বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্স পাঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমজীবীরা। বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে আরও রয়েছেন মধ্যবিত্ত এবং কিছুসংখ্যক উচ্চবিত্ত। মধ্যবিত্তরা বিদেশে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তাদের মধ্যে আছেন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, অধ্যাপক প্রভৃতি। বিদেশে এসব পেশার মানুষ সন্তোষজনক আয় করেন। তবে এ ধরনের পেশাজীবী দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠান, তা সমগ্র রেমিট্যান্স আয়ের তুলনায় ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। শ্রমজীবীরা যে আয় করেন, তা কোনোক্রমেই সন্তোষজনক নয়। অভিযোগ আছে, সঠিকভাবে দরকষাকষি না করার ফলে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা অন্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় কম মজুরি পান। এর প্রধান কারণ বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা কম থাকে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’ নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী পুরুষদের পাশাপাশি প্রবাসী নারীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। এক জরিপে দেখা গিয়েছে, দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কারণ নারীরা তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই পাঠিয়ে দেন দেশে।
বাংলাদেশের নারীরাও এখন প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকের সংখ্যা খুব কম নয়। বিদেশের মাটিতে কাজ করা নারীদের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। প্রবাসী নারীদের একটি বড় অংশ গৃহকর্মী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যান। ২০১৪ সাল থেকে বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিক সৌদি আরবে যেতে শুরু করে। এই নারী শ্রমিকরাও সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, কাতার, লেবানন প্রভৃতি দেশে গিয়ে দেশত্যাগের খরচ বাড়ানোর পাশাপাশি অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে বিদেশেও নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এত ত্যাগ স্বীকার করেও তারা নানা সমস্যায় ভুগছেন।
যেসব নারী শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যান, তারা বেশি শিক্ষিত নন এবং অদক্ষ। যার কারণে যাদের অন্যান্য যোগ্যতা ও দক্ষতা নেই তাদের বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতে হয়। সুনির্দিষ্ট চুক্তি না থাকায় এবং ছুটির ব্যবস্থা না থাকায় তাদের দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। তারা ঠিকমতো বেতন পান না, এরই মধ্যে কাজের সামান্য ত্রুটি হলে অনেক নারীকে শারীরিক নির্যাতনও করা হয়। অনেক নারীকে নানা ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখানো হয়, অনৈতিক সম্পর্কে বাধ্য করা হয় এবং যৌন নির্যাতন করা হয়।
বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং স্থানীয়দের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিদেশে রাষ্ট্রীয় দূতাবাস স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু অনেক নারী শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হলে দূতাবাসে অভিযোগ জানাতে পারেন না। তাদের অনেকেই বিব্রত হওয়ার ভয়ে অভিযোগ করতে দ্বিধাবোধ করেন। এসব প্রবাসী শ্রমিক বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করেন। তাদের আহার-বাসস্থানের সুযোগ-সুবিধাও সন্তোষজনক নয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ে সমৃদ্ধ হচ্ছে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে যেসব পণ্যসামগ্রী আমদানি করা হয়, তার জন্য প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্সের অর্থ ব্যয় করা হয়। বাংলাদেশের আমদানি দ্রব্যের অর্থায়নে প্রবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশে সম্পদবৈষম্য সৃষ্টিতে এক অর্থে রেমিট্যান্সের একটি ভূমিকা আছে। প্রায় ৭০ হাজার নারী শ্রমিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বর্তমান বছরে সৌদি আরব, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করে বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রমশক্তি রপ্তানি নিয়ে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কী সমঝোতা হয় তার ওপর। এ ছাড়া শ্রমশক্তি আমদানিকারক দেশগুলোয় চাহিদাও একটি বড় নিয়ামক। ফিলিপাইন থেকে অনেক নারী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় কাজ করতে যান। তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ফিলিপাইনের নারী শ্রমিকরা বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের তুলনায় অনেক বেশি মজুরি পান।
ফিলিপাইনের নারী শ্রমিকরা বেশ স্মার্ট। তারা তাদের স্মার্টনেস দিয়ে নিয়োগকারী মালিকদের সংযত আচরণে বাধ্য করে, যা বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না বলে জানা যায় বিভিন্ন উৎস থেকে। যে নারী শ্রমিকরা বিদেশে টিকে থাকতে পারেননি, তারা যদি লিখতে জানতেন তাহলে তারা বিপদে পড়তেন না। নীতিনির্ধারকরা প্রবাসী নারী শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়নে সক্ষম হবেন। এ দেশে গরিব মানুষের সমস্যা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের আরও কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের দূতাবাসে শ্রম উইং স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও কাঙ্ক্ষিত সেবাদান করা হচ্ছে না বলে নানা অভিযোগ রয়েছে। যেকোনো প্রকল্পে সাফল্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন এবং এগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ এখনও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নিম্নে অবস্থান করছে। নিম্নমাত্রার কর্মসংস্থানের সমস্যা থেকে মুক্ত হওয়ার পথ হলো উন্নত মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল সৃষ্টি।
প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে আমাদের সামনে আসে যে নারী শ্রমিকদের অনেককেই বিরতিহীন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হয়। সঠিক বেতন সময়মতো পরিশোধ না করা, দীর্ঘ সময় খেতে না দেয়া ছাড়াও নিরাপত্তাহীনতা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদেশফেরত ৩৫ শতাংশ নারীই শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার আর ৪৪ শতাংশ নারীকে তাদের পাওনা বেতন পরিশোধ করা হয়নি। মহামারির বছর ২০২০ সালে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৯৭ কর্মী এর মধ্যে ৫০ হাজার ৬১৯ জন নারী। এদের মধ্যে বেশির ভাগ নারী কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার।
দেশে ফিরে আসা অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, বিদেশফেরত নারী শ্রমিকের ৫৫ শতাংশ শারীরিকভাবে ও ২৯ শতাংশের মানসিক অসুস্থতা রয়েছে এবং ৮৭ শতাংশ দেশে এসেও মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা পাননি।
এর পরও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নারীরা যাচ্ছেন নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের আশায়। পরিবারকে সচ্ছলতা দেয়ার স্বপ্ন নিয়ে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কিন্তু তাদের অনেকের মুখের হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো পড়ছে অথই সাগরে। মধ্যপ্রাচ্যে বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে নারী শ্রমিক পাঠানোর আগে তাদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে নারী শ্রমিকদের সব রকমের নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। গৃহকর্মী পেশার পরিবর্তে যদি কেয়ার গিভার, গার্মেন্টস বা অন্য পেশায় পাঠানো যায়, তাহলে নারী শ্রমিকদের জন্য ভালো হয়।
প্রবাসে নারী শ্রমিক কোনো নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হলে জরুরি তাদের সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। প্রবাসে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের দেশের দূতাবাস ও সরকারকে কাজ করতে হবে। বিদেশের মাটিতে যেমন নারী শ্রমিকদের প্রত্যাশিত জীবন নিশ্চিতে কাজ করতে হবে, তেমনি দেশে ফিরে আসার পরও তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতে পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রমিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান সুযোগ বৃদ্ধি এবং অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট দূতাবাসগুলোকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
করোনাকালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পূর্ণ করা আর যাবৎকালের সর্বোচ্চ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান প্রবাসী শ্রমিকদের। গত অর্থবছরে প্রবাসীরা প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন দেশে। বিশ্বের যে তিনটি দেশ রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে করোনাকালে এগিয়ে ছিল, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আর রেমিট্যান্স অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। এ ক্ষেত্রে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও এগিয়ে এসেছেন।
এক হিসাবে দেখা যায়, বিদেশ যেতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়, তা গড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে নারী কর্মীরা দেশে পাঠিয়ে দিতে পারেন। সাধারণত দেখা যায়, পুরুষ শ্রমিকরা তাদের আয়ের ৭০-৮০ শতাংশ দেশে পাঠান। কারণ নিজেরা নানা ধরনের কাজে কিছু টাকা খরচ করে থাকেন। আর নারী কর্মীরা পাঠান তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই। যদিও পুরুষ শ্রমিকদের আয় বেশি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।
সরকার বিদেশের বন্ধ শ্রম কর্মসংস্থান চালু করা, বিদ্যমান কর্মসংস্থান সুদৃঢ় করা এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান চালু করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অভিবাসী শ্রমিকদের পরিবারের কল্যাণের জন্য ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে আরব আমিরাত ও গ্রিসে কর্মসংস্থানের চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। দীর্ঘদিনের অচলায়তনে থাকা মালয়েশিয়ার সঙ্গেও চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে সম্প্রতি।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের বিদেশে যাওয়ার খরচ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আয় সব দেশের চেয়ে কম। এটি আমাদের অভিবাসীদের প্রধান অন্তরায়। অভিবাসনের ক্ষেত্রে দালালরা সক্রিয়। তাদের নেটওয়ার্ক সরকারি অফিসেও রয়েছে। এসব নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে অভিবাসীদের বিদেশ গমনের খরচ কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
অভিবাসী বা দেশের শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় আইএলও কাজ করে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে। আমরা চাই গোটা বিশ্ব এসব কনভেনশন গ্রহণ করবে। এতে যেকোনো কর্মী বা শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত হবে। শ্রমিকের অধিকার রক্ষার জন্য সামাজিক সুরক্ষা সৃষ্টি করা উচিত।
কোনো শ্রমিকের অধিকার ক্ষুণ্ন হলে যেন সব পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করতে পারে। বেসরকারি খাত সব পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আইএলওর সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষা। ২০১৩ সালে অভিবাসীদের নিয়ে নতুন আইন হয়েছে। ২০১৬ সালে নতুন পলিসি হয়েছে। ২০১৭ সালে একটি নতুন বিধি গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট অনুমোদিত হয়েছে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সরকার আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছে। এখন সরকারের উচিত হবে এসব আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক