বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কৃচ্ছ্রসাধন হবে কীভাবে

  • দীপংকর গৌতম   
  • ২৮ মে, ২০২২ ১৬:০৩

আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম এখন বাড়লে এই দামের এলসি করা পণ্য দেশে আসতে আরও তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। কিন্তু বিক্রেতারা তো আকাশের দিকে তাকিয়ে দাম বাড়ায়, যার কোনো ভিত্তি নেই। সেটার সুরাহা হবে কীসে? এমনকি তদারকি সংস্থা এ বিষয়টি সামনে রেখে কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায়ও আনেনি। ফলে বিক্রেতারা কারসাজি করতে সাহস পাচ্ছে।

বাজারে স্থিতিশীলতা নেই। বাজারে যাওয়ার আগে কোন জিনিসের দাম কত তা ঠিক করে বসানো যাবে না। আমরা শৈশবে দেখেছি আমাদের বাবা-কাকারা আমাদের মা-কাকিদের কাছে কী আছে, কী নেই সব শুনে তালিকা তৈরি করতেন। কারণ তখন বাজার এত হাতের কাছে ছিল না। তাই হাটবারে গিয়ে এক সপ্তাহের বাজার করে আসত। তালিকা করার সময় গুণে গুণে হিসাব করত কী আছে কী নেই। দাম তাদের মুখস্থ ছিল। তাই পণ্যের সামনে দাম বসিয়ে হয় টাকা অথবা ওই পরিমাণ মূল্যের সবজি বা পাট (তখনকার স্বর্ণসূত্র) নিয়ে বাজারে বিক্রি করে সপ্তাহের সাত-সদাই কিনে আনত। এখন আর সেদিন নেই। বাজারে কবে কোন জিনিসের মূল্য কত হবে সেটা বাজারে না গিয়ে বলার উপায় নেই।

করোনায় অর্থনীতির ক্ষত শুকিয়ে উঠতে না উঠতেই রমজানকে সামনে রেখে দ্রব্যমূল্যের বাজার চড়া হতে শুরু করল। সরকার বলেছিল, বাজারে কেউ বেশি দাম রাখতে পারবে না, টাস্কফোর্স নিয়োগ করা হবে। চল্লিশটি পণ্যের দাম বেঁধে দেয়া হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সেকথা শোনেনি। রোজা রেখে মানুষ সাধ্যাতীত দামে পণ্য কিনেছে। অর্থাৎ সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বরং সারা বিশ্বের সয়াবিন মূল্য টপকিয়ে একদিনে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে জনগণের কথা না ভেবেই। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ছে সেই এক বুলি দিয়ে সয়াবিনের অতিরিক্ত মূল্যকে জায়েজ করা হলেও দেখা গেল বাজারে সয়াবিন নেই। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সয়াবিনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দেশের মানুষকে জিম্মি করেছে। সরকার পরে মজুত তেল বের করল।

বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, তিনি ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ভুল করেছেন। কিন্তু তারপরও তেলের বাজার অস্থিতিশীলই রইল। ভুলের মাশুল কীভাবে পূরণ হলো আমরা বুঝলাম না। বাজারে এখন এমন কোনো পণ্য পাওয়া যাবে না, যার দাম স্থিতিশীল বা কমেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে কোনো না কোনো পণ্যের দাম। এর মধ্যে আমদানি করা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। চাল থেকে শুরু করে ডাল, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, মসলা পণ্য, মাছ-মাংস, ডিম, শিশুখাদ্যের মধ্যে গুঁড়া দুধ, চিনি এমনকি লবণের দামও বেড়েছে।

পাশাপাশি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য সব ধরনের পণ্যের দামে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। পরিস্থিতি এমন- সপ্তাহ ও মাসের ব্যবধানে এই তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। ফলে পণ্য কিনতে ভোক্তার অবস্থা নাভিশ্বাস। এতে বেশি ভোগান্তিতে আছে নিম্ন আয়ের ও খেটে খাওয়া মানুষ। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে এক শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়েছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বাড়ছে। সারা বিশ্বের মতো দেশের বাজারেও প্রভাব পড়ছে, এটাই স্বাভাবিক। এসব কথা বলেন আমাদের বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন জাগে বিশ্ববাজার থেকে যেসব পণ্য আনা হয় তার নয় দাম বাড়ল। কিন্তু তবে যেসব পণ্য দেশে উৎপাদন হয়, তার দাম কেন বাড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে? আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম এখন বাড়লে এই দামের এলসি করা পণ্য দেশে আসতে আরও তিন থেকে চার মাস সময় লাগে। কিন্তু বিক্রেতারা তো আকাশের দিকে তাকিয়ে দাম বাড়ায়, যার কোনো ভিত্তি নেই। সেটার সুরাহা হবে কীসে?

এমনকি তদারকি সংস্থা এ বিষয়টি সামনে রেখে কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায়ও আনেনি। ফলে বিক্রেতারা কারসাজি করতে সাহস পাচ্ছে। তাই বাজার তদারকি আরও জোরদার না করায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আমাদের সবজিতে, চালে বিশ্ববাজারের কত প্রভাব পড়েছে? দাম কি সে অনুপাতে আছে? বাজারের দাম কমাতে আইন প্রযোগ করার কোনো লক্ষণ নেই। ১ হাজার লিটার তেল মজুত করার শাস্তি যদি হয় একলাখ টাকা তাহলে মজুতদারি বন্ধ হবে কি?

বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে পণ্য নিয়ে কারসাজি রোধে বাজার তদারকি জোরদার করা হয়েছে। এবার অসাধু পন্থায় পণ্যের দাম বাড়ালে জরিমানার সঙ্গে জেলে দেয়া হবে। জেলে কি আসলেই দেয়া হবে না এ শুধু কথার কথা এ নিয়ে ভিন্ন ভাবনা আছে।

দুই.

সম্প্রতি গোপালগঞ্জ গিয়েছিলাম। গোপালগঞ্জ যেতে ফরিদপুর অতিক্রম করলেই চোখে পড়ে রাস্তার দুপাশে পাকা ধান সোনালি বরন হয়ে আছে। চোখ জুড়ানো মন ভুলানো সে দৃশ্য। গোপালগঞ্জ থেকে কোটালীপাড়া যাওয়ার পথে চোখে দৃশ্যমান হলো বিলভরা ধান। কিন্তু কাটার লোক নেই। মাঝে মধ্যে ২/৪ জন কৃষকের দেখা মেলে যারা ধান কেটে নিজে ও ছোট বাচ্চাদেরে দিয়ে ধান বাড়িতে নেয়ার চেষ্টা করছে। কথা বলে জানা গেল এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। বিঘা প্রতি ৫০/৬০ মণ ধান হয়েছে। প্রতি বিঘার ধান কাটতে ১০ হাজার টাকা বললেও কেউ কাটতে আসছে না। আগের মতো দক্ষিণাঞ্চল থেকেও ধান কাটতে কেউ আসে না। কারণ সড়ক উন্নয়ন ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। ধান কেটে যে টাকা পাওয়া যায়, তার চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশায় আয় বেশি। ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেল, তারা কৃষির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

আগে সব ফসল ফলালেও দাম পেত না। ফলে ফসল চাষ করতে গিয়ে একদিকে এনজিওর লোন নিতে হতো। আর সেই কিস্তি শোধ করতে মহাজনের কাছ থেকে সুদও আনতে হতো। তারা পড়তো শাখের করাতের মধ্যে। কৃষিঋণ কৃষকের হাতে সরাসরি দেয় না। দালাল লাগে। দালাল ও ব্যাংকে টাকা দিয়ে ঋণের সমুদয় টাকা আর ঘরে যায় না। কিন্তু সুদ ৫ হাজারের। সবদিকে সংকট। এরপর পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়। ঋণখেলাপিদের বাঁধে না বাঁধে কৃষকদের। তাছাড়া অন্যের জমিতে কাজ করলে কিছু বাজে কথা শুনতেই হতো। মন খারাপ হতো। সঠিক মজুরি পাওয়া যেত না। এখন গাড়ি চালাই, সম্মান আছে সুখও আছে।

কৃষকই জানে ফসল ফলানোর নিয়ম। তাই কৃষকদের সমিতি করে ছোট কোনো পরিবহন কিনে দিলে এরা বাজারজাত করলে সঠিক মূল্য পেলে কৃষি আবার প্রাণ ফিরে পেতে পারে। এমনটা হলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার অর্জনটা রক্ষা পাবে। যে দেশে ধান ছিটালে ফসল ফলে থাকে সেদেশে খাদ্য আমদানির কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না।

শুধু কৃষি খাতের দিকে নজর দিলে এবং এখনও যে প্রজন্ম কৃষিকাজ জানে তাদের কাজে লাগালে ফসল ফলবে। আবার দেশ হবে প্রকৃত অর্থে কৃষিপ্রধান। কৃষক তার ফসল নিজে বাজারে নিলে বাজার অস্থিতিশীল হবে না। বাকিটা সামলাতে সরকারের বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে জোরদার করতে হবে। সবাই দেশপ্রেম মাথায় নিয়ে কাজ করলে আমাদের দেশে সার্বিকভাবে সংকট হওয়ার কথা নয়।

এখন চলছে বোরো মৌসুম। এসময়ে চালের দাম বাড়ার কথা না। কিন্তু কিছু মিল থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে। আবার বড় কিছু কোম্পানিও ধান মজুত করছে। যে কারণে ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। একই সঙ্গে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাড়ছে না শুধু আয়। চাল-ডাল, তেল, মাছ-মাংস সব পণ্যের দাম বাড়তি। সাবান-ডিটারজেন্টসহ নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম বাড়ছেই। এই বাড়তি মূল্য কেন? কারা বাড়ায় এই দাম। সাধারণ মানুষ সবই জানা ও বোঝার কথা। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমিক তৈরি না হলে এই সংকট নিরসন সম্ভব না।

তিন.

গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেক জায়গায় এখন মানুষের একবেলা খেতেই কষ্ট হচ্ছে এবং সারা বিশ্বেই এই অবস্থা বিরাজমান। তারপরও তার সরকার এ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হলেও আমদানিনির্ভর এসব পণ্যের প্রভাব তো অর্থনীতিতে পড়বেই। কারণ উৎপাদন যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি শিপমেন্ট ব্যয় বেড়ে গেছে। যে কারণে দেশের ভেতর একটু মূল্যস্ফীতি বা জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে।

এই প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবাইকে এটুকু অনুরোধ করব যদি একটু সাশ্রয়ী হন, মিতব্যয়ী হন বা সব ব্যবহারে যদি একটু সতর্ক হন তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’ কিন্তু কথা হলো আমাদের দেশের যে শ্রেণিটা হঠাৎ করে বিত্তবান হয়ে গেছে, পিকে হালদার, ডেসটিনির রফিকুল আমিনদের গোত্রের লোক বা সিন্ডিকেটের লোকজন ছাড়া এখন কারো এমন সাধ্য নেই যে অমিতব্যয়ী হবে। বরং এই মুহূর্তে ট্রাক সেল বন্ধের সিদ্ধান্ত তুলে নেয়া হলে বাজার যেভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাচ্ছে তাতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বলতে কিছু থাকবে না। পক্ষান্তরে মধ্যবিত্তরাই দেশের প্রাণ, দেশের শিল্প-সংস্কৃতির আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। করোনায়ও এরা প্রণোদনা পায়নি। বঞ্চনায় এই শ্রেণিটি ধুঁকছে। সব কিছু ভেবে ব্যবস্থা নিলে আমাদের সংকট নিরসনযোগ্য বলে মনে হয়।

লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

এ বিভাগের আরো খবর