বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পরিবারতন্ত্রের ফল আজকের শ্রীলঙ্কা

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ১৯ মে, ২০২২ ১৭:০৭

শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিণতি শুধুই কি অর্থব্যবস্থাকে সামলাতে না পারার ফল? না, এ শুধু অর্থনৈতিক ব্যর্থতা নয়। শ্রীলঙ্কার রাজাপাক্ষে পরিবার— যে পরিবারের এক ভাই দেশের প্রেসিডেন্ট, অন্য ভাই প্রধানমন্ত্রী, আরও দু’ভাই এবং ছেলেমেয়েদের অধীনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব দপ্তর, সব মিলিয়ে দেশের বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে যে পরিবারটি— যে ভঙ্গিতে দেশ চালিয়েছে, এটা তার প্রতিফলন। অন্য কারো মতের তোয়াক্কা না করে, কেবল নিজেদের স্বার্থের কথাটুকু ভেবে।

অপরিণামদর্শী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, ক্ষমতাসীনদের স্বেচ্ছাচারিতা ও পরিবারতন্ত্রকে প্রাধান্য দেয়া, দেশের মধ্যে মৌলবাদী গোষ্ঠীকে দমন করতে না পারা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্যাঁচ, বৈশ্বিক মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইত্যাদি নানা কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এখন চরম সংকটে। সেখানে এখন হিংসার আগুনে রাজনীতিবিদদের বাড়িঘর জ্বলছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে দেশশাসন করেছেন, তারা এখন বিক্ষুব্ধ জনতার হিংস্রতার শিকার হচ্ছেন। জান নিয়ে পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।

সেনাবাহিনী ও পুলিশ অলিখিতভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষোভের আগুন তাতে কমছে না। দেশজুড়ে বিক্ষোভ আর হাহাকার চলছে। দিনের অর্ধেক সময় লোডশেডিং, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, পেট্রল পাম্পে তেল নেই, রান্নার গ্যাস নেই। তুমুল মূল্যস্ফীতি। আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণের পরিমাণ বিপুল— তা শোধ দেয়ার সামর্থ্য নেই। দেশের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার তলানিতে ঠেকেছে।

ব্যাপক ক্ষোভের মুখে ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন মাহিন্দা রাজাপাক্ষে। এরপর মাহিন্দার সমর্থকেরা অস্ত্র নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে পথে নামেন। শুরু হয় সংঘর্ষ। মানুষ গর্জে ওঠে। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন।

বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন লাগিয়ে দেয় রাজাপাক্ষের পূর্বপুরুষের বাড়ি এবং দেশের আরও বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের বাড়িতে। দেশজুড়ে কারফিউ জারি করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহে। যদিও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা এখনও অনড়।

কয়েক বছর আগেও যে দেশের মনব-উন্নয়ন সূচকের উদাহরণ দেওয়া হতো, তার এমন অবস্থা কী করে হলো? খানিকটা ভাগ্যের মার, অস্বীকার করার উপায় নেই। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একটা বড় দিক হলো পর্যটন শিল্প। কোভিডের ধাক্কায় তার অবস্থা ভয়াবহ।

অপরদিকে রয়েছে নীতিনির্ধারকদের অপরিণামদর্শিতা। ঋণ করে দেশ চালানোর অভ্যাস করে ফেলেছিলেন সে দেশের শাসকরা। তা-ও চড়া সুদে স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ। এদিকে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধিতে মন দেয়নি সরকার, অর্থব্যবস্থার রাশ ছেড়ে রেখেছিল শাসকদের ঘনিষ্ঠ কিছু সাঙ্গাতের হাতে। ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিপুল ধার, তার উপর নিরাপত্তার অভাব— সব মিলিয়ে দেশের ক্রেডিট রেটিং কমেছে। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাণিজ্যিক ধার পাওয়ার পথও বন্ধ হয়েছে ক্রমে। এদিকে, নতুন নোট ছাপিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টায় আরও দ্রুত গতিতে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।

২০১৯-এর শেষপর্বে শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯৪ শতাংশ। ২০২১-এর শেষপর্বে তা ১১৯ শতাংশে পৌঁছায়। ফলে বিদেশি ঋণ পাওয়ার পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। জানুয়ারির গোড়াতেই সে দেশে মূল্যবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ ছুঁয়ে রেকর্ড গড়ে। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষপর্বে তলানিতে ঠেকেছিল বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার। প্রাক অতিমারি পরিস্থিতির তুলনায় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় কমে যায় প্রায় ৭৫ শতাংশ।

চলতি বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ঋণ এবং সুদ মেটাতে অন্তত ৬৯০ কোটি ডলার (প্রায় ৫২,৪০০ কোটি টাকা) ব্যয় করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। অথচ সরকারি তথ্য বলছে, বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় মাত্র ২৩১ কোটি ডলারে (প্রায় ১৭,৫৪০ কোটি টাকা) এসে ঠেকেছে। বিদেশি মুদ্রার ভাঁড়ারে টান পড়ার প্রভাব পড়ে আমদানিতে। বিশেষত, জ্বালানি তেল কেনা কমে যায় অনেকটাই।

আর তার পরিণতিতে আকাশ ছোঁয় মূল্যবৃদ্ধি। শ্রীলঙ্কায় এখন এক কাপ চায়ের দাম ১০০ টাকা! এক কিলোগ্রাম চাল ৫০০ টাকা। চিনির কিলোগ্রাম ৪০০ ছুঁতে চলেছে। এমনকি, শিশুখাদ্যের দামও সাধারণের নাগালের বাইরে। অপ্রতুল জীবনদায়ী ওষুধ। কাগজের অভাবে বন্ধ স্কুল-কলেজের পরীক্ষা।

গত কয়েক বছরে টাকার অভাব সামাল দিতে বিপজ্জনক সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের সরকার। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিদেশি মুদ্রায় রাসায়নিক সার কিনতে হয় এবং তার উপর ক্রেতাদের ভর্তুকিও দিতে হয়, তাই সে খরচ বাঁচাতে রাতারাতি নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল রাসায়নিক সার— গোটা দেশে অর্গানিক চাষ চালু করা হয়।

প্রেসিডেন্ট রাজাপাক্ষে বলেছিলেন— অচ্ছে দিন, থুড়ি, কৃষিতে উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও কৃষকের সমৃদ্ধি এল বলে। আসেনি। ধান উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে ২০ শতাংশ, এখন বাংলাদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। অর্থনীতির উন্নতি হবে বলে রাতারাতি করের হার কমিয়ে দিয়েছিল সরকার। শিল্প উৎপাদন বাড়েনি, কিন্তু রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে বিপুল পরিমাণে। ফলে, রাজকোষ ঘাটতির হার জিডিপি-র প্রায় ১৫ শতাংশ।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিণতি শুধুই কি অর্থব্যবস্থাকে সামলাতে না পারার ফল? না, এ শুধু অর্থনৈতিক ব্যর্থতা নয়। শ্রীলঙ্কার রাজাপাক্ষে পরিবার— যে পরিবারের এক ভাই দেশের প্রেসিডেন্ট, অন্য ভাই প্রধানমন্ত্রী, আরও দু’ভাই এবং ছেলেমেয়েদের অধীনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব দপ্তর, সব মিলিয়ে দেশের বাজেটের প্রায় ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে যে পরিবারটি— যে ভঙ্গিতে দেশ চালিয়েছে, এটা তার প্রতিফলন। অন্য কারো মতের তোয়াক্কা না করে, কেবল নিজেদের স্বার্থের কথাটুকু ভেবে।

রাজাপাক্ষে পরিবারের দুর্নীতি, দেশের সব ক্ষমতা দখলের চেষ্টা— সব কিছু নিতান্ত প্রকাশ্যে থাকার পরও পরিবার চার বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পরে ২০১৯ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়েই প্রেসিডেন্ট হন গোতাবায়া রাজাপাক্ষে; দুদিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহেকে ছেঁটে সেই পদে বসেন মহিন্দ রাজাপাক্ষে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর নিঃশর্ত সমর্থন ছিল তাদের দিকে— কারণ, মহিন্দ রাজাপাক্ষে দ্ব্যর্থহীনভাবে এই সিংহলি সংখ্যাগরিষ্ঠতানির্ভর উগ্র জাতীয়তাবাদের পক্ষে।

প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট থাকার সময় এলটিটিই-র কোমর ভেঙেছিলেন মহিন্দ, সঙ্গে মারা পড়েছিলেন অন্তত পঁচাত্তর হাজার তামিল। তিনি জানেন, সিংহলি জাতীয়তাবাদের পালের হাওয়াই তাকে টেনে নিয়ে যাবে। উগ্র জাতীয়তাবাদের সব সময়েই কোনো না কোনো শত্রুপক্ষের প্রয়োজন হয়। দুর্বল হয়ে যাওয়া তামিল জনগোষ্ঠীকে দিয়ে সেই কাজ আর চলছে না বলে রাজাপাক্ষেরা নতুন শত্রু হিসেবে বেছে নিয়েছেন মুসলমানদের। বড় মাপের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি ঠিকই, কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্রের মুসলমানরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়েছেন।

সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ দিয়ে অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের উন্নতি করা কঠিন। দীর্ঘ সিংহলি-তামিল গৃহযুদ্ধে শ্রীলঙ্কায় ঋণের পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছিল। সেই গৃহযুদ্ধ মিটেছে, কিন্তু জাতিগত অবিশ্বাসের আবহে অর্থব্যবস্থা গুটিয়েই থেকেছে— শ্রীলঙ্কায় লগ্নি করতে ভয় পেয়েছেন অনেকেই।

পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গেও ক্রমশ সম্পর্ক ছিন্ন করেছে শ্রীলঙ্কা— দেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য আন্তর্জাতিক চাপকে রাজাপাক্ষেরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি শক্তির অন্যায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে দেখিয়েছেন। ফলে, লাভজনক শর্তে বিদেশি বিনিয়োগ বা সহজতর শর্তে ঋণ, কোনোটাই পায়নি শ্রীলঙ্কা। এই ফাঁক পূরণ করতে এগিয়ে এসেছে চীন। শ্রীলঙ্কাজুড়ে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে লগ্নি করেছে চীন— সে লগ্নি আসলে চড়া সুদে ঋণ।

যে দেশ অন্য কোথাও থেকে ঋণ পায় না, তাকে চড়া হারে ঋণ দেয়া চীনের ইদানীংকার নীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর নাম দিয়েছে ডেট ট্র্যাপ ডিপ্লোম্যাসি— ঋণের দায়ে জড়িয়ে ফেলার কূটনীতি। শ্রীলঙ্কায় চীনের লগ্নি প্রচুর, রাজাপাক্ষে পরিবার ও সাঙ্গাতদের তাতে লাভ প্রচুরতর, কিন্তু দেশের কতখানি উপকার হয়েছে, সে হিসাব নেই।

সিংহলি-বৌদ্ধ আধিপত্য বজায় থাকায় শ্রীলঙ্কায় রাজাপাক্ষে পরিবারের ওপর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খুশিই ছিল। ‘আন্তর্জাতিক চাপ’-এর কাছে দেশের প্রেসিডেন্টের মাথা না নোয়ানোর সাহসেও অনেকেই গর্বিত ছিলেন। এপ্রিলের গোড়ায় যে মন্ত্রীরা দল বেঁধে পদত্যাগ করেছেন অপশাসনের অভিযোগ তুলে, তারাও দীর্ঘদিন ধরে বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছেন সব কিছুই। অর্থব্যবস্থার যখন ক্রমেই ভরাডুবি হচ্ছে, আইএমএফ তখন বারে বারে সাহায্য করতে চেয়েছিল— গোতাবায়া রাজি হননি।

তার বিশ্বাস ছিল, ভারত মহাসাগরে শ্রীলঙ্কার ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অবস্থানের কারণেই গোটা দুনিয়া বিনাশর্তে আর্থিক সাহায্যের ঝুলি নিয়ে ছুটে আসবে, চীনের আরও প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে। সেই বিশ্বাস ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে— এমনকি চীনও খুব আগ্রহ দেখায়নি শ্রীলঙ্কার মাথায় ভেঙে পড়া আন্তর্জাতিক ঋণের বোঝা লাঘব করার জন্য। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, গোতাবায়া যখন এমন বিপজ্জনক পথে হাঁটছিলেন, চার পাশের কেউ বাধাও দেননি তাকে।

শ্রীলঙ্কার উদাহরণ থেকে বাংলাদেশ বা এদেশের হর্তাকর্তা-বিধাতারা কিছু শিখবে, সেই আশা ক্ষীণ। তবে, একটা মস্ত বার্তা দিয়ে গেল শ্রীলঙ্কা— সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যের পথে হাঁটতে গিয়ে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করলে, ‘মাফিয়াতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করলে, চারপাশে শুধু ‘জি হুজুর’-দের জায়গা দিলে শেষপর্যন্ত তার ফল হয় মারাত্মক।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধকার

এ বিভাগের আরো খবর