বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ঈদ আনন্দ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ৬ মে, ২০২২ ১৩:৪৯

অর্থনৈতিক বৈষম্য একটা দেশের জন্য ভয়াবহ রকমের হুমকি। দেশের উন্নয়নের জন্যও হুমকি। এর অর্থ সরকারের নেয়া আর্থিক পরিকল্পনার সুফল দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক, আর্থিক বৈষম্য যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে সত্যিকার উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। আর প্রশ্নও থেকে যায়, দেশ যে উন্নয়নের পথে হাঁটছে, সে উন্নয়ন আসলে কাদের জন্য?

টানা দুই বছর পর করোনার প্রভাবমুক্ত ঈদ উদযাপন করল বাংলাদেশ। কিন্তু ঈদটা কতখানি আনন্দদায়ক হলো? ঈদ আনন্দের সঙ্গে আর্থিক বিষয় জড়িত। বাংলাদেশের কত শতাংশ মানুষ ঈদের আনন্দ করার মতো আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান?

বাংলাদেশে সবই বেড়েছে। জিডিপি বেড়েছে। উন্নয়ন বেড়েছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। অর্থাৎ গরিব মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেশের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫ শ ৫৪ ডলার। অর্থাৎ ২ লাখ ২০ হাজার ৮শ ১৩ টাকা বা ২ লাখ ২১ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক বছরে দেশে একজন মানুষের গড় আয় ২ লাখ ২১ হাজার টাকা। তাহলে দৈনিক আয় কত? ৬০৫ টাকার সামান্য কিছু বেশি।

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর শতকরা ৮৮ ভাগ মানুষ ছিল দরিদ্র। বৈরী ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব নিয়ে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে হাত দিলেন বঙ্গবন্ধু। চারদিকে তখন ব্যাপক হাহাকার। সড়ক-বন্দর, সেতু- প্রায় সবই বিধ্বস্ত। তার ওপর বন্যা ও খরায় কাঙ্ক্ষিত ফসলের উৎপাদনও হয়নি। ওই সময় আরও একটা বিষয় ছিল লক্ষণীয়। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র সোনা থেকে ডলারে পরিবর্তন করার প্রথা তুলে নেয়। এই প্রথা তুলে নেয়ার আগে সোনা দিয়েই আর্ন্তজাতিক পণ্য কেনার সুযোগ ছিল।

আর প্রথা উঠে যাওয়ার পরে ডলার দিয়েই পণ্য কেনার বাধ্যবাধকতা তৈরি করে ফেলে। ফলে ৩ ডলারের এক ব্যারেল তেলের দাম হয়ে যায় ১১ ডলার। গমের টন ৮০ থেকে হয়ে যায় ২৪০ ডলার। সারের দাম টনপ্রতি ৮০ থেকে হয়ে যায় ২০০ ডলার। পুরো পৃথিবীতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। এর পরেও ১৯৭৪ সালের ৬০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে ১৯৭৫ সালে কমিয়ে ৩০-৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনেন বঙ্গবন্ধু। তার তিন বছরের শাসনামলে মাথাপিছু আয় ৯৩ থেকে ২৭১ ডলারে উন্নীত হয়েছিল।

(সূত্র: https://www.mujibolympiad.gov.bd/quiz/content/30)

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দীর্ঘ সামরিক শাসনে দেশের গরিব মানুষের খুব একটা উন্নতি হয়নি। গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১০ সালে দেশে দরিদ্রতার হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর দারিদ্র্যের হার কমানোর উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তৈরি হয় রূপরেখা। সে রূপরেখায় আশা করা হয় ২০১৫ সালে দারিদ্র্যের হার নেমে আসবে ২২ দশমিক ৫ এবং ২০২১ সালে ১৩ দশমিক ৫ শতাংশে।

২০২০ সালে অতিমারির কারণে দেশের প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এবং দারিদ্র্যের হার কমার বদলে বেড়ে যায় হু-হু করে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারের নেয়া অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলো আশানুরূপ ফলাফল আনতে পারেনি। তার ওপর মহামারির পর দেশের ৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা সাত কোটিরও বেশি।

এখন প্রশ্ন হলো, মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু ওদিকে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, তাহলে আয় বাড়ল কার?

এবার আরেকটা তথ্যের দিকে নজর দেয়া যাক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদনে দেখা যায়- ২০০৯ সালের জুন শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৪ শ ৯২ জন। ২০২১ সালের জুন শেষে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৯ হাজার ৯শ ১৮ জন। অর্থাৎ বিগত ১৩ বছরে ব্যাংক ব্যবস্থায় নতুন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৭৮ হাজার ৪শ ২৬ জন।

ওদিকে ২০২০ সালের মার্চে দেশে যখন করোনা মহামারি আবির্ভাব শুরু হয়, তখন ব্যাংকে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬শ ২৫টি। আর ২০২১ সালের জুনে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৯শ ১৮টি। অর্থাৎ করোনাকালের দেড় বছরে নতুন করে কোটিপতি হয়েছেন ১৭ হাজার ২শ ৯৩ জন।

যদিও দেশে সত্যিকারের কোটিপতির সংখ্যা কত তার কোনো হিসাব নেই। তবে ২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে ওয়েলথ-এক্স-এর প্রতিবেদনে বলা হয় ৩ কোটি ডলার বা আড়াইশ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। ওয়েলথ-এক্সের হিসাবে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৭ শতাংশ হারে। অবাক হলেও সত্যি যে, এ হার ছিল যুক্তরাষ্ট্র-চীন, জাপান, ভারতসহ ৭৫টি বড় অর্থনীতির দেশের চেয়ে বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২শ ৩৯টি। তার মানে করোনা মহামারিতেও দেশে দৃশ্যমান কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। অদৃশ্য কোটিপতির সংখ্যা এর কয়েকগুণ নিঃসন্দেহে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি আবুল বারকাত গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর অর্থনীতি সমিতির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে মূল প্রবন্ধে জানিয়েছেন, করোনার আগে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ। ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মাত্র ৬৬ দিনে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৮০ লাখ। অর্থাৎ করোনায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। (সূত্র: বাংলাট্রিবিউন ২৬ ডিসেম্বর ২০২১)

দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্র দিয়ে কিংবা জিডিপির গ্রোথ দিয়ে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে না। বলা যায়, দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, অপরদিকে ধনীর সংখ্যাও বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে অতিধনীর সংখ্যাও বাড়ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম জায়গায় এসে পৌঁছেছে।

২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকারের দুই বছরপূর্তিতে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শেষে ২০২৫ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসবে বলে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এই আশা প্রকাশ করেছেন।

অর্থনৈতিক বৈষম্য একটা দেশের জন্য ভয়াবহ রকমের হুমকি। দেশের উন্নয়নের জন্যও হুমকি। এর অর্থ সরকারের নেয়া আর্থিক পরিকল্পনার সুফল দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক, আর্থিক বৈষম্য যে হারে বেড়ে চলেছে, তাতে সত্যিকার উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। আর প্রশ্নও থেকে যায়, দেশ যে উন্নয়নের পথে হাঁটছে, সে উন্নয়ন আসলে কাদের জন্য?

১৮ কোটি মানুষের দেশে যেখানে সাতকোটি মানুষই দরিদ্র, সে দেশে ঈদ কতখানি আনন্দ বয়ে আনে, সেটা কিন্তু ভাববার বিষয়।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর