বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি

  • সম্পাদকীয়   
  • ১৮ আগস্ট, ২০২৫ ২৩:১৯

দেশের মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি, সুরক্ষণ, উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবহারে জনসচেতনতা তৈরির জন্য মৎস্য সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ‘অভয়াশ্রম গড়ে তুলি, দেশি মাছে দেশ ভরি’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে এ বছর ১৮ আগস্ট থেকে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ -২০২৫ শুরু হচ্ছে। দেশের প্রাণিজ আমিষ ও পুষ্টি চাহিদার বড় অংশ আসে মাছ থেকে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। মাছের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি উৎপাদিত মাছ নিরাপদ করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ইতোমধ্যে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্রসীমাসহ অন্য জায়গায় যারা মাছ ধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে, যাতে তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি মাছ ধরার কোনো নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে, সেটির অবস্থান জানার জন্যও এ পদ্ধতি কাজে লাগবে। উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে ভোক্তা বাড়বে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে কাজ করলে সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ, প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সরকার নানা রকম সহায়তা দিচ্ছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ।

এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ -২০২৫ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য শক্তিশালী মৎস্য খাত গড়ে তোলা। মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়া জাতকরণ ও রপ্তানির প্রক্রিয়ায় সময় উপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে মৎস্য খাত থেকে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্য নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশে ও বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করেছে। পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রপ্তানি করা হচ্ছে পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রপ্তানি হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ৪৭ দশমিক ৫৯ মেট্রিক লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই খাতের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে পরিকল্পিত অর্থায়ন দরকার। সরকারের কৃষি ঋণ, সরকারি- বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতের বিনিয়োগে মৎস্য খাতকে গুরুত দিতে হবে। মৎস্য খাতে উৎপাদন বেড়ে যাওয়াসহ অনেক সাফল্য এলেও এই খাতে এখনো প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আসেনি। চাষিরা কীভাবে ঋণ পাবেন, তা নিয়েও ধারণার যথেষ্ট অভাব আছে। যে কারণে এখনো অনেক চাষি উচ্চ সুদে দাদন বা ঋণ নেন। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে তা সামগ্রিকভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও পুষ্টি নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে। এই খাতে এতদিন যৌক্তিকভাবে বিনিয়োগ হয়নি। তবে বিদেশে রপ্তানির জন্য সরকার তিনটি মাছকে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো পাঙাশ, তেলাপিয়া ও কই মাছ। এই মাছগুলোর রং, স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, যাতে তা রপ্তানিযোগ্য করা যায়। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেভাবে ঋণ দিতে অভ্যস্ত এবং ঋণ আদায়ের যে সংস্কৃতি তা মৎস্য খাত বান্ধব নয়। তারা মনে করে, মৎস্য খাতে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংক খাতের বাইরের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওই খাতে ঋণ দিতে চায় না। তাই এই সংস্কৃতি থেকে আর্থিক খাতকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি ছাড়া অন্য মাছের রপ্তানির অভিজ্ঞতা কম। মাছের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি এর গুণগত মান বাড়াতে হবে। মিয়ানমারের মতো সমুদ্রে মাছ ধরার সব নৌযানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তর করা উচিত। সামুদ্রিক জেলেদের জন্য ‘সামুদ্রিক মৎস্য পরামর্শ কেন্দ্র’ চালু করা যায়। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে জেলেরা প্রতিদিন ‘মাছের বসতি’ সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে জেলেদের অর্থ ও সময় বাঁচবে। এ কাজে মৎস্য বিজ্ঞানীদের লাগানো যায়। আধুনিক ট্রলার বা ফ্রিজার ঘন্টায় এক টনেরও বেশি মাছ ধরতে ও প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম। ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অনেক দেশই এ প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরে প্রক্রিয়াজাত করে। উন্নত ট্রলারে থাকা-খাওয়ার সুবিধাও ভালো। এর চেয়ে বড় কথা, এগুলো অনেক নিরাপদ। ফলে এসব দেশের জেলেরা দীর্ঘদিন সমুদ্রে অবস্থান করে মাছ ধরতে পারে। মিয়ানমার ও ভারতের সমুদ্র সীমায় স্রোত ও ঢেউ বেশি থাকায় আমাদের জলসীমা থেকে তারা অনেক সময় মাছ ধরে নিয়ে যায়। সামুদ্রিক ঢেউ ও স্রোতের বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) আধুনিক জাহাজ আমদানি করে পিপিপির মাধ্যমে বা কিস্তিতে জেলেদের দিতে পারে। ডাটাবেইস করে সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রতিটি নৌকা ও মালিককে সরকারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া মৎস্য আহরণ বাড়াতে সামুদ্রিক নৌযান, ট্রলারগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে সমুদ্রের সর্বশেষ অবস্থা সব সময় জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সমুদ্র সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের ব্যাপারে বিলম্ব করার কোনো অবকাশ নেই। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকেও এগিয়ে যেতে হবে।

এক সময় এদেশ মাছের জন্য সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন আর আগের সেই অবস্থা আর নেই। আগে যেখানে পুকুর, খাল, নদী-নালা, বিল-ঝিলে মাছের আবাসস্থল ছিল, এখন সময়ের বিবর্তনে সব পাল্টে গেছে। মাছের আবাস স্থলগুলো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পুকুর, খাল, বিল ভরাট করে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণের কারণে পুকুর, খাল, বিল হারিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে নদী, নালা, বিল ঝিলে কলকারখানার দুষিত বর্জ্য এসে এসব এলাকার পানি দুষিত করে ফেলছে। জমিতে চাষাবাদের জন্য কৃষকরা বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করায় দেশীয় প্রজাতির আবাসস্থলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে আমাদের দেশে বিগত দুই দশক ধরে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বিস্তার ঘটছে না। ক্রমেই দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের জায়গায় এখন স্থান দখল করে বসেছে বিদেশি প্রজাতির হাইব্রিড মাছগুলো। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে বিদশি মাছের ব্যাপক চাষ হয়ে আসছে। এসব বিদেশি মাছের মধ্যে রয়েছে তেলাপিয়া, নাইলেটিকা, পাঙাস, থাই কৈ, আফ্রিকান মাগুর পিরানহা, ঘ্রাসকার্প, সিলভারকার্পসহ আরো কিছু প্রজাতির মাছ। এসব হাইব্রিড মাছ চাষে অধিক লাভবান হওয়ার কারণে মাছ চাষিরা ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছের চাষ করছেন। যে কারনে দেশের মানুকে বাধ্য হয়ে এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছ খেতে হচ্ছে। এসব হাইব্রিড জাতীয় মাছের স্বাদ, গন্ধ দেশি প্রজাতির মাছের মতো নয়। দেশি প্রজাতির মাছের স্বাদ, গন্ধ অতুলনীয়। এসব দেশি প্রজাতির মাছ সীমিত আকারে আবার অনেকে চাষ শুরু করেছেন। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় বিলুপ্ত প্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে দেশি পাবদা, টেংরা, পুঠি, কৈ, মাগুর, শিং, শোল, গজার, বোয়াল, আইড়, চাপিলা, খলিসা, তারাবাইন, গলদা চিংড়ি, চাঁদা, তপসে, তিন কাটা, চিতল, ফলইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এক সময় আমাদের দেশে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে ৫৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন। এর মধ্যে ১৪০ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। দেশীয় প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য মৎস্য বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশীয় মাছের অস্তিত্ব রক্ষার উদ্দেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ব্যাপক চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। মৎস্য হ্যাচারীগুলো কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে মাছের পোনা উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন চাষের ক্ষেত্র তৈরি করে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের ব্যবস্থা করতে পারে দেশের মানুষকে মাছের প্রকৃত স্বাদ গ্রহণের লক্ষ্যে দেশি প্রজাতির মাছের চাষের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের তরফ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলায় সরকারি উদ্যোগে দেশি প্রজাতির মাছের হ্যাচারী গড়ে তুলে সেখান থেকে মাছের পোনা মৎস্য চষিদের মাঝে বিতরণ করে দেশি মাছের চাষের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেশি প্রজাতির মাছের চাষের উদ্যোগ নেয়া হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশি প্রজাতির মাছ আবার তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে।

রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর