বিগত সময়ে আমরা যাদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে পেয়েছি (রাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানমন্ত্রী) তাদের মধ্যে রাষ্ট্রনায়কসুলভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্র্যের অধিকারী ব্যক্তিত্বের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ফলে তাদের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের ফলে দেশ সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারেনি। এতে দেশের উন্নয়নের চেয়ে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপাট করা হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক পরিচয়ে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করা হয়েছে, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব রোর্ডের গোয়েন্দা শাখা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তারা বিভিন্ন দেশে বিগত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বিগত সরকারের আমলে সরকারি সমর্থনে যারা অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন তারা সব অর্থ বিদেশে পাচার করতে পারেননি। লুণ্ঠিত অর্থের বেশির ভাগই দেশে রয়ে গেছে। অর্থের প্রতি অন্ধলোভ কিছু মানুষকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে। তাদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য হচ্ছে টাকা কামানো, যা বৈধভাবে হোক বা অবৈধভাবে হোক। বিগত সরকার নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র পক্ষ শক্তি এবং দেশপ্রেমিক বলে প্রচার করতেন। কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক মানুষ কখনই অর্থলোভী হতে পারেন না। জাতির ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করতে পারেন না। কিন্তু সরকারের এমন একজন মন্ত্রীও পাওয়া যাবে না যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের অভিযোগ নেই।
একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক রাষ্ট্রের চেয়ে ঊর্ধ্বে কোনো কিছুকে স্থান দিতে পারেন না। কিন্তু আমাদের দেশের একশ্রেণির মানুষের মধ্যে এই চেতনাবোধ নেই বললেই চলে। তারা সব সময় রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তবে আশার কথা যে, এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে অধিকাংশ সময় এরাই দেশ শাসন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা সংকীর্ণ ব্যক্তি অথবা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের এই অন্যায় কর্ম কখনই প্রতিবাদহীনভাবে মেনে নেয়নি। বাংলাদেশের মানুষ বীরের জাতি। তারা জাতির যে কোনো সংকটে নিজের জীবন দিয়ে হলেও সংকট মোচনের চেষ্টা করেছে। এই জাতি যেমন যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থেকেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলেও গণমানুষ তাদের অধিকার ফিরে পায়নি। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষমতালিপ্সা জাতিকে বারবার বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের মানুষ আশার আলোর স্বপ্ন দেখেছিল। তারা মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ধুলোয় লোটাতে খুব একটা সময় লাগেনি। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাড়ে তিন বছরের স্বেচ্ছাচারী শাসনের কবলে পড়ে মানুষের প্রত্যাশা ভেস্তে যায়। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দেশকে নরকে পরিণত করা হয়। একপর্যায়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রক্ষমতা চিরস্থায়ী করার মানসে একদলীয় বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়। একই বছর ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। তার পর দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়। কিন্তু সেই রাস্তা মোটেও কুসুমাকীর্ণ ছিল না। আমাদের দেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিকভাবে সরকার গঠনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষের মাঝে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বণ্টনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু দীর্ঘদিনেও এই দুটি প্রত্যাশা অধরাই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মানুষ বারবার তাদের অধিকার আদায়ের জন্য চরম মূল্য দিয়েছে। স্বাধীনতার পর জাতির ঘাড়ে চেপে বসে দেশীয় স্বৈরাচার। ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচার এইচএম এরশাদের বিরুদ্ধে তিনদলীয় জোট দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। তিনদলীয় জোটের রূপরেখা মোতাবেক দেশ পরিচালিত হবে। জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। বাংলাদেশের যে ৪টি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সেগুলোই ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে অবিতর্কিত এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেসব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনোটিতেই একটি রাজনৈতিক দল পরপর দুবার সরকার গঠন করতে পারেনি। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কোনো পর্যায়েই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
তত্ত্বাবধায় সরকার পদ্ধতি যদি বাতিল করা না হতো তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত। কিন্তু ব্যক্তির খায়েশ পূরণ করতে গিয়ে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে। যদিও এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাদের আন্দোলনের কারণে অনেক জীবনহানি হয়েছিল। ক্ষমতার প্রতি অতিলোভের কারণেই সাবেক স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা গর্ব করে বলতেন, আগামী একশ বছরেও আওয়ামী লীগকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না। তাদের সেই দর্পচূর্ণ হতে এক বছরও লাগেনি। বাংলাদেশের মানুষ দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হলে অসাধ্য সাধন করতে পারে তার প্রমাণ দেখিয়েছে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো নিয়মিত সরকার নয়। অনির্বাচিত সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। দেশকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করা এবং মানবকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বেশ কিছু সংস্কার কার্যক্রম শুরু করা। যারা বিগত সরকার আমলে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন বা দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি করেছেন তাদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তির বিধান করার জন্য বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এই মুহূর্তে দেশের মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে, একটি নতুন গণতান্ত্রিক, মানবকল্যাণমূলক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য এই মুহূর্তে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত সময়সূচি মোতাবেক, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অর্থাৎ পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। তার পরও নির্বাচন নিয়ে যেটুকু অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ।
প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের আলাদা কর্মসূচি থাকে। যেসব রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে শামিল ছিল বা সমর্থন করেছে তারা সবাই চায় দেশে কার্যকর, উদার এবং কল্যাণমূলক গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হোক। এমন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক যেখানে আর কোনো স্বৈরাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যদি বাংলাদেশকে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায় তাহলে কোন্ পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে মতান্তর থাকা উচিত নয়। কেউ বলছে, নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হোক। এটাই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। আবার অন্য পক্ষ বলছে, নির্বাচন সনাতন পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠিত হোক। আমাদের মনে রাখতে হবে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার হঠাৎ করেই সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বিচার প্রক্রিয়া চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। তাই সংস্কার অসমাপ্ত রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত নয় এমন যুক্তি ধোপে টেকে না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে নির্বাচিত সরকার এসে তা বাস্তবায়ন করবে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং অপরাধীদের বিচারের অজুহাতে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা কোনোভাবেই সঙ্গত হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে, দেশ সবার ওপরে তা হলে এসব বিষয় নিয়ে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে এসব সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। দেশের স্বার্থকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
কাজেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রচলিত পদ্ধতিতেই হতে পারে। নির্বাচনে যাতে ভোটাররা প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যেতে পারে। নির্বাচনে যাতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে। কাজেই ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ ত্যাগ করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো কারণে সৃষ্ট ঐক্যে ফাটল ধরলে পরাজিত ফ্যাসিবাদ আবারও ফিরে আসতে পারে। সেই দুঃসহ কালো অধ্যায় জাতির জীবনে আবারও ফিরে আসুক নিশ্চয়ই আমরা তা চাইতে পারি না। কাজেই এই মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দলকে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে এবং দেশের স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে।
অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত