বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘…তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়’

  • লাভা মাহমুদা   
  • ৮ মে, ২০২২ ১৬:৩০

আজকের এই শত নৈরাশ্যের প্রাত্যহিক জীবনে একখণ্ড প্রত্যয় আর প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে তিনি আমাদের হৃদয়ে সাহস জোগান । তার বিশাল ভাণ্ডার থেকে যদি এক বিন্দুও ধারণ করা যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই জীবনের বোধ বদলে যাবে। তার সৃষ্টির বৈচিত্র্য আর প্রাচুর্যে বিমূর্ত হয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতির মূল পরিচয় আর শেকড়ের অস্তিত্ব।

জন্মে যে জীবনের জয়গান গেয়েছেন, আজীবন তা বহতা নদীর মতোই প্রবহমান ছিল। নশ্বর এ পৃথিবীতে অমৃত সুধা পান করে আজও তিনি অবিনশ্বর, আপন সৃষ্টিতে। সৃজনের নন্দন কাননকে রাঙা আলোয় আলোকিত করেছেন নিজের কর্ম দিয়ে। তার সৃষ্টিকর্মের পরতে পরতে যেমন উৎসারিত হয়েছে যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না; তেমনি প্রকৃতির সঙ্গে মানব হৃদয়েরও অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। আমরা প্রকৃতির মাঝে খুঁজে পাই ভালোবাসা ও প্রেমের এক অবিমিশ্র উপাদান।

কবিতা, উপন্যাস, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রকর্ম, সংগীত প্রতিটি বিষয় দিয়েই তিনি সুনিপুণভাবে জীবনের মালা গেঁথেছেন, মানব হৃদয়কে ভালোবাসায় আর্দ্র করেছেন। হৃদয়ের গহীন গোপন কোঠরে সংবেদনশীলতার নিদারুণ এক অনুভূতির জন্ম দিয়েছেন, যা ভাবপ্রবণ প্রতিটি বাঙালিকে পরাবাস্তব জগতের সঙ্গে অনুপম সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।

এমন সৃষ্টিশীল মানুষ আর দেখেনি বাংলা সাহিত্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্যবাদের মধ্যেও তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বদরবারে।১৬১ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখের এমনই এক রোদ-ঝড়-বৃষ্টি মাখানো মন্দমধুর দিনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সারদা দেবীর ঘরে প্রভাতের সূর্যের মতোই আলো ছড়াতে এলেন আলোকজ্জ্বল এক রবি, যিনি একক আলোয় উদ্ভাসিত করে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে।দেবেন্দ্র ঠাকুর ছিলেন রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্মের প্রধান সংগঠক, সমাজ সংস্কারক। সেই সনাতন সময়েই জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর বাড়ি ছিল সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র। চার বছর বয়স থেকেই রবির বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয়, শৈশবেই উৎসারিত হতে থাকে তার মেধা ও বুদ্ধির বিচ্ছুরণ।

ছোটবেলা থেকেই কবিতার প্রতি ছিল তার মুগ্ধতা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লাইনটি বাল্যকালেই তাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। বয়স যখন সাত/আট তখন থেকেই তার কবিতা লেখা শুরু, ১৪ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই বনফুল; কলম থামেনি আর বাকি জীবনে। প্রায় আড়াই হাজার গানসহ দীর্ঘ সাহিত্য জীবনে তিনি অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধ রচনা করেন।

তৎকালীন হিন্দুসমাজের উঁচু-নিচু, কৌলিন্য, জাতিভেদপ্রথা তাকে ব্যথিত করত, এর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। তাই জাতপাতের অহংবোধের নাভিমূলে প্রচণ্ডভাবে টান দিয়ে সৃষ্টি করলেন বিখ্যাত উপন্যাস গোরা।১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা এখনও সাহিত্যে কোনো বাঙালির প্রথম অর্জন। আবার দেশের প্রতি প্রবল মমত্ববোধ থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমননীতির পৈশাচিক বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের দেয়া নাইটহুড উপাধি বর্জন করেন।সামাজিক অচলায়তন ভাঙার কারিগররূপে সাহিত্যপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালির অন্তরাত্মায় বেঁচে থাকবেন কাল থেকে কালান্তর। তার দর্শন আর জীবনবোধের উপলব্ধি বাঙালির রোজকার জীবনে অহর্নিশ জোগায় সীমাহীন প্রেরণা।“অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ,তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান।”রবীন্দ্রচর্চাই পারে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি বন্ধ করে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে। তিনি চলে গেছেন কিন্তু উজাড় করে দিয়ে গেছেন তার অমূল্য সৃষ্টির সব কিছু যার চর্চাই কেবল মানব মন কলুষযুক্ত হতে পারে। তাই রবীন্দ্রসৃষ্টি ধারণ করে মানুষ আলোকিত হোক, অন্তরাত্মা পরিশুদ্ধ হোক, হৃদয় সিক্ত হোক, তৃষ্ণায় ফেটে যাওয়া বুকের ছাতি মায়া-মমতা-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হোক, বিকশিত হোক চিত্ত। সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। তার দর্শন চেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।আসলে কবিগুরুর জন্মদিন বলে আলাদা কোনো দিন নেই। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ক্ষণ রবীন্দ্রপ্রেমিক বাঙালির হৃদয়ে আসন পেতে বসে আছেন তিনি। জীবনে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেতে তার বিকল্প আর কে হতে পারে। তার সৃষ্টিকর্মই জীবনের চালিকাশক্তি। সুখ দুঃখের প্রতিটি মুহূর্তই তার গান, কবিতা প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে অন্তরকে; ব্যথিত করে, আলোকিত করে, স্বস্তি দেয়, শান্তি দেয়। কখনও আনন্দাশ্রু বয়ে যায় দু’চোখ বেয়ে, কখনওবা দুঃখের জল। নিমিষেই হালকা হয়ে আসে ভেতরটা।“আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো-আমি কেমন করিয়া জানাব আমার পরান কী নিধি কুড়ালো–ডুবিয়া নিবিড় গভীর শোভাতে”।ভাবি, বাঙালি হয়ে জন্ম না হলে জীবনের এই বোধ থেকেই তো বঞ্চিত হতাম।

আজকের এই শত নৈরাশ্যের প্রাত্যহিক জীবনে একখণ্ড প্রত্যয় আর প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে তিনি আমাদের হৃদয়ে সাহস জোগান । তার বিশাল ভাণ্ডার থেকে যদি এক বিন্দুও ধারণ করা যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই জীবনের বোধ বদলে যাবে। তার সৃষ্টির বৈচিত্র্য আর প্রাচুর্যে বিমূর্ত হয়ে আছে আমাদের সংস্কৃতির মূল পরিচয় আর শেকড়ের অস্তিত্ব। তাই এই বোধহীন সমাজকে বিবেকবান করতে হলে তার লেখাকে পৌঁছে দিতে হবে সর্বসাধারণের কাছে, যা তিনি নিজেই সহজবোধ্য করে গিয়েছেন। সংস্কৃতঘেঁষা দুর্বোধ্য বাংলা, তার হাতেই সহজপাঠ্য, সুখপাঠ্য হিসেবে সাধারণ মানুষের ভাষা হয়ে ওঠে; যা দেড়শ বছর পরেও ঠিক একই রকম হাসায়, কাঁদায়, অনুভূতি জোগায়।মহাকালের এই দিনটিতে ধরার বুকে পদচিহ্ন এঁকেছিলেন তিনি। “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম;নিবিড়, নিভৃত, পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম।”তুমি নীরবে নও, ১৬১ বছর পরেও তুমি আছ হৃদয়ে, খুব সাড়ম্বরে।প্রাণ আকুল করা এই মহামানবের জন্মদিনে হৃদয়ের গভীর থেকে প্রণতি।লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর