, গুজবের দ্রুত বিস্তার: যাচাইহীন তথ্যের কারণে বিভ্রান্তি বৃদ্ধি। সামাজিক বিভাজন: ধর্ম, অঞ্চল ও রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে দ্বন্দ্ব। রাজনৈতিক উত্তেজনা: নির্বাচনী সময়ে মিথ্যা সংবাদ প্রচার অস্থিরতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে। ২. গুজবের ধরন ও উদাহরণ : গুজব সাধারণত তথ্যের প্রকৃত সত্যতা যাচাই না করেই ছড়িয়ে পড়ে। তা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে- ১. রাজনৈতিক গুজব: নির্বাচনী বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। ২. সামাজিক গুজব: জনমানসে ভীতি সৃষ্টি করা, যেমন, ছেলেধরা গুজব। ৩. ধর্মীয় বা আঞ্চলিক গুজব: সমাজে বিভাজন ও উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্য। উদাহরণ- ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ছেলেধরা গুজবের কারণে এক নারীকে হত্যা করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত একটি গুজব সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। এই গুজবের ভিত্তি ছিল ‘সেতু নির্মাণের সময় শিশুদের কাজে লাগানো হবে’- যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ৩. গুজবের বিস্তার ও কারণঃ গুজব ছড়ানোর কারণসমূহ- তথ্য যাচাই না করা: মানুষ যাচাই ছাড়া খবর শেয়ার করে। ভীতি ও কৌতূহল কাজে লাগানো: আতঙ্ক সৃষ্টি করে দ্রুত তথ্য ছড়ানো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। সামাজিক অস্থিরতা: জনমত প্রভাবিত করা। গবেষণা অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে ৬৫% ডিজিটাল ব্যবহারকারী কোনো না কোনো সময়ে যাচাইহীন সংবাদ শেয়ার করেছেন। ৪. ডিজিটাল সাক্ষরতা ও গুজব প্রতিরোধ : ৪.১ ডিজিটাল সাক্ষরতা: ডিজিটাল সাক্ষরতা বলতে বোঝায় তথ্য যাচাই, সোর্স চেক এবং অনলাইন নিরাপদ ব্যবহার শেখা। কৌশল- সোর্স যাচাই: কোন সংবাদ কোন উৎস থেকে এসেছে তা চেক করা। গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ: ছবি ও ভিডিও যাচাই করতে ব্যবহার করা। ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট: যেমন Bangladesh Fact-Check Network (BFCN)। ৪.২ শিক্ষণীয় উদাহরণ: ২০২২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রকল্প চালু করে, যেখানে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা শেখানো হয়। ফলাফল হিসেবে, পরীক্ষার সময় তারা যাচাইহীন সংবাদ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। ৫. সরকারের ভূমিকা : সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে, যা গুজব ও মিথ্যা তথ্য প্রতিরোধে সহায়ক। মূল উদ্যোগ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮: গুজব ও মিথ্যা তথ্য শেয়ার প্রতিরোধ। সচেতনতা অভিযান: মিডিয়ার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: স্কুল ও কলেজে ডিজিটাল সাক্ষরতা অন্তর্ভুক্ত করা। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। ৬. স্থানীয় সংবাদ ও গুজবের সামাজিক প্রভাব : তৃণমূল সংবাদ মূলত স্থানীয় পর্যায়ের খবর প্রচার করে। যখন এই খবরের সঙ্গে গুজব মিশে যায়, তখন এর প্রভাব সমাজে গভীর হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় রাজনৈতিক গুজব: নির্বাচনী এলাকায় বিভাজন ও উত্তেজনা বৃদ্ধি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে গুজব: বিদ্যালয় বন্ধ, ভ্যাকসিন গ্রহণে অনীহা। অর্থনৈতিক প্রভাব: বাজারে অযাচিত আতঙ্ক সৃষ্টি, মূল্যবৃদ্ধি ও পণ্য সংকট। ৮.শেষাংশঃ ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তৃণমূল সংবাদ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে যাচাইহীন তথ্য বা গুজবের কারণে বিভ্রান্তি ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সমাধানমূলক দিক- ১. ডিজিটাল সাক্ষরতা বৃদ্ধি করা। ২. জনগণকে উৎস যাচাই, তথ্য যাচাই শেখানো। ৩. গণমাধ্যম ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা নিশ্চিত করা। ৫. সরকারের নীতি ও আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা। সতর্ক, সচেতন ও বুদ্ধিমান ব্যবহারকারীর মাধ্যমে গুজব রোধ করা সম্ভব। এভাবেই সমষ্টিগত সচেতনতায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের নিরাপদ ও কার্যকর সুফল ব্যবহার সম্ভব হয়ে উঠবে।লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সংবাদ : গুজব বনাম বাস্তবতা
এ বিভাগের আরো খবর/p>