বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

গ্রাম রূপান্তর: তিন দশকের পর্যবেক্ষণ

  • খান মো. রবিউল আলম   
  • ৯ মে, ২০২২ ১৯:৫৮

গ্রামগুলোয় দারিদ্র্য কমেছে, তবে বেড়েছে বিচ্ছিন্নতা। আগে সাত গ্রামের মানুষ ঈদের নামাজ এক জামাতে আদায় করত, এখন তা সাত গ্রামে আলাদাভাবে আদায় হয়। ডায়রিয়া-কলেরার মতো জীবাণুঘটিত রোগের বদলে এসেছে ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেশারের মতো জীবনাচারজনিত রোগবালাই।

তানোর-গোদাগাড়ী রাজশাহী জেলার দুটি উপজেলা। বরেন্দ্রের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তানোর-গোদাগাড়ীর গ্রামগুলোর রূপান্তর পর্যবেক্ষণ করছি প্রায় তিন দশক। এই রূপান্তরের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ইতিবাচকতা এবং পেছনে কিছু নেতির ছায়া। যা যা বদলে যেতে দেখেছি, সেগুলো তুলে ধরছি।

সড়ক যোগাযোগ

গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ সূচকে এ এলাকা বেশ এগিয়ে। শুধু গ্রামের সংযোগ সড়ক নয়, গ্রামের অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ অর্থাৎ একপাড়া থেকে আরেক পাড়ায় যাওয়ার ক্ষেত্রেও সড়ক যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। গত শতাব্দীর ৯০-এর আগে তানোরে উপজেলা সড়ক ছাড়া আর কোনো পাকা সড়ক ছিল না। সেখানে এখন প্রায় প্রতিটি গ্রাম পাকা সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত। এ সংযুক্তি উন্নয়নের মূল কারক হিসেবে কাজ করছে। সড়কের পথ ধরে আসছে সমৃদ্ধি।

সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃত প্রভাব পড়েছে জনজীবনের সকল সূচকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে এসেছে অভাবনীয় অগ্রগতি। তবে সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি ছোট-বড় নদী ও খাড়িগুলো সচল রাখা গেলে সেচ কাজ, পানিপথ নির্ভর চলাচল সহজতর হতো, যা জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ফেলতে ইতিবাচক প্রভাব।

পরিবহন ও চলাফেরা

সড়ক পাকা হওয়ায় গরুর গাড়ি আজ প্রায় অপসারিত। সে স্থান দখল করেছে ভ্যান, ব্যাটারিচালিত ভ্যান, মোটরসাইকেল ও ছোট লরি। মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কার অবলীলায় গ্রামে ঢুকে যাচ্ছে ।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসেছে গতিশীলতা। যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানুষের সময় ও ব্যয় কমেছে। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, যে গ্রামে একসময় দুটি মটরসাইকেল ছিল, সেই গ্রামে এখন তা ১৪টি। গ্রামের মানুষ সার্বক্ষণিক চলাচলের সুযোগ পেয়েছে। 

বিদ্যুৎ

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে এ এলাকাটি পল্লি বিদ্যুতের আওতায় আসে। বিদ্যুৎ সার্বিক জীবনযাত্রা, পরিবহন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। চাষাবাদের জন্য স্থাপিত গভীর নলকূপগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়। বাড়িঘরে বিদ্যুৎ সংযোগের ফলে নতুন নতুন অনেক চাহিদা তৈরি হয়।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে বিদ্যুৎ সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। মাছ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ফিড, কোল্টস্টোরেজ ও বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানা আজ শহর সংলগ্ন গ্রামগুলোতে গড়ে উঠছে। বিদ্যুৎ হয়ে উঠছে অগ্রসরতার বিশেষ সূচক।

জমি

তিনটি ‘জ’– জন, জমি ও জলের সমন্বয় গড়ে উঠছে উন্নয়নের নতুন পাটাতন। বরেন্দ্রের জমি বহুমাত্রিক উৎপাদনের জন্য বুক উদাম করে দিয়েছে। যে জমিতে কেবল ধান চাষ হতো, সেখানে আলু, পটল, করলা, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ জমে উঠেছে। জমির পেট আর খালি রাখার সময় নেই। সবুজ প্রান্তর সবসময় রত্নগর্ভা।

বেড়েছে মানুষের সৃজনশীলতা। নতুন নতুন চাষাবাদ ও সৃজনে কৃষক পারঙ্গম হয়ে উঠছে। কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার চাষাবাদকে সহজ করছে। গরুর লাঙ্গল ও মই ফেলে কৃষক এখন কম্বাইন্ড হারভেস্টর ও ধান মাড়াই মেশিন, হ্যারো মেশিন, সার ও কীটনাশক ছিটানোর জন্য নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। জৈব সারের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক।

সমস্যা হলো কৃষক জেনে বা না জেনে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছে। এর মূল লক্ষ্য কেবল উৎপাদন বৃদ্ধি। মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। যদি জমি কোনো কারণে তার উৎপাদনশীলতা হারিয়ে ফেলে তাহলে এক মহাবিপর্যয় নেমে আসবে। কৃষিজমির স্বাস্থ্য সুরক্ষা অতি জরুরি।

গ্রামগুলো থেকে যারা জীবন ও জীবিকার কারণে শহরে অভিবাসী হয়েছে, তাদের জমিজমা অন্যেরা চাষাবাদ করছে। এতে জমির মালিক ও বর্গাচাষি উভয়েই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে।

গভীর নলকূপ ও কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য

এক সময় বরেন্দ্রের জমি ছিল এক-ফসলি। এ অঞ্চলে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে গভীর নলকূল স্থাপন শুরু হয়। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে এক-ফসলি জমি তিন ফসলি জমিতে উন্নীত হয়। উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকের আয় বাড়তে থাকে।

উৎপাদন ব্যবস্থার অমূল পরিবর্তনে তিন দশকে এ এলাকার অর্থনৈতিক চিত্র বদলে দিয়েছে। খাবার নিশ্চয়তা এসেছে। আশির দশকে প্রতিবেশীর ভালো জামা পরে বিয়ে করতে যাওয়া বা জুতা/স্যান্ডেল ধার করে বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যেত। এখন সেটা চিন্তাও করে না কেউ। সবকিছুতে রূপান্তরের ছাপ সহজেই চোখে পড়ছে।

তবে হালে গভীর নলকূপ ব্যবস্থাপনা, পানির দাম ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পড়ে যাওয়া গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। 

প্রজেক্ট নির্ভর চাষাবাদ ও কৃষিতে নয়া সামন্তবাদ

শুরু হয়েছে গভীর নলকূলকেন্দ্রিক প্রজেক্ট নির্ভর চাষাবাদ। এতে শহরের বা আধাশহরের লগ্নিকারীরা গ্রামে যাচ্ছে। স্থানীয় ফড়িয়া বা গভীর নলকূপের মালিকদের সঙ্গে তাদের নতুন নেক্সাস তৈরি হয়েছে। কৃষক নিজের পছন্দ মতো জমি চাষাবাদের অধিকার হারাতে বসেছে। এটিকে অনেকে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় নয়া সামন্তবাদ হিসেবে চিহ্নিত করছে। মাটির নিচে পানির প্রকৃত মালিক জনগণ। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সরকারি নির্দেশনা জরুরি, যাতে পানি নিয়ে কেউ কৃষককে জিম্মি করতে না পারে।

আবাদি জমি কমছে

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রতি বছর আবাদি জমি কমছে। ঘন বসতির এ দেশে জমির পরিমাণ কমে গেলে খাদ্য উৎপাদন যে হুমকির মুখে পড়বে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকার কৃষিজমি সুরক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিলেও তার কার্যকর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

গ্রামে খোলা জায়গা, মাঠ বা উন্মুক্ত প্রান্তর সীমিত হয়ে পড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জমির চাহিদা বাড়ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। সরকারি খাসজমির বড় একটা অংশ রয়েছে ক্ষমতাশালীদের দখলে।

রেডিও, টিভি, কম্পিউটার ও মোবাইল

আশি বা নব্বইয়ের দশকে গ্রামে রেডিও থাকলেও টেলিভিশন ছিল দুর্লভ। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা স্থানীয় ক্লাবগুলোয় টেলিভিশন থাকত। চেয়ারম্যান সাহেবদের বাসা বা ক্লাবে গিয়ে মানুষ টেলিভিশন দেখত। টেলিভিশনে মাত্র দুটো চ্যানেল দেখা যেত। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও কলকাতার দূরদর্শন। চ্যানেল নির্বাচনের ক্ষেত্রে দর্শকের কোনো পছন্দ ছিল না। টেলিভিশন যাদের নিয়ন্ত্রণে তারাই চ্যানেল নির্বাচন করত। কেবল পুরুষেরা এসব টেলিভিশন দেখার সুযোগ পেত। এখন পরিবারের নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোর সবাই একসঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখার সুযোগ পাচ্ছে।

আজ কমবেশি প্রতিটি বাড়িতে টেলিভিশন সেট ও ৬০টি চ্যানেল। স্কুল, ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ও পোস্টঅফিসগুলোতে কম্পিউটার সুবিধা চালু হয়েছে। গ্রামের বাজারগুলোতে কম্পিউটার শপ চালু হয়েছে। কমবেশি সবার হাতে মোবাইল প্রযুক্তি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে অসংখ্য ভার্চুয়াল কমিউনিটি গড়ে উঠছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সোশ্যাল এজেন্ডা নিয়ন্ত্রণ করছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে।

ইন্টারনেট

গ্রামে গেছে ওয়াইফাই ইন্টারনেট সংযোগ। তানোর-গোদাগাড়ীর আলোকছত্র, প্রসাদপাড়া, পলাশী ও চকতাঁতিহাটি গ্রামে এসেছে ক্যাবলবিহীন ওয়াইফাই ইন্টারনেট। কেবল স্বচ্ছল নয় আদিবাসী সাঁওতাল পল্লীও স্যাটেলাইট টিভির সংযোগের আওতায় এসেছে। তৈরি হয়েছে স্যাটেলাইট সংস্কৃতি উপভোগের অবারিত দিগন্ত।

এ সুযোগ কেবল মনোজগত নয়, পোশাক-আশাক ও খাদ্যভ্যাসেও নিয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

খাদ্যাভাস

খাদ্যভ্যাসে এসেছে আমূল পরিবর্তন। প্যাকেটজাত খাবার আর কোমল পানীয় স্বাভাবিক খাদ্য হিসেবে দেখা যাচ্ছে। গ্রামের মোড়ে মোড়ে নানা পণ্যের সরগরম বাজার জমে উঠেছে। এ দোকানগুলো প্রায় সারাদিন খোলা থাকে। একসময় মানুষ স্থানীয় হাটে সপ্তাহে একবার বাজার করার সুযোগ পেত। এখন সেই সুযোগ থাকে সারাক্ষণ।

সকালের নাস্তার মেন্যু এখন বদলে গেছে। পান্তা বা কড়কড়া ভাতের (রাতের খাবার পর থেকে যাওয়া ভাত) পরিবর্তে সে জায়গা দখল করছে পরাটা, ডিম পোচ ও মিষ্টি।

পাকাবাড়ি

প্রতিটি গ্রামে বলা যায় ৩০-৫০ শতাংশ বাড়ি আজ পাকা। জানা গেল মাটি দিয়ে বাড়ি বানাতে খরচ পাকা বাড়ির তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। শহরের আদলে বাড়ির সঙ্গে অ্যাটাচড বাথরুম ও রান্নাঘর হচ্ছে। অধিকাংশ বাড়িতে নিজস্ব ভূগর্ভস্থ পানির নলকূল।

খাবার পানি

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক গ্রামে খাবার পানির সংকট ছিল। বিশেষত খরার সময় চাপকলগুলোতে পানি পাওয়া যেতে না। সেখানে কমবেশি প্রতিটি বাড়িতে এখন নলকূল। বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারের ফলে পানিবাহিত রোগ-ব্যাধি যেমন-ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ কমেছে।

যেসব বাড়িতে নিজস্ব গভীর নলকূল নেই, তারা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক সরবরাকৃত কমিউনিটিভিত্তিক পানি সরবরাহ প্রকল্পের পানি ব্যবহার করছে। এ জন্য মাথাপিছু প্রতি মাসে ১০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। গ্রামের মধ্যে বাসানো হয়েছে পানির পয়েন্টগুলো।

আদিবাসী সাঁওতাল পল্লিতেও রিজর্ভার দিয়ে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দূর হয়েছে খাবার পানি সংকট। বিশুদ্ধ খাবার পানিতে জনগণের শতভাগ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হয়েছে।

গৃহের বাসনকোসন ও আসবাবপত্র

গৃহের আসবাব ব্যবহারের ক্ষেত্রে অমূল পরিবর্তন এসেছে। মাটির চুলা প্রায় নেই বললেই চলে। গ্যাসের চুলা, ফ্রিজ, কোথাও কোথাও ওভেন, প্রেশার কুকার, ইলেক্ট্রনিক চুলা এখন ঘরে ঘরে।

গ্রামের মানুষ খেজুরের পাতার পাটির পরিবর্তে ডায়নিং টেবিল ব্যবহার করছে। কাসার থালা ও গ্লাসের পরিবর্তে সিরামিক ও ম্যালামাইনের ব্যবহার বেড়েছে। বাড়িতে চকচকে টাইলস, শহরের আদলে টবে বর্ণিল ফুলের গাছ সহজেই চোখে পড়ছে।

শিক্ষা-দীক্ষা

আর্থিক সামর্থ্য বাড়ায় এলাকাবাসী তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারছে। এলাকায় গড়ে ওঠেছে স্কুল, কলেজসহ নানামুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সঙ্গে বেড়েছে প্রাইভেট ও কোচিংয়ের প্রববণা। স্কুলগুলোয় ছেলে-মেয়ের উপস্থিতি প্রায় সমান সমান। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতের পরিমাণ বাড়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আবার অনেক শিক্ষিত যুবক চাকরি না খুঁজে আলু বা মাছ প্রজেক্ট ও গরু-ছাগলের খামার করছে। উদ্যোক্তা সৃষ্টির এক নতুন প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

প্রবাসী শ্রমিক

যুবকদের একটা বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। ফলে বিদেশ থেকে অর্থ আসছে যা তাদের পরিবারের জীবনমান বদলে দিতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী শ্রমিকেরা কেবল অর্থই পাঠাচ্ছে না, সঙ্গে করে তারা অনেক মূল্যাবোধ বয়ে আনছে যেগুলো তাদের পরিবার ও নিজস্ব পরিসরেও চর্চিত হচ্ছে।

টয়লেট

গ্রামের মানুষ দ্রুত অনেক কিছু আত্মীকরণ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো টয়লেট। এতো দ্রুত গ্রামের মানুষ বাড়ি থেকে স্থাপিত দূরবর্তী টয়লেটগুলো শোবার ঘরের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করেছে, ভাবতে অবাক লাগে। কারণ এক সময় গ্রামের মানুষ টয়লেট বা পায়খানা বাড়ি থেকে দূরে তৈরি করতে পছন্দ করত।

এমনকি অধিকাংশ বাড়িতে কোনো টয়লেট ছিল না। উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। এখন অনায়াসে নির্মল বাতাস নেওয়া যায়। নানারকম রোগব্যাধি প্রতিরোধে এ টয়লেটগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

ব্যাংক ও অনলাইল ব্যাংকিং

ব্যাংকিং সুবিধা গেছে মানুষের দোরগোড়ায়। প্রবাসী শ্রমিকেরা সহজেই বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছে। বিকাশ, নগদসহ সব ধরনের অনলাইন ব্যাংকিংয়ের সুবিধা হাতের মুঠোয়। আর্থিক সেবা সহজীকরণ মানুষের জীবনমান আমূলে বদলে দিচ্ছে। কমবেশি সবাই অনলাইন অ্যাকাউন্ট মেইনটেন করছে।

রোগব্যাধি

গ্রামগুলোয় জীবাণুঘটিত সংক্রামক রোগের পরিবর্তে জীবনাচারজনিত রোগের খপ্পরে পড়েছে। কায়িক পরিশ্রমের প্রবণতা কমেছে। আগে ডায়রিয়া, কলেরা, হাম-গুটি বসন্তের পরিবর্তে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও ব্লাড প্রেশারের প্রবণতা বাড়ছে। এসবের চিকিৎসা বাবদ গ্রামের মানুষকে এখন অনেক অর্থ খরচ করতে হয়।

ঘাটচর্চা

সকালবেলা পুকুরপাড়ে ঘাটে বসে গ্রামের নারীরা যেসব বিষয়আশয় চর্চা করতেন, তা দূরে সরে গেছে। বাড়িতে স্যাটেলাইট টিভি ও মোবাইল ফোন পরচর্চা কমিয়ে আনতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া গ্রামের নারীদের কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। কাজের প্রতি যে জেন্ডার পক্ষপাত ছিল তাও কমে এসেছে। গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে নারীরা গরু পালন করছেন, সবজি খেতে কাজ করছেন। একইভাবে পুরুষরাও ঘর-কন্নার কাজে সহায়তা করছেন।

বিনোদনকেন্দ্র

এ এলাকা সংলগ্ন দুটি বিনোদনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। একটি ফুলবাড়িতে আরেকটি চাঁন্দুয়া বিলে। বেশ বড়সড়ো পরিসরে বিনিয়োগ হয়েছে। গ্রামের শিশু-কিশোরেরা নানা উৎসব ও পার্বনে সেগুলোতে নিয়মিত যাচ্ছে। আনন্দ উপভোগ করছে। বিনোদন কেন্দ্রগুলো নতুন জনপরিসর তৈরি করছে।

দারিদ্র্য ও সামাজিক বিচ্যুতি

দারিদ্র্যের হার কমে এসেছে। গ্রামগুলোতে দারিদ্র্যজনিত ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মোকদ্দমা নেই বললেই চলে। তবে সামর্থ্য বাড়ার কারণে মানুষের ভেতর বিচ্ছিন্নতাও বেড়েছে। আগে সাত গ্রামের মানুষ ঈদের নামাজ এক জামাতে আদায় করত, এখন তা সাত গ্রামে আলাদাভাবে আদায় হয়।

রাজনীতি

গ্রামের অধিকাংশ মানুষ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। গ্রাম্য রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় রাজনীতির ছায়া পড়েছে গ্রামগুলোয়। আশির দশকে গ্রামে টাউট-বাটপারের আধিক্য ছিল, তা কমে এসেছে। সেই জায়গা অনেকটা দখল করেছে রাজনৈতিক টাউটরা। রাজনীতির বিষয়-আশয় আজ সমাজের সবচেয়ে প্রাধান্যশীল এজেন্ডা। সামাজিক এজেন্ডাগুলো সরে গিয়ে রাজনীতি মূল কনটেন্ট হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। চায়ের দোকান, চুল কাটার সেলুন ও উন্মুক্ত প্রান্তরগুলো বাধ্যতামূলক গল্প শোনার ক্ষেত্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে।

মানুষের মধ্যে সম্পদের মালিকানাবোধ তৈরি হচ্ছে। খাবারের নিশ্চয়তা এসেছে। জাম-কাপড়, গয়নাগাঠি, আসবাবপত্র, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, সবজি চাষ ও বসতভিটা, বাড়ি-ঘরের মালিকানা তৈরি হচ্ছে।

সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় অমূল পরিবর্তন এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চিত্রের খোলনলচে বদলে দিচ্ছে।

লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর