বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গবেষণার আলো-আঁধারিতে বাংলাদেশ

  • সম্পাদকীয়   
  • ১৩ অক্টোবর, ২০২৫ ২২:৩৪

বাংলাদেশে গবেষণার গল্প শুনতে গেলে অনেকটা নদীর মতো মনে হয়। কখনো তা প্রলয়ংকরী বন্যার মতো ভেসে আসে বড় কোনো আবিষ্কারের খবর দিয়ে, আবার কখনো শুষ্ক মরুর মতো স্থবির হয়ে পড়ে—চলমান গবেষণাগুলো মাঝপথেই থেমে যায়, টেকসই হওয়ার আগেই ম্লান হয়ে যায়। আমাদের ইতিহাস প্রমাণ করে, আমরা চাইলে পারি। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার যাত্রা মূলত কৃষি গবেষণার ফল। লবণাক্ত সহনশীল কিংবা খরাপ্রতিরোধী ধানের জাত শুধু কৃষকদের জীবনই বদলায়নি, বদলে দিয়েছে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে স্থানীয় গবেষকদের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা--রোগ প্রতিরোধে টিকা তৈরি, খাবার স্যালাইন- আশা জাগিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও তরুণ গবেষকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার সিকিউরিটি কিংবা ইন্টারনেট অব থিংস নিয়ে যে উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা সীমিত হলেও আশাব্যঞ্জক। এসব অর্জন বলে দেয়—আমাদের মেধা কম নয়, তবে বড় সমস্যা হলো এই মেধাকে কাজে লাগানোর সিস্টেম দুর্বল।উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ দেখলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়। দক্ষিণ কোরিয়া একসময় যুদ্ধবিধ্বস্ত, অর্থহীন একটি দেশ ছিল। আজ তারা বিশ্বের অন্যতম প্রযুক্তি শক্তি। কারণ তারা বুঝেছিল, গবেষণা কেবল বই বা ল্যাবরেটরির মধ্যে বন্দি রাখলে হবে না; গবেষণাকে শিল্পে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় নীতিতে রূপান্তর করতে হবে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান একসাথে কাজ করে, সরকারের পরিকল্পনা তাদের সহযোগিতা করে, আর গবেষণার প্রতিটি সাফল্য বাজারে পণ্য হয়ে মানুষের জীবনে প্রবেশ করে। আবার জাপান দেখিয়েছে, গবেষণাকে ব্যবহার করে কীভাবে একটি সুপার-এজড সমাজেও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। সেখানে রোবটিক্স ও এআইভিত্তিক গবেষণাকে স্বাস্থ্যসেবা, প্রবীণ সহায়তা এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজে লাগানো হচ্ছে। জার্মানি নবায়নযোগ্য জ্বালানির গবেষণায় রাষ্ট্রীয় কৌশল নিয়েছে, আর ফিনল্যান্ড শিক্ষা খাতে গবেষণার ফল প্রয়োগ করে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিও বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার ল্যাব থেকে উঠে আসা এক বিশাল গল্প, যা আজ গোটা বিশ্বের প্রযুক্তির ধারা নির্ধারণ করছে।কিন্তু বাংলাদেশে গবেষণার পথ অনেকটাই খণ্ডিত। এখানে গবেষণা হয়, তবে বেশিরভাগ সময় তা কাগজে কিংবা প্রোফাইলেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। শিল্প খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দূরত্ব কমে না। গার্মেন্টস শিল্প, যা দেশের অর্থনীতির প্রাণ, এখনো গবেষণার ফসল ব্যবহার করে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে পারছে না! টেক্সটাইল বা পরিবেশবান্ধব উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রে যৌথ গবেষণা থাকলে হয়তো আমাদের গার্মেন্টস খাত আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠত। সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলো অনেক সময় ভালো কাজ করে, কিন্তু রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের পরিবর্তনে বা বাজেটের ঘাটতিতে গবেষণাগুলো অকালেই থেমে যায়।সমস্যার আরেকটি জায়গা অর্থায়ন। উন্নত দেশগুলোতে গবেষণার জন্য স্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি তহবিল থাকে। একটি গবেষণা শুরু হলে তা শেষ হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে, এবং সেই ফল ব্যবহারযোগ্য করার সুযোগও থাকে। আমাদের দেশে বরাদ্দ সীমিত, অনেক সময় অনিয়মিত। কোনো প্রকল্প শুরু হলো, দুই বছর পর বাজেট বন্ধ হয়ে গেল, তারপর গবেষণা ফাইলের ধুলোয় হারিয়ে গেল—এটাই আমাদের বাস্তবতা।এছাড়া গবেষণাকে প্রমোশন বা পদোন্নতির শর্তে পরিণত করাও আরেকটি সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে গবেষণার মান নির্ধারণ হয় সংখ্যার ভিত্তিতে, গুণের নয়। ফলে অনেক সময় প্রবন্ধ প্রকাশ পায়, কিন্তু তা সমাজে কোনো বাস্তব প্রয়োগ খুঁজে পায় না। অথচ যদি মানদণ্ডে বাস্তব প্রয়োগ, উদ্ভাবনের মাত্রা এবং সামাজিক প্রভাবকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে গবেষকরা সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে আগ্রহী হবেন। আরেকটি দিক হলো গবেষকদের মর্যাদা। উন্নত দেশে গবেষক মানে জাতির সম্পদ। তাদের কাজকে সম্মান, মর্যাদা ও প্রণোদনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে গবেষকরা প্রাপ্য সম্মান অনেক সময় পান না। ফলে তরুণ প্রজন্মের মেধাবীরা গবেষণায় আগ্রহ হারায়, কিংবা যারা আগ্রহী, তারা সুযোগ না পেয়ে বিদেশে চলে যায়। দেশে গবেষণার অবকাঠামো থাকলে, সামাজিক স্বীকৃতি ও আর্থিক প্রণোদনা থাকলে, হয়তো অনেকেই দেশের জন্য থেকে যেতেন।তবু আশা হারানোর কারণ নেই। কৃষি গবেষণা আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে গবেষণার ফল সরাসরি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলে। তথ্যপ্রযুক্তিতে তরুণদের স্টার্টআপ, স্বাস্থ্য খাতে স্থানীয় টিকা উদ্ভাবনের প্রচেষ্টা, কিংবা নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষুদ্র গবেষণা—সবই আমাদের পথ দেখাচ্ছে। এখন দরকার এগুলোকে ছিটেফোঁটা সাফল্য থেকে একটি সুসংগঠিত কাঠামোয় রূপান্তর করা। তথ্যপ্রযুক্তি খাতেই দেখুন—এআই দিয়ে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে, ইন্টারনেট অব থিংস দিয়ে স্মার্ট সিটি গড়ে তোলা সম্ভব, সাইবার নিরাপত্তা গবেষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো রক্ষা করা যায়। আমাদের তরুণ গবেষকরা এই ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করছেন, কিন্তু তারা যদি সরকারের দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা ও শিল্পখাতের অংশীদারিত্ব পান, তবে বাংলাদেশের গবেষণাও বিশ্বমঞ্চে স্থান করে নিতে পারবে।এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। গবেষণায় অর্থায়নকে ব্যয়ের খাত নয়, বিনিয়োগের খাত হিসেবে দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা ল্যাব শিল্প খাতের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। গবেষণা মূল্যায়নের মানদণ্ডে কেবল সংখ্যা নয়, বরং সামাজিক প্রভাবকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর গবেষকদের মর্যাদা বাড়াতে হবে—তাদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, পাশাপাশি নীতি নির্ধারণে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে গবেষণার গল্প তাই সম্পূর্ণ ব্যর্থতার নয়। আমাদের রয়েছে আলোর রেখা, রয়েছে ছায়াও। আলোর দিক হলো মানুষের মেধা, সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনা। ছায়ার দিক হলো সিস্টেমের দুর্বলতা, নীতি নির্ধারণের সীমাবদ্ধতা ও অর্থায়নের অভাব। যদি আমরা সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারি, তবে গবেষণা হবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মূল চালিকাশক্তি।গবেষণা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের হাতিয়ার। যে জাতি গবেষণাকে অগ্রাধিকার দেয়, তারাই ইতিহাস বদলায়। আমাদেরও সময় এসেছে গবেষণাকে আনুষ্ঠানিকতা থেকে মুক্ত করে জীবনের অংশ করে তোলার। বাংলাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটি ল্যাব, প্রতিটি গবেষকের স্বপ্ন যদি রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে মিলে যায়, তবে একদিন আমরা গর্ব করে বলতে পারব—আমাদের গবেষণা শুধু কাগজে নয়, মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে।

লেখক: প্রফেসর ড. ইকবাল আহমেদ : কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

এ বিভাগের আরো খবর