আমি কখনোই বিনা টিকেটে রেলে চড়িনি বা সিনেমা দেখিনি। কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্ধুদের অনেককেই দেখেছি টিকেট কেনার ব্যাপারে দারুণ অনীহা। কেউ মাস্তানি করে, কেউ চুরি করে পার পাওয়ার চেষ্টা করতো। আমার খালি মনে হতো, চেকার যখন এসে টিকেট চাইবে, তখন আমি কী বলবো। এই ভাবনা, এই লজ্জা থেকেই কখনও আমার বিনা টিকেটের যাত্রী হওয়া হয়নি। এখনও নিশ্চয়ই রেলের যাত্রীদের অনেকেই বিনা টিকেটে ভ্রমণ করেন। টিটিই নিশ্চয়ই তাদের ধরেন, জরিমানা করেন। এটাই টিটিইর দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই বরখাস্ত হয়েছেন শফিকুল ইসলাম নামের এক টিটিই।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, খুলনা থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনে ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশন স্টেশন থেকে তিন যাত্রী বিনা টিকিটে এসি কেবিনে ঢাকা যাচ্ছিলেন। এ সময় কর্তব্যরত টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদের টিকিট দেখতে চাইলে তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। টিটিই বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পাকশী বিভাগীয় রেলের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নুরুল আলমের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি সর্বনিম্ন ভাড়া নিয়ে এসি টিকিট না করিয়ে সাধারণ কোচের টিকিট কাটার পরামর্শ দেন। এসিওর পরামর্শ অনুযায়ী টিটিই তাদের ৩৫০ টাকা জনপ্রতি হিসেবে ১০৫০ টাকা নিয়ে তিনটি সুলভ শ্রেণির নন-এসি কোচে সাধারণ আসনের টিকিট দেন। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেয়া ওই তিন যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে কোনো অভিযোগ না করলেও ঢাকায় পৌঁছে রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে টিটিই শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগ পেয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন সংশ্লিষ্ট টিটিইকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন। টিটিই শফিকুল ইসলামকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকর করা হয়।
একটি সভ্য দেশ হলে, দেশে আইনের শাসন থাকলে, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য টিটিই শফিকুল ইসলাম প্রশংসিত হতেন। রেল তাকে সংবর্ধনা দিতো, পদোন্নতির বিবেচনায় তিনি এগিয়ে থাকতেন। কিন্তু ঘটেছে উল্টো ঘটনা। বাংলাদেশ বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিনা টিকেটের তিন যাত্রীর সাথে অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি অবশ্য তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বিনা টিকেটের যাত্রীর সাথে টিটিই খুব সৌজন্যমূলক আচরণ করবেন, এটা আশা করাও ঠিক নয়। বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণ অপরাধ। আর অপরাধীর সাথে নিশ্চয়ই মধুর ব্যবহার করা হবে না। তবে রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেয়ার পরও টিটিই শফিকুল ইসলাম তাদেরকে জরিমানা করেছেন, এসি কেবিন থেকে বের করে দিয়েছেন; এর চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে। অভিযোগে বলা হয়, টিটিই শফিকুল নাকি বিনা টিকেটের যাত্রীদের বলেছেন, রেল কি তোর বাপের। টিটিই আসলে বুঝতেই পারেননি, রেল আসলে রেলমন্ত্রীর আত্মীয়দের পৈত্রিক সস্পত্তি। আর সেই আত্মীয়রা যদি শ্বশুরপক্ষের হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। টিটিই হয়তো বুঝতে পারেননি, বাংলাদেশ এখন ক্ষমতাসীনদের দাপটে চলে। রেলমন্ত্রীর আত্মীয়রা যে মাত্র একটি এসি কেবিন দখল করেছেন, সেটা তো রেলের সৌভাগ্য। চাইলে তো তারা পুরো কামরা বা পুরো রেলই দখল করে ফেলতে পারতেন। বিনা টিকেটের তিন যাত্রী রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়েছেন, এটা শোনার পর লজ্জায় রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করতে পারতেন, সেই তিন আত্মীয়কে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু এটা সব সম্ভবের বাংলাদেশ। এখানে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই যেন অন্যায়।
এখন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দাবি করছেন, তার আত্মীয়দের বিনা টিকেটে ট্রেনে চড়ার বিষয়টি তিনি জানেন না। বিনা টিকেটের যাত্রীরা তার আত্মীয় কিনা তাও জানেন না। এমনকি টিটিইর বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টিও তিনি জানতেন না। মন্ত্রীর অগোচরে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল কীভাবে? মন্ত্রী নাই জানতে পারেন। এখন তো জানলেন। এখন তিনি তার সেই তিন আত্মীয়কে গ্রেপ্তার করুন। সেই তিন আত্মীয়ের নাম পরিচয় সবই তো সবার জানা। টিটিইর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়া ইমরুল কায়েস রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তারের মামাতো বোন ইয়াসমিন আক্তারের ছেলে। অপর দুজন হলেন, শাম্মী আক্তারের মামাতো ভাই ফারুক হোসেন ও হাসান আলী। এখন জানা যাচ্ছে, রেলমন্ত্রী আসলেই কিছু জানতেন না। তার স্ত্রী শাম্মি আখতারের ফোন রেল কর্তৃপক্ষ তদন্ত ছাড়াই সুপারসনিক গতিতে টিটিইকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করেছেন। আসলে সূর্যের চেয়ে বালি সবসময়ই গরম।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের সবার মনে আছে। এক সময় বড় বড় সব অভিযান পরিচালনা করে তিনি জনগণের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। সেই সব অভিযানে অপরাধীদের অনেকে নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এর জেরে পদোন্নতি বঞ্চিত হন সারওয়ার আলম। সাহসী ভূমিকা আর বিভিন্ন অভিযানে অনড় অবস্থানের কারণে যার সবার আগে পদোন্নতি হওয়ার কথা ছিল, তাকেই যখন পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়, তখন নিশ্চয়ই তার মন খারাপ হয়। সারওয়ার আলমও মানুষ। সংক্ষুব্ধ সারওয়ার আলম ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘চাকরিজীবনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়, অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ চাকরিজীবনে পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন এবং এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াটাই অন্যায়।’
একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে সরকার ও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এ ধরনের মন্তব্য করার মাধ্যমে তিনি অকর্মকর্তাসুলভ আচরণ করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়। মামলার রায়ে সারওয়ার আলমকে দোষী সাব্যস্ত করে তাকে তিরস্কার করা হয়েছে। আসলে এ দেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটাই অন্যায়।
আজকের পত্রিকাতেই দেখলাম, পটুয়াখালীর পায়রা সেতুর টোল প্লাজায় সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ কাজী কানিজ সুলতানার আত্মীয়দের গাড়ি বহরের কাছে টোল দাবি করায় তারা টোল আদায়কারীদের ওপর হামলা করেছেন। আমি ঠিক বুঝতে পারি না মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেয়ার পরও কীভাবে টিটিই জরিমানা করে, এসি কেবিন থেকে বের করে দেয় বা এমপির আত্মীয় পরিচয় দেয়ার পরও কীভাবে তাদের কাছে টোল চায়। এত বোকা লোক দেশে এখনও থাকে কীভাবে?
দেশটা আসলে চলছে ক্ষমতার দাপটে। মন্ত্রীর আত্মীয়, এমপির পরিচিত; এভাবেই সবাই চলছে। রাস্তায় পুলিশ গাড়ি আটকালে সরাসরি মন্ত্রীকে ফোন দেয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। ছাত্রলীগ-যুবলীগের দাপটের কথাও আমরা প্রায়ই পত্রিকায় দেখি। পুরো দেশটাই এভাবে চলছে। সবাই মিলেমিশে চলছেন বলে সব ঘটনা খবর হয় না। মাঝে মাঝে দুয়েকজন সারওয়ার আলম অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, দুয়েকজন শফিকুল ইসলাম ঠিকঠাক মতো দায়িত্ব পালন করেন। টোল প্লাজার কর্মীরা এমপির আত্মীয়দের কাছে টোল চেয়ে বসেন। তখনই হইচই পড়ে যায়। তবে ব্যতিক্রমকে উদাহরণ ধরে লাভ নেই। অনিয়মটাই এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক।