বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রবীন্দ্রনাথ: জীবনের পরতে পরতে

  • প্রণবকান্তি দেব   
  • ৮ মে, ২০২২ ১৪:৩১

আমরা যদি একটি আনন্দময় মানবিক জীবন কামনা করি, যদি চাই বিকশিত হোক আমাদের অনুভূতির কলিগুলো তাহলে রবীন্দ্রনাথপাঠ ছাড়া কোনো উপায় নেই। তার সৃষ্টির অমিয়ধারায় অবগাহন করতেই হবে। জীবনখাতার পাতাগুলোকে রঙিন করে তুলতে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যেতে হবে। প্রায়শই যখন আমাদের সংকট দেখা দেয়, তা সে সংকট ব্যক্তিগত হোক আর সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়- আমরা তখন বলি ‘সত্যিকারের মানুষ’ হতে হবে। তা সে সত্যিকারের মানুষ বলতে আমরা কী বোঝাতে চাই? অবশ্যই বিবেকবান, চিন্তাশীল, মানবিকবোধসম্পন্ন হৃদয়বান মানুষ।

পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণ, জন্মতিথি অথবা প্রয়াণ দিবস-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি প্রণতি জানানোর সবচেয়ে বড় পন্থা বোধ করি তাকে পঠন-পাঠন। আমাদের এক জীবনের যত চাওয়া-যত না পাওয়া, যত আক্ষেপ, যত আনন্দ-যত বেদনা, যত সংকট-যত সংগ্রাম, যত প্রেম-যত ব্যাকুলতা- সবকিছু ঘিরেই আবর্তিত রবীন্দ্রসৃষ্টিসমুদ্র। এ সাগরে আবাহন মানে এক অপূর্ব, অমল আনন্দে জীবন কাটিয়ে দেয়া, এ অসীম জলে ডুব দিলে হাতে যে কত মণিমানিক্য উঠে আসে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এত বিপুল, এত ঐশ্বর্যময় তার সৃজনভুবন যে, ওখানে পরম আনন্দে কাটানো যায় দিনের পর দিন, নিজেকে চেনা যায়, নিজেকে গড়া যায়, নিজেকে ভাঙা যায়।

এ কথা বলা যায় হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ না থাকলে সবই বৃথা। তার দর্শনের আলোয় চিত্ত না জুড়ালে এত গান, এত কবিতা, এত শব্দ-সব কিছুই করুণ লাগে। রবীন্দ্রভাবনার জ্যোতি আমাদের মানস সরোবরে যদি না ফোটাই কোনো ধ্রুপদী কুসুম তবে তো ব্যর্থ সব আয়োজন। বলি- ছবিতে নয়, মঞ্চে নয়, কথার ফুলঝুরিতেও নয়, নয় বহুরঙা আলোর ঝলকানিতে- রবি ঠাকুরকে ধারণ করতে হবে মনন ও মগজে। আমাদের কর্মে, চিন্তায় তার আর্দশ, শিক্ষা যদি প্রতিফলিত না-ই হয় তবে বাহ্যিক এসব আয়োজনে কোনো লাভ নেই।

ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা যায় নীরবেও, রবীন্দ্রনাথ এমনই একজন যে, তাকে নদীর পাড়ে, বিজন বনে, নিশুতি রাতে, কোলাহলে- নির্জনে সবখানে পড়া যায়। বলা যায়- জীবনের এমন কোনো শাখা নেই, জীবনসংলগ্ন এমন কোনো গল্প নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রবীন্দ্র অধ্যয়ন আসলে তো আমাদের নিত্য জীবন-অধ্যয়নই।

সাহিত্যের সবগুলো শাখায়ই তিনি চাষ করেছেন, ছড়িয়েছেন স্বপ্নের বীজ। জীবন-সংসারের প্রতিটি আখ্যান তিনি বিধৃত করেছেন তার নানা ধরনের সাহিত্যকর্মে। এই যে বিপুল কর্মপঞ্জিকা, তার কতটুকু অধ্যয়ন আছে আমাদের? এর পাশাপাশি, প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও তার কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে, লেখালেখি চলছে। প্রকৃতপক্ষে, তিনি এমনই এক বিস্ময়কর প্রতিভা ছিলেন, এত সর্বব্যাপী তার চিন্তার প্রভাব যে, আজও তিনি আমাদের কাছে সেই প্রথম দিনগুলোর মতোই আগ্রহভরাতুর দৃষ্টির শামিয়ানায়।

কবিগুরুর সমগ্র রচনার মূলকথা একটাই- মানবের কল্যাণ, শান্তি। জগতের যা কিছু সুন্দর, কল্যাণকর, তিনি তারই গুণগান গেয়েছেন- কখনও হয়ত কবিতায়, কখনও গানে, আবার কখনও হয়তোবা কোনো গল্প, নাটক, গদ্যে।

১৯১৩ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের দামামা। সংঘাতের আশঙ্কায় বিদগ্ধ সমাজ, যদিও যুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। কিন্তু রবি ঠাকুর তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ যার ইংরেজি অনুবাদ ছিল ‘Songs Offerings’ কাব্যগ্রন্থে যেভাবে একটি নির্মল শান্তির পৃথিবীর বার্তা ছড়িয়ে দিলেন সেটা বিশ্বজনীন হয়ে উঠল। সুইডিশ নোবেল বিজয়ী কবি ভারনার ভন হেইডেনস্টাম মন্তব্য করেছিলেন, “গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় যেন এক নির্মল স্বচ্ছ ঝরনাধারার জল পান করছি”। তিনি কবিতাগুলোকে “গভীর ও দুর্লভ আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের নিদর্শন” বলে উল্লেখ করেছিলেন। “গীতাঞ্জলি’র প্রভাব তখন এতটা লক্ষণীয় ছিল যে, যুদ্ধে নিহত তরুণ কবি উইলফ্রেন্ড আওয়েলের বুক পকেটে পাওয়া গিয়েছিল কবিগুরুর কটি পঙক্তি যেগুলোর বাংলা অনুবাদ ছিল- “যাবার বেলায় এই কথাটি বলে যেন যাই/ যা পেয়েছি, যা দেখেছি, তুলনা তার নাই”। এছাড়াও ‘গীতাঞ্জলি’ নিয়ে ইয়েটস, এজরা পাউন্ড প্রমুখের স্তুতি বিশ্বদরবারে সবারই জানা। এরকম প্রায় প্রতিটি রচনাতেই কবিগুরু এক অপার্থিব, স্বচ্ছ, সরল আনন্দের সন্ধান করেছেন। জীবন ও প্রকৃতির সুধারস পান করেছেন অমৃত আনন্দের জন্য। বিশেষ করে তার মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, পূরবী, মহুয়া, বলাকা, শ্যামলী, চৈতালী, খেয়া ইত্যাদি গ্রন্থের কবিতাগুলো অমল আবেশে ছুঁয়ে যায় হৃদয়।

অন্যদিকে, তার ছোট গল্প কিংবা উপন্যাসগুলো ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি আমাদের সমাজ ও সংসারের কত সংকট, কত বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে তা এগুলো না পড়লে উপলব্ধি করা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ তার রচনা দিয়ে আমাদের যাপিতজীবনের যে নিখুঁত ছবি এঁকেছেন তা হৃদয়ঙ্গম করতে হলে শুধু পাতা উল্টিয়ে গেলেই হবে না। চোখের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ ঘটাতে হবে।

রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। আমাদের চলমান জীবনের বাঁকে বাঁকে জমে থাকা কাহিনিগুলোকেই তিনি প্রাণ দিয়েছেন ছোট গল্পে। তার কালজয়ী হৈমন্তী, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, দেনা পাওনা, কাবুলিওয়ালা প্রভৃতি গল্পগুলো মানসলোকের একেবারে গভীরে নাড়া দেয়। আমরা যে জীবনকে দেখি সাদা চোখে, তার ভেতরের নানা কথা ফুটে উঠেছে এসব গল্পে। অন্যদিকে, তার উপন্যাসগুলো বিশেষ করে বো ঠাকুরানীর হাট, চোখের বালি, নৌকাডুবি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে। এসবের বাইরে রবি ঠাকুরের গানের যে জগৎ তার তুলনা পাওয়া মুশকিল। সুর ও কথার যে ইন্দ্রজাল তিনি রচনা করে গেছেন, মানুষের চিত্তে তার আবেদন ফুরাবে না কোনোদিনও।

কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথকে অনুশীলন করতে হবে। আমরা যদি একটি আনন্দময় মানবিক জীবন কামনা করি, যদি চাই বিকশিত হোক আমাদের অনুভূতির কলিগুলো তাহলে রবীন্দ্রনাথপাঠ ছাড়া কোনো উপায় নেই। তার সৃষ্টির অমিয়ধারায় অবগাহন করতেই হবে। জীবনখাতার পাতাগুলোকে রঙিন করে তুলতে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যেতে হবে। প্রায়শই যখন আমাদের সংকট দেখা দেয়, তা সে সংকট ব্যক্তিগত হোক আর সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়- আমরা তখন বলি ‘সত্যিকারের মানুষ’ হতে হবে।

তা সে সত্যিকারের মানুষ বলতে আমরা কী বোঝাতে চাই? অবশ্যই বিবেকবান, চিন্তাশীল, মানবিকবোধসম্পন্ন হৃদয়বান মানুষ। সেই ‘সত্যিকারের মানুষ’, সার্থক মানুষ হতে গেলে তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পড়তেই হবে। যে মাটির উপর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, যে বায়ু তার শরীর জুড়ায়, যে ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ তাকে পাহারা দেয়, যে জল তার তৃষ্ণা মিটায় অহর্নিশ- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এসবেরই বন্দনা করেছেন। মানুষকে তাই নদী-জল-আকাশকে বুঝতে হলে রবিচর্চা করতে হবে।

যে প্রেম ছাড়া অপূর্ণ থাকে মানবসত্তা, রবীন্দ্রনাথ তো সে প্রেমেরই কবি। মোটকথা, একটি সর্বাঙ্গীন সুন্দর জীবনের জন্য রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরম আশ্রয়। মানুষের জীবনকে বুঝতে হলে, মানবজীবনের ধারাপাত জানতে হলে রবীন্দ্রনাথকে অনুশীলনের বিকল্প নেই। সিলেবাসের বইগুলোর বাইরে যে বিশাল বইয়ের দুনিয়া আছে, তার ভেতর ডুব দিতে পারলে জীবন বহুগুণে অর্থময় হয়ে ওঠে। রবি ঠাকুরের রচনাসমগ্র, তার ভাবাদর্শ অনুশীলন ছাড়া হৃদয়ের উন্নতি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমাদের পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত। সার্টিফিকেট অর্জনের শিক্ষার পাশাপাশি সন্তানদের বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

কবির কথা ধার করে নিয়ে বলি ‘‘বিদ্যুতকে মানুষ লোহার তার দিয়ে বাঁধিয়াছে কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে? কে জানিত সঙ্গীতকে হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মা আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে? কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে, অতলস্পর্শ কাল-সমুদ্রের উপর একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে?”

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

এ বিভাগের আরো খবর