যে স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন ভূমিতে পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সে স্বপ্নের মানচিত্র থেকে ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাঙালিকে দ্বিতীয়বার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস নথিভুক্ত করতে হলো।
শেখ হাসিনার দেশে ফেরা ঠেকাতে নানা রকম অপকৌশল ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিল তৎকালীন অবৈধ সরকার। অনেক ঝুঁকি নিয়েই অবতরণ করেছিল শেখ হাসিনাকে বহনকারী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ৭০৭ বোয়িং বিমানটি।
লাখো লাখো মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়েছিল। আকাশ-বাতাসে একসঙ্গে প্রকম্পিত হলো ‘জয় বাংলা’। ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি পরা তরুণী চলছে শুভ লক্ষ্যে ক্রন্দনরত মায়ার চোখে। প্রকৃতিও একাট্টা ঘোষণা করল শেখ হাসিনার সাথে। কালবৈশাখীর প্রচণ্ড প্রকোপ আছড়ে পড়েছিল নগরে, যার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। সব বাধা উপেক্ষা করে সেদিন শেখ হাসিনা বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সারথি হয়ে।
১৭ মে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াও সেদিন মানুষের মিছিলের ঢলকে আটকাতে পারেনি। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল, ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’
সেদিন অবিনশ্বর ভাষণের ন্যায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’
সেই ইতিহাস তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে আজ অব্দি চলমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
শেখ হাসিনা নয়াদিল্লি থেকে ঢাকা রওনা হওয়ার কিছুদিন পূর্বে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইক পত্রিকার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু-তনয়া শেখ হাসিনা এক মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। ১১ মে নিউজউইকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বক্স আইটেম হিসেবে রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়।
তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালে সামরিক চক্র কর্তৃক ক্ষমতা দখলকালে নিহত পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমি নিহত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত নয়; আমি যে সরকারের মোকাবিলা করব তার শক্তিকে বাধা বলে গণ্য করছি না।’
তিনি বলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মাহাত্ম্য থেকে বঞ্চিত হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব কাজ অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য বলে আমি বিবেচনা করি, তার মধ্যে থাকবে দেশের প্রত্যেকটি মানুষের পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। নিজের কর্তব্য পালনে আমার পিতার অবদান সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। তার (বঙ্গবন্ধুর) প্রতি বাংলাদেশের জনগণের প্রীতি ও ভালোবাসা ছিল অপরিসীম।
‘আমাকে (আওয়ামী লীগের) সভানেত্রী নির্বাচিত করে পরোক্ষভাবে তাকেই সম্মান দেখানো হয়েছে। আমি তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে পারব।’ [নিউজউইক, ১১ মে ১৯৮১]
স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৫০ বছরের রাজনৈতিক সঞ্চারপথের দিকে তাকালে যে উত্থান-পতন চোখে পড়ে, বঙ্গবন্ধুর পরে তার আদলেই আমরা প্রাপ্তির হিসাব কষি।
বাংলাদেশ গত এক দশকেই প্রবেশ করেছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সূচকের নানা পর্যায়ে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক লুণ্ঠিত আবরণের ইতিহাস শেখ হাসিনার বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক দর্শনে বিলুপ্ত হয়।
বাঙালি জাতি, বাংলার মানুষ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন তার জীবনের সর্বাংশকে সংযুক্ত করেছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বর, শোষকের জন্য সোচ্চার ছিল তর্জনীর দাপট, নির্মাণ করেছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র, তার কন্যা শেখ হাসিনা, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তেমনি রচনা করেছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক উদ্ধারমন্ত্র।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম ঘৃণিত, বর্বর ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। ওই দিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ইতিহাস পায় তার কালো ক্যানভাস।
বাংলার জনপদে নিরলস পদচিহ্ন ফেলে যিনি বাঙালি জাতিসত্তাকে মুক্তির মোহনায় উপনীত করেছিলেন, জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু বাঙালির অধিকার আদায়ের কথা বলতে গিয়ে কারান্তরীণ হয়ে কাটিয়েছিলেন, যার তর্জনী হেলনে নিরস্ত্র বাঙালি হয়ে ওঠেছিল সশস্ত্র সংগ্রামী ও গেরিলা যোদ্ধা, এনেছিল স্বাধীনতার লাল সূর্য। অথচ ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত দিন হিসেবে নথিবদ্ধ হলো। একটি সদ্য স্বাধীন ও জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্রও ছিল এটি। ঘাতকের বুলেট থেকে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবিত বঙ্গবন্ধুর দুই তনয়া শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার জীবনও আবর্তিত হয়েছে ভয়াল সংকটের নাগপাশে। প্রবাসে থেকেও সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠন করেন (১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ এমপি ও আইনবিদ টমাস উইলিয়ামস ও নোবেল বিজয়ী রাজনীতিবিদ শন ম্যাকব্রাইডকে সঙ্গে নিয়ে।
পঁচাত্তর পরবর্তী সবচেয়ে সংকটবিন্দুতে সারা বাংলাদেশ যখন সামরিকতন্ত্রের অন্ধকারে বন্দি, যখন এই বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত, তখন তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সকল বাধা অতিক্রম করে শেখ হাসিনা ফিরে আসেন বাংলাদেশে।
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তার যে রাজনৈতিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল, তা কেবল কণ্টকাকীর্ণই ছিল না, সে বন্ধুর পথের পরতে পরতে বিছানো ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা ষড়যন্ত্রের জাল। মুখ থুবড়ে পড়া পররাষ্ট্রনীতি আজ শেখ হাসিনার বদৌলতে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে আদর্শ রূপে আর্বিভাব হয়েছে। কূটনৈতিক জটিলতায় বাংলাদেশ বিগ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের কারণে। বিশ্বের নামী রাজনৈতিক নেতারা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শনে মুগ্ধ।
শেখ হাসিনা নথিভুক্ত হয়েছে বিশ্বরাজনীতির ময়দানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক রাউন্ড টেবিলে। শেখ হাসিনার বদৌলতে এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সফল অগ্রযাত্রা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আজ
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি কৃষিতে উন্নতি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলে পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, ঢাকা মেট্রোরেলসহ নানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে নানা অর্থনৈতিক সূচক বৃদ্ধি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি ও পরিশ্রমের ফসল।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ছিনতাইকৃত গৌরব ফিরিয়ে দেওয়ার মহাসমরে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। পঁচাত্তরের রক্তপাতের পর দুই যুগের ভয়ংকর যে স্বদেশভূমি, তারই বিপরীতে বাঙালির রাষ্ট্রকে আজকের বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার যে সাহসী নেতৃত্ব, তার সর্বাধিনায়কের নাম শেখ হাসিনা। সামাজিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি একটি বড় রাজনৈতিক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের ইতিহাস রচনায় অবধারিতভাবেই রাজনৈতিক মঞ্চে শেখ হাসিনার আরোহনের সময়টি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিদেশের মাটিতে প্রায় ছয় বছর নির্বাসন শেষে দেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে। বঙ্গবন্ধু কন্যার সেই দেশে ফেরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনে নতুন যুগের সূচনা করে।
অথচ শেখ হাসিনার পথ মসৃণ ছিল না। নিকষ কালো আঁধার ছিল। ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নানা রাজনৈতিক বাস্তবতা ও জটিলতা তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। বারবার তাকে হত্যার অপচেষ্টা চালিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। সেই অপশক্তির আস্তিনের তলায় সেই বিভ্রান্ত, ইতিহাসবিমুখ, উচ্চাভিলাষী প্রজন্মের সামরিক ও প্রশাসনিক নানাবিধ ষড়যন্ত্রের জাল তাকে ছিন্ন করতে হয়েছিল এবং এখনও হয়।
নেতাজী সুভাষ বসুর ভাষায়, ‘বিপ্লবের পথ একেবারে ঋজুপথ নয়। এ পথে নিরবচ্ছিন্ন সাফল্য আসে না, এ পথ বহু বিঘ্নসংকুল, সুদীর্ঘ এবং সর্পিল।’
লেখক: রাজনৈতিক কর্মী এবং ছাত্রলীগের সাবেক গণযোগাযোগ ও উন্নয়নবিষয়ক উপসম্পাদক