দেশে দিনে দিনে বাড়ছে খাদ্যসামগ্রীর দাম। সয়াবিন তেল এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়লেও লাগাম টেনে ধরতে পারেনি সরকার। নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও অধিক দামে কিনতে হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি। এরই মধ্যে বেড়েছে চাল, আটাসহ অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর দাম। শুধু কি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে? আসলে অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়েছে সমান তালে। যেমন আগে যেখানে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ১০০ বা ১২০ টাকায় যেত এখন সেখানে গুণতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।
একইভাবে ২০ টাকার রিকশা ভাড়া ৩০ টাকায় ঠেকেছে। মূল্যবৃদ্ধির এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় মূলত জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর। এরপর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ মূল্যবৃদ্ধির এই গতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির এই দৌড় খুব সহজেই থামছে না। জীবন বাঁচানোর ওষুধপত্র ও মেডিক্যাল সামগ্রীরও দাম বেড়েছে। এই অস্থিতিশীল অবস্থা কি শুধু বাংলাদেশে?
পৃথিবীজুড়েই এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। খোদ আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে গত মার্চে ছিল ৮.৫ শতাংশ। এপ্রিলে একটু হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৮.৩ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে এই হার এখনও কম। মার্চে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬.২২ শতাংশ। যদিও এটা ১৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। অবশ্য বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এই হিসাব বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে দাবি করেছেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
গত ১৬ মে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।’ আর পাকিস্তানে গত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৩.২২ শতাংশ। অবশ্য এটা হ্রাস পেয়ে গত এপ্রিলে দাঁড়ায় ১২.৭ শতাংশ।
রয়টার্সের জরিপ অনুযায়ী এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ ভারতে এই হার গত এপ্রিলে ছিল ৭.৫ শতাংশ; মার্চে ছিল তা ৬.৯৫ শতাংশ। আর্জেন্টিনায় অস্বাভাবিক হারে মূল্যস্ফীতির কারণে চলছে বিক্ষোভ। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের আরও অনেক দেশে পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বিক্ষোভ চলছে। ইউরোপে গত ২৩ বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি। আড়াই কোটিরও কম জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কায় সরকার পতন হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতার কথা জানিয়ে তারা দেউলিয়া ঘোষণা করেছে নিজেদের।
আশঙ্কার বিষয় হলো- বৈশ্বিক ঝুঁকি ও কৌশলগত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলক্রাফট ১৩২টি দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে গত ১১ মে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে আগামী ৬ মাসের নাগরিক অস্থিরতা সূচক (সিভিল আনরেস্ট ইনডেক্স) প্রকাশ করে। রিপোর্টে তারা বলেছে, জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের সব দেশেই চাপ বাড়ছে। কিন্তু সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে মধ্য আয়ের দেশগুলো।
এরমধ্যে চরম ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই নিম্নমধ্যম বা উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ। রিপোর্টে শ্রীলঙ্কা ও কাজাখস্তানের পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ম্যাপলক্রাফট বলেছে, এ বছর এ রকম ঝুঁকির শঙ্কায় থাকা ১০টি দেশ আলাদাভাবে নজরে থাকছে। এই ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও আছে। অন্য দেশগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মিসর, তিউনিসিয়া, লেবানন, সেনেগাল, কেনিয়া, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিশ্বব্যাপী খারাপ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে গত ১৭ মে এনইসি সভায় বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার আছে বলে আমরা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি। যদি অন্য কেউ ক্ষমতায় থাকত এতদিনে রাস্তায় রাস্তায় মারামারি লেগে যেত। কিন্তু সেটা হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার সেই জায়গা থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে পেরেছে।’
একই সঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা এবং বিশ্ব একটি দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। টাকা খরচের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। অহেতুক সম্পদের ব্যয় না করি। যদি খুব ভালোভাবে হিসাব করে চলতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না; এটা আমি বিশ্বাস করি।’
প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। কিন্তু একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে। বিগত দিনের সংকটকালের প্রধান সমস্যাগুলো যেন নতুন করে সৃষ্টি হতে না পারে। ১৯৭৩ সালে বগুড়ায় ভাষণে দেয়া বঙ্গবন্ধুর একটি বিশেষ উক্তি- ‘চোরের দল বাংলার মাটিতে খতম না হলে কিছুই করা যাবে না। আমি যা আনব এই চোরের দল খায়ে শেষ করে দেবে। এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে।’
ভুলে গেলে চলবে না। চোরবাটপার, মজুতদার, পাচারকারিদের এবং প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ, অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দলের মধ্যে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দুর্নীতির টাকায় প্রভাব বিস্তার করা ছদ্মবেশী রাজনীতিবিদের শক্ত হাতে দমন করতে না পারলে অবস্থা ভয়াবহ হতে বাধ্য।
আমাদের প্রত্যাশা কৃষিখাতকে সরকার আরও বেশি গুরুত্ব দিবে। যদিও বাংলাদেশ ধান, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে তৃতীয়। একই সঙ্গে আলু উৎপাদনে আমরা ষষ্ঠ। আত্মতৃপ্তির ঢেকুর না তুলে শস্য উৎপাদন বাড়াতে আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনোভাবেই যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয়, সেদিকে কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে খাদ্যসামগ্রী পাওয়া যাবে না এই হিসেবে সংকটকালীন বিকল্প পরিকল্পনা থাকলে সমস্যা ভালোভাবেই সামাল দেয়া যাবে।
শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশের অবস্থা না হওয়ায় আরও অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় প্রতিমাসেই বাড়ছে। প্রবাসী আয়ের গতিও প্রত্যাশার কাছাকাছি। বিদেশি বিনিয়োগেও অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়নি। এ বছর ফসল উৎপাদনেও ঘাটতি নেই। রিজার্ভও বেশ ভালো। তবে করোনাকালীন আমদানি ব্যয় পরিশোধ অনেকটা বাকি থাকায় তা এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তাই স্বাভাবিকের তুলনায় দেশে ডলারের রিজার্ভে কিছুটা চাপ পড়েছে। তবে এটা সাময়িক। একই সঙ্গে আবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া আমদানিতে কড়াকড়ির পরিকল্পনা এবং কিছু পণ্য আমদানি সরকার বন্ধ করে দেয়ায় বাণিজ্যঘাটতিও অনেকটা কমে আসার প্রত্যাশা রয়েছে। পণ্যমূল্যের দাম বাড়লেও খেটে খাওয়া দিনমজুরদেরও পারিশ্রমিক অনেকটা বেড়েছে।
এখানে অন্য একটি প্রসঙ্গ না বললেই নয়। শ্রীলঙ্কা যেভাবে ঋণের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ তার আশেপাশেও নেই। গত অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট ঋণ জিডিপির ৩৮ শতাংশ ছিল। এর ৩৭ শতাংশ বিদেশি ঋণ। বাংলাদেশের মোট দেনার পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২৯৭ হাজার কোটি টাকা। এটা জিডিপির মাত্র ১৩ শতাংশ।
আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী এই হার ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। ২ কোটি ২০ লাখের মতো জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কায় আইএমএফের তথ্যানুযায়ী ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের কথা। তাদের মোট ঋণ জিডিপির ১১৯ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণ পরিষেবা খাতে বরাদ্দ মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ বা ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এই খাতে শ্রীলঙ্কার বরাদ্দ বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশ।
একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার- বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের ঋণ পরিশোধ নিয়ে একটি কথা সাধারণের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করেছে। আসলে এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা আরও প্রায় পাঁচ বছর পরে। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী ২০২৭ সালের মার্চে। পরিমাণটা হবে ৫৫৬ মিলিয়ন ডলার। তাই এখনই আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার মতো কিছু নেই।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক