আজ ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ দিবস। এদেশের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়, যা আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের গতিপথে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বঙ্গভঙ্গের ঘটনাপ্রবাহই ছিল এক দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা, যার পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।১৮৭০ থেকে ১৮৮০-এর দশকে বাংলা প্রেসিডেন্সি ছিল প্রশাসনিকভাবে একটি বিশাল প্রদেশ, যার কেন্দ্র ছিল কলকাতা। সমগ্র প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গনির্ভর ছিল। পূর্ববঙ্গ ছিল যোগাযোগ, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ। ব্রিটিশ শাসকরা দাবি করতেন— প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক বিভাগ অপরিহার্য।এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার এক নতুন প্রশাসনিক পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যাতে ঢাকা ও ময়মনসিংহকে আসাম ও চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু এ প্রস্তাবকে পূর্ববঙ্গের নেতৃবৃন্দ জনগণের কল্যাণবিরোধী বলে মনে করেন। তারা বিকল্প প্রস্তাবে আসাম, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং যশোর-খুলনা অঞ্চলকে একত্র করে নতুন প্রদেশ গঠনের দাবি জানান, যার রাজধানী হবে ঢাকা।
১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে আহসান মঞ্জিলে অবস্থানকালে বঙ্গ বিভাগের প্রস্তাব নিয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। তাদের পরামর্শে পরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন আসে, যাতে নতুন প্রদেশটি পূর্ববঙ্গের মানুষের স্বার্থের অনুকূলে হয়।অবশেষে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ভাইসরয় লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। বাংলা প্রদেশকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়— ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ এবং ‘পশ্চিমবঙ্গ’। প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাত থাকলেও প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদের ‘Divide and Rule’— বিভাজন ও শাসনের নীতি। পূর্বাঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, পশ্চিমে হিন্দুরা— এই ধর্মভিত্তিক বিভাজনই ভবিষ্যৎ ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে।
বঙ্গভঙ্গের ফলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজে প্রবল উদ্বেগ দেখা দেয়। তারা আশঙ্কা করেছিল— বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্য বিনষ্ট হবে এবং কলকাতাকেন্দ্রিক প্রভাব হ্রাস পাবে। অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা মনে করেছিল— শিক্ষা, প্রশাসন ও বাণিজ্যে তারা নতুন সুযোগ পাবে। এই দ্বিমুখী প্রতিক্রিয়াই হিন্দু-মুসলমান বিভেদের ভিত্তি রচনা করে।পশ্চিমবঙ্গের নেতৃবৃন্দ বঙ্গভঙ্গকে ‘বঙ্গমাতার দ্বিখণ্ডন’ বলে আখ্যায়িত করে গণআন্দোলনে নেমে পড়েন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, বাল গঙ্গাধর তিলক ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতা বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। প্রতিবাদে সংগঠিত হয় বয়কট, স্বদেশী ও স্বরাজ আন্দোলন। অপরদিকে, উপমহাদেশের মুসলমানরা উপলব্ধি করেন— তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন গঠন প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হয়।
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর নবগঠিত প্রদেশটির আয়তন ছিল ১,০৬,৫৪০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি দশ লক্ষ। রাজধানী ঢাকা দ্রুত নতুন প্রশাসনিক, শিক্ষা ও বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। কার্জন হল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পুরনো হাইকোর্ট ভবন, বাংলা একাডেমি— এসব স্থাপনা বঙ্গ বিভাগের ফলশ্রুতিই ছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে নতুন সুযোগ পায়, ফলে এ অঞ্চলে নবজাগরণের সূচনা ঘটে।তবে রাজনৈতিক দিক থেকে বঙ্গভঙ্গ ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে দৃঢ় করে। অনেকে মনে করেন, ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালের এই বিভাজন এবং ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কারের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী চালু করে কংগ্রেসে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নষ্ট করতে চেয়েছিল। এভাবেই তারা হিন্দু-মুসলমান বিরোধ স্থায়ী করে নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখার কৌশল গ্রহণ করে।
জনমতের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। দিল্লির রাজসভায় সম্রাট জর্জ পঞ্চম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন— পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ পুনরায় একত্রিত হবে এবং ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে নয়া দিল্লিতে স্থানান্তরিত হবে। বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে ঐক্য ফিরলেও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক বিভাজন তখনও গভীর থেকে গভীরতর হয়ে ওঠে।
বঙ্গভঙ্গ ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর ফলে বাঙালি সমাজে রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ঘটে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের ভেতর থেকেই সন্ত্রাসবাদী ও স্বদেশী আন্দোলনের উত্থান হয়। একইসঙ্গে মুসলমান সমাজেও জন্ম নেয় স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পরিচয়ের বোধ, যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত রচনা করে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় বাংলা পুনরায় বিভক্ত হয়— এবার ধর্মভিত্তিকভাবে। পশ্চিমবঙ্গ ভারত অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়, আর পূর্ববঙ্গ হয় পাকিস্তানের পূর্বাংশ, ‘ইস্ট পাকিস্তান’। এই বিভাজনে অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যুত ও নিপীড়িত হয়; ধর্মীয় সংঘাত ও সহিংসতা সমাজকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা ও সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন নতুন অসন্তোষ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রীয়ভাবে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার চেষ্টা বাঙালি জাতিসত্তাকে আঘাত করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন জন্ম নেয়, যা বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ভিত্তি গড়ে দেয়।
ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে জাতীয় চেতনার বীজ রোপিত হয়, তা পরবর্তী দুই দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, পশ্চিম পাকিস্তানের অস্বীকৃতি এবং সামরিক দমন-পীড়ন শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটায়।অবশেষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা এবং নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে— যা বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস থেকে শুরু হওয়া জাতীয় আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত প্রকাশ।
বঙ্গভঙ্গ শুধু বিভাজনের ইতিহাস নয়; এটি বাঙালির আত্মসচেতনতা, প্রতিরোধ ও পুনর্জাগরণের ইতিহাসও বটে। ১৯০৫ সালের সেই বিভাজন যেমন জাতিকে বিভক্ত করেছিল, তেমনি সেটিই দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের একত্রীকরণের প্রেরণাও হয়ে উঠেছিল। আজকের বাংলাদেশ সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতারই ফল— একটি জাতি, যার ভিত্তি ভাষা, চেতনা ও সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য ঐক্যে দৃঢ়ভাবে বঙ্গভঙ্গ থেকে বাংলাদেশ।
লেখক: গবেষক ও প্রবন্ধকার।