বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রক্তভেজা ১৯ মে: বাংলা ভাষার জন্য আত্মদান

  •    
  • ১৯ মে, ২০২২ ১৪:০৮

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজপথজুড়ে নারী-পুরুষ; শিশুর পদভার বেড়ে ওঠে। বিপন্ন বাংলা ভাষা, বিপন্ন মায়ের ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ সবার হৃদয়ে। উত্তাল জনসমুদ্র। বাঁধভাঙা মানুষ। সবার কণ্ঠে স্লোগান, ‘আমার ভাষা তোমার ভাষা বাংলা ভাষা’। গ্রেপ্তার হয় অনেকে। রেললাইনজুড়ে মানুষের ঢল। প্রতিরোধে পুলিশ ও সেনাবাহিনী কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ এবং বেপরোয়া লঠিচার্জ করে। কিন্তু আহতরা তবু স্থান ত্যাগ করেনি। শহরজুড়ে শুধু স্লোগান। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে নিরস্ত্র বঙ্গভাষীদের ওপর চালানো হলো গুলি। রেলওয়ে চত্বরে লুটিয়ে পড়ে ১১টি তাজা প্রাণ, যাদের জন্ম একদার সিলেটে।

১৯৬১ সালের ১৯ মে রক্তভেজা একটি দিন বাংলা ভাষাভাষীর জন্য। এর ৯ বছর আগে এই বাংলা ভাষার জন্য রক্ত ঢেলে দিয়েছিল ঢাকার রাজপথে বাংলার কিছু দামাল ছেলে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঝরিয়েছিল ছাত্র-যুবারা। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, বাংলাকে শুধু রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিতই করেনি, বাঙালির স্বাধীন সার্বভৌম দেশও অর্জন করেছে। ২০০০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বিশ্বদরবারে বাংলাভাষার মর্যাদাকে উচ্চাসন দিয়েছেন। জাতিসংঘে পিতার মতো তিনিও বাংলায় ভাষণ দিচ্ছেন। বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম স্থানে অবস্থিত বাংলা ভাষা। এই ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।

পূর্ব বাংলার মানুষকে অবদমিত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকরা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাঙালি তা মানেনি। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় বিশ শতকে বাঙালি অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। আর একষট্টি বছর আগে আসামের বরাক নদীতীরে বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষী মানুষের রক্ত ঝরেছিল মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের দাবিতে। যদিও আসাম রাজ্যে শুধু বাংলাভাষী নয়, অন্যান্য জনগোষ্ঠীও রয়েছে। খাসিয়া, বড়ো, গারো, মিছিং, মণিপুরী, আও, মিজো, কার্বি, রাভা, ককবরক, চাকমা, মণিপুরি বিষ্ণুপ্রিয়া, আদি (অরুণাচল), ডিমাসা- এসব ভাষাভাষী মানুষও রয়েছে। এরা সবাই নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। মূলত বাংলাভাষী সংখ্যাগুরু হলেও, অসমীয়া ভাষাভাষীরা তাদের উপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, এখনও সে প্রচেষ্টা অব্যাহত।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের আসাম বা আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের আরেক রক্তাক্ত নজির। অবশ্য বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে এই আন্দোলনে পার্থক্য রয়েছে। আসাম রাজ্যে অসমীয়ারা একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার একপর্যায়ে পুরো রাজ্যে অসমীয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে চালুর সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে রাজ্যের বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী গড়ে তোলে প্রবল আন্দোলন।

বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মবলিদানের দ্বিতীয় এ নজির স্থাপিত হয়েছিল ৬১ বছর আগে। বরাক উপত্যকার মানুষজন মূলত বাংলাভাষী। এক সময় এ এলাকা ছিল সিলেটের অংশ। দেশভাগ তাদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটায়। মুসলিম সংখ্যাধিক্য এবং বাংলাভাষী অঞ্চল হলেও ব্রিটিশের কলমের খোঁচায় সিলেটের ৪টি থানা আসাম তথা ভারতভুক্ত হয়। আর এ অঞ্চলের মানুষকে তাদের মাতৃভাষায় কথা বলা শুধু নয়, শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ বঞ্চিত করে। বরাক অঞ্চলে ভাষার জন্য আন্দোলনের বীজ আসাম রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতেই নিহিত ছিল। এখনও তা লুপ্ত হয়নি।

শ্রীহট্ট তথা সিলেট ছিল অবিভক্ত বাংলার অন্তর্ভুক্ত আয়তনে বড় জেলা। ১৮৪৭ সালে আসাম প্রদেশ গঠন করে ব্রিটিশ শাসকরা। সিলেট তখন বঙ্গের সঙ্গে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে সিলেট পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশের মধ্যে পড়ে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সিলেট পূর্ববঙ্গ তথা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। শুধু একটি অংশ আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয় ব্রিটিশ। যদিও ১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত গণভোটে ওই অংশের বাসিন্দারা পূর্ববঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হবার পক্ষে ভোট দিয়েছিল। করিমগঞ্জ ‘হাইলাকান্দি, শিলচর’ কাছাড়-বাংলাভাষী ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো সিলেটের অংশ হলেও তা হয়ে যায় আসামের অংশ। এমনকি আরও কিছু বাংলাভাষী অঞ্চল। তদুপরি এসব অঞ্চল আসামভুক্ত করা হয়। দেশভাগের মর্মযাতনা তাদের এখনও উপলব্ধি করতে হয় যখন ‘বঙ্গাল খেদাও’ অভিযানে নামে অসমীয়ারা।

রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গকালে সিলেটকে বঙ্গদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার বেদনা প্রকাশ করেছিলেন এভাবে- “মমতাবিহীন কালস্রোতে/বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/সুন্দরী শ্রীভূমি।” দেশভাগের শিকার হয়ে শ্রীহট্টের যে বাঙালিরা অসামে যান, ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের আগে, অবিভক্ত ভারতবর্ষে, তাদেরও জন্মভূমি ছিল অসাম। কারণ তা তখন অসাম প্রদেশভুক্ত অঞ্চল। কিন্তু তাদেরকে পূর্ববঙ্গীয় বলে ঘোষণা দিয়ে অসমীয়রা হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠনসহ ভাষার অধিকারও কেড়ে নিয়েছিল। ক্ষমতাসীন অসাম রাজ্য সরকার ঘোষণাই দিয়েছিল, আসাম হবে কেবল অসমীয়াদের জন্যই। তখন থেকেই অসমীয়া ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হলো বাংলাভাষীদের উপর। দেশভাগ সিলেট ও অসমের মানচিত্রকে পাল্টে দিয়েছিল। বাঙালি হিন্দুরা দেশত্যাগ করে আসামের বিভিন্ন জেলায় বসবাস শুরু করে। অনুরূপ অসাম থেকেও প্রচুর মুসলমান সিলেটে অভিবাসী হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর আসামের বিধানসভার অধিবেশনে রাজ্যপাল ঘোষণা করেন যে, আসাম এখন থেকে অসমীয়রাই শাসন করবে। বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতিকে অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিলীন হতে হবে। সরকার রাজ্যে অন্য কোনো ভাষা ব্যবহারে প্রশ্রয় দেবে না। সরকারি এই ঘোষণায় বাংলাভাষীসহ অন্যান্য ভাষাভাষীরাও ফুঁসে ওঠে। স্থায়ী ও অভিবাসী বাংলাভাষীরা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ঘৃণা ও উপেক্ষার শিকার হতে থাকে বাংলাভাষীরা। তাদেরকে চিহ্নিত করা হয় ‘অনুপ্রবেশকারী বিদেশী’, ‘বহিরাগত’, ‘সন্দেহভাজন শরণার্থী ’ হিসেবে। অসমে বাংলা ভাষাভাষী ৪৩ লাখ মানুষ ছিল যেখানে, সেখানে ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে দেখানো হয় ১৭ লাখ। বিপরীতে ২০ লাখ অসমিয়াভাষী বাড়িয়ে করা হয় ৪৯ লাখ। এই অবিশ্বাস্য সংখ্যাবৃদ্ধিকে সে সময়ে অভিহিত করা হয়েছিল ‘জীবতাত্ত্বিক বিস্ময়’ (বায়োলজিক্যাল মিরাকল) হিসেবে। ষড়যন্ত্রের শিকার হলো বাংলাভাষীরা। সংখ্যাগুরু থেকে পরিণত হলো সংখ্যালঘুতে। এই বিভেদ জাতিগত দাঙ্গায় রূপ নেয়। ইতিহাসের পাতায় তাই দেখা যায়, ১৯৪৮ সালের মে মাসে গুয়াহাটিতে বাঙালি-অসমীয়া দাঙ্গা, ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট ও অগ্নিসংযোগ এবং হতাহত অর্ধশত। এই দাঙ্গার প্রসারে আসামজুড়ে ‘বঙ্গাল খেদাও’ অভিযান শুরু হয়। ১৯৫০ সালে এই অভিযান গণহত্যায় পরিণত হয়।

বাংলাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলে নির্বিচারে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট চলে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় গোয়ালপাড়া জেলার বাংলাভাষীরা। আতঙ্কিত বাংলাভাষীরা আত্মরক্ষার্থে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় পালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে এদের শর্তসাপেক্ষে আসামে পুনর্বাসন করা হয় যে, তাদের মাতৃভাষা হবে অসমীয়া। বাংলা উচ্চারণ করা যাবে না। তারপরও বাংলাভাষীরা থেমে থাকেনি। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানায় মাতৃভাষার অধিকারের জন্য। এতে ক্ষুব্ধ অসীময়ারা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা করার জন্য সরকারি মদদে নারকীয় কাণ্ড ঘটাতে থাকে। শুরু হয় বাংলাভাষী নিধন।

১৯৬০ সালের ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি একতরফাভাবে প্রস্তাব নেয় যে, অসমীয়া ভাষাই হবে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা। বাংলাভাষী অঞ্চল কাছাড় জেলার নির্বাচিত দশ সদস্য এর বিরোধিতা করে। প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ২ ও ৩ জুলাই কাছাড় জেলার শিলচর গান্ধীবাগে ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন’ করা হয়। প্রায় ২৫ হাজার বঙ্গভাষীর সমাবেশে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবি তোলা হয়। এই দাবির জবাব দেয়া হয় তিন জুলাই।

ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাজুড়ে শুরু হয় ভয়াবহ দাঙ্গা । এতে বহু বঙ্গভাষী নিহত হয়। দশ হাজারের বেশি ঘরবাড়ি ভস্মীভূত হয়। বাস্তুচ্যুত হয় পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ। বঙ্গভাষীর আহবানে হরতাল পালনও হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর শান্তি প্রক্রিয়াও ব্যর্থ হয়। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ওপর বলিষ্ঠ চাপ প্রয়োগ করতে পারেনি। কারণ রাজ্য সরকার তো কংগ্রেসেরই। বাংলাভাষীদের ওপর এই নারকীয় হামলায় তাদের রক্ষায় তেমন কেউ এগিয়ে আসেননি। সব সচেতন ও কল্যাণকামী এবং মানবাধিকার সংগঠনের আহবান কোনো কাজে দেয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ১৯৬০ সালের ২৪ অক্টোবর রাত দশটায় আসাম বিধানসভায় অহমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে অনুমোদন করা হয়। প্রতিবাদে গর্জে ওঠে বঙ্গভাষীরা। বাংলাভাষী জেলা কাছাড়ে মানুষ প্রতিবাদে রাজপথে নামে। করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, শিলচরে গণজাগরণ তৈরি হয়। আসামের সংখ্যালঘু অন্য ভাষাভাষীরাও এই আন্দোলনে শরিক হয়।

১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। এসময় সিলেটের অঙ্গ করিমগঞ্জে বৃহৎ জনসম্মেলনে গণসংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। অজস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল সেদিন, ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ, বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ।’ ১৪ এপ্রিল তথা পয়লা বৈশাখ সত্যাগ্রহী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘সংকল্প দিবস’ পালন করা হয়। অযুতকণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘জান দেব তবু জবান দেব না, আমার ভাষা তোমার ভাষা বাংলা ভাষা।’ আন্দোলনে আতঙ্কিত আসাম সরকার। ১৯৬১ সালের ১৯ মে সারা আসামে ‘বন্ধ’ ও সত্যাগ্রহের কর্মসূচি দেয় আন্দোলনকারীরা। শিলচরসহ অন্যত্র সেনা টহল চালু ও ১৪৪ ধারা জারি হয়। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে বঙ্গভাষীসহ অন্য ভাষাভাষীরা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা এবং বরাক উপত্যকায় ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তখন।

১৯৬১ সালের ১৯ মে মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে খুব ভোরে সত্যাগ্রহী, স্বেচ্ছাসেবীরা শিলচর রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্টেশন, অফিস-আদালতের সামনে সমবেত হতে থাকে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজপথজুড়ে নারী-পুরুষ; শিশুর পদভার বেড়ে ওঠে। বিপন্ন বাংলা ভাষা, বিপন্ন মায়ের ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ সবার হৃদয়ে।

উত্তাল জনসমুদ্র। বাঁধভাঙা মানুষ। সবার কণ্ঠে স্লোগান, ‘আমার ভাষা তোমার ভাষা বাংলা ভাষা’। গ্রেপ্তার হয় অনেকে। রেললাইনজুড়ে মানুষের ঢল। প্রতিরোধে পুলিশ ও সেনাবাহিনী কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ এবং বেপরোয়া লঠিচার্জ করে। কিন্তু আহতরা তবু স্থান ত্যাগ করেনি। শহরজুড়ে শুধু স্লোগান। দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটে নিরস্ত্র বঙ্গভাষীদের ওপর চালানো হলো গুলি। রেলওয়ে চত্বরে লুটিয়ে পড়ে ১১টি তাজা প্রাণ, যাদের জন্ম একদার সিলেটে। একাদশ শহীদের বুকের তাজা রক্তে শিলচর রেল স্টেশন রঞ্জিত হয়ে ওঠে।

বরাক উপত্যকার মাটি বঙ্গভাষীর রক্তের দাগে ফুটিয়েছে কৃষ্ণচূড়া। শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, বয়স তার ষোলো, মিছিলের মুখ ছিল, তাকেও হতে হলো ভাষার বলি। আত্মদান করেছিল সেদিন হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দেব, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডিচরণ সূত্রধর, ধীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণী দেবনাথ ও সুনীল সরকার। এই আত্মদানেরও পাঁচ বছর পর ১৯৬৬ সালের ২২ মার্চ বরাক অঞ্চলে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

‘বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থের ভূমিকায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক সুবীর কর উল্লেখ করেছেন-

“আমরা সবাই মিলেছিলাম মায়ের ডাকে। সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছে বাহান্নের ঢাকার ভাষা সংগ্রাম। রফিক, সালাম, বরকতেরা ছিলেন আদর্শ। পদ্মা মেঘনা যমুনার মধ্যে কুশিয়ারা, ধলেশ্বরী, সুরমা খুঁজে নিয়েছিল তার ঠিকানা। বুড়িগঙ্গা আর বরাক হয়ে উঠেছিল চেতনার সংগ্রাম”।

বরাক ভাষা আন্দোলনের উপর শিলচর থেকে ইমাদউদ্দিন বুলবুল রচিত ‘দেশী ভাষা বিদ্যা যার’ ও ‘ভাষা আন্দোলনের উত্তরাধিকার’ নামে দুটি গ্রন্থ রয়েছে যাতে পটভূমি বিধৃত রয়েছে। বাংলা ভাষা তথা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য আত্মবলিদানের দ্বিতীয় উদাহরণ শিলচর তথা বরাক উপত্যকা। যেখানে ভাষা সংগ্রাম জাতিসত্তার স্বতন্ত্র মর্যাদাকে সংরক্ষিত করেছে।

ভারতের আসাম রাজ্যে বঙ্গভাষীদের হাল এখনও করুণ। প্রায়শই বঙ্গভাষীদের ওপর নিপীড়ন নামে। কিন্তু অসমীয়দের এই আচরণ অবশ্য সাম্প্রতিক নয়। আরও প্রাচীন। ১৯৩৬ সালে শনিবারের চিঠি সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ লিখেছিলেন-

“যে কারণেই হউক আসামের ভাষা ও কালচারকে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব দেবার জন্য যে সরকারি চেষ্টা আজকাল চলিতেছে, সংবাদপত্র পাঠক মাত্রেই তাহা অবগত রহিয়াছেন। কিন্তু এই চেষ্টা বহুদিন পূর্বে শুরু হইয়াছে।”

১৮৭০ সালে মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত জন মারডক রচিত ‘ক্যাটালগ অব দি ক্রিশ্চিয়ান ভার্ণাকুলার লিটারেচার অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে অহমীয়া ভাষা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-“বাঙ্গলার সঙ্গে অসমীয়া ভাষার সাদৃশ্য এত বেশী যে, স্বতন্ত্র ভাষা হিসাব অসমীয়াদের দাবি অনেকে স্বীকার করেন না। যদিও অনেক সরকারি কর্মচারী অসমীয়া ভাষার স্থলে বাঙ্গলার প্রবর্তনে প্রয়াসী। কিন্তু সরকার স্থানীয় ভাষায় শিক্ষার প্রশ্রয় দিচ্ছেন”। গৌহাটি প্রবাসী বাঙ্গালী ছাত্র সম্মিলন এর ১৯৩৬ সালের ১৪ অক্টোবর গৌহাটিতে আয়োজিত অষ্টম অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণে সজনীকান্ত দাশ বলেছিলেন- ‘‘কামরূপ-গৌহাটিতে বসে আপনারা আপনাদের সম্মিলনীর নাম ‘প্রবাসী বাঙ্গালী ছাত্র সম্মিলনী’ দিয়েছেন। মনে হইতেছে আপনারা পরাজিত এবং অভিমান ক্ষুব্ধ। অসমে বাঙ্গালীকে প্রবাসী করিবার জন্য রাজনৈতিক প্রচেষ্টা সম্প্রতি শুরু হইয়াছে। কিন্তু ইতিপূর্বে বাঙ্গালীরা প্রবাসী ছিল না। সংখ্যায়, শিক্ষায় জীবনের প্রায় সকল বিভাগেই বাঙ্গালীর প্রাধান্য ছিল এবং সর্বত্র বাঙ্গালীর স্বার্থ অসমের মাটি ও প্রকৃতির সহিত জড়িত ছিল। অসমের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল কলিকাতা। চা বাগানগুলি বাদ দিলে আসাম বলিতে কামরূপ, শ্রীহট্ট, শিলচর, শিলংয়ের মত কয়েকটি শহর বুঝাইত এবং সকল স্থলেই ছিল বাঙ্গালীর কর্তৃত্ব্। প্রাগ ঐতিহাসিক যুগ হইতেই কামরূপ বাঙ্গলাদেশের অঙ্গ ছিল।” মহাভারতে যে এ অঞ্চলের বর্ণনা রয়েছে, তা পরবর্তীকালেও গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। সজনীকান্ত দাশ বলেছেন,“ভাষার দিক দিয়া আসামী ভাষা বাঙ্গলার একটি উপভাষা বা ‘প্রভিন্সিয়াল ডায়ালেক্ট’ মাত্র। উপভাষাতে কোনো সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। এই কারণেই অহমীয়া ভাষার উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্য নাই। বাঙ্গলা সাহিত্যের উপরই আসামবাসীকে নির্ভর করিতে হইয়াছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অসমের সুবিখ্যাত হলিরাম ঠেকিয়াল ফুকন ও যজ্ঞরাম ফুকন বাঙ্গলা ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করিতেন। হলিরামের ‘আসাম বুরঞ্জী’ নামক অসমের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ বাঙ্গলা ভাষাতেই রচিত হয়ে ১৮২৯-৩০ সালে কলকাতার সমাচার চন্দ্রিকা যন্ত্রালয়ে মুদ্রিত হয়।” আসাম বর্ণমালা মূলত বাংলা বর্ণমালা। দু’একটি অক্ষর ব্যতিক্রম রয়েছে।

সুরমা উপত্যকা তথা সিলেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বাংলাভাষী অঞ্চলের মানুষ তাদের মাতৃভাষায় কথা বলবে সেটাই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ সিলেট, আসাম সফর করেছেন। বাংলাভাষী মানুষজন তাদের আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের গানই গেয়েছিলেন। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সেদিন বাংলাভাষার অধিকার রক্ষার দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল যারা, প্রতিবেশী দেশের প্রতিবেশী রাজ্যে, তাদের আত্মদান বৃথা যায়নি। অন্য ভাষাভাষী যেমন বোড়ো, ককবরক ভাষীরাও তাদের মাতৃভাষার অধিকার পেয়েছে। ওরা ১১ জনও গেয়েছিল ‘আ-মরি বাংলাভাষা।’ আমরাও তা গাই।

লেখক: কবি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক। মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

এ বিভাগের আরো খবর