বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এক অন্যরকম অর্থমন্ত্রী

  •    
  • ১ মে, ২০২২ ১৭:৪৮

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে মুহিত স্যার সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিনি একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। লেখক হিসেবেও মুহিত সমান পারদর্শী।

সদ্যপ্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত একটা কথা বার বার বলতেন, খুব জোর দিয়ে বলতেন: ‘এই দেশে হরতাল-অবরোধ থাকবে না, জ্বালাও-পোড়াও থাকবে না, অর্থনীতির ক্ষতি হয়– এমন কর্মসূচি চিরতরে প্রত্যাখ্যান করবে দেশের মানুষ।’

টানা দশ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার শেষদিকে ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলনের শেষদিনে সম্মেলনে অংশ নেয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক খোলামেলা আলোচনায় বসেছিলেন মুহিত স্যার। সাংবাদিক হিসেবে ওই প্রতিনিধি দলের একজন সদস্য ছিলাম আমি। তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘স্যার, দেশে হরতাল-অবরোধ নেই, জ্বালাও-পোড়াও উধাও হয়ে গেছে, তাহলে কি আপনি যা বলেছেন এতদিন, তাই হতে চলেছে দেশে? কী করে বুঝতে পেরেছিলেন এমনটা হবে দেশে?’

কিছুটা গম্ভীর হয়ে অদ্ভুত একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ডান হাতটা নিজের মাথায় ঠেকিয়ে বলেছিলেন, ‘শোনো বলি, হারমাছি, এই মাথা-অভিজ্ঞতা দিয়ে দেশের মানুষকে আমি জেনেছি, বুঝেছি, চিনেছি, তাদের আকুতি-চিৎকার, অন্তরের চাওয়াই আমাকে বার বার বলিয়েছে, এ দেশে আর কোনো ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবে না। দেখ, এখন বাস্তবে তাই হচ্ছে। মানুষ নিজেকে চিনেছে, ভালোটা বুঝতে শিখেছে, দেশের ভালোটা ভালোভাবে বুঝতে শিখেছে।’

সত্যিই অদ্ভুত! বাংলাদেশে এখন উঠতে-বসতে হরতাল ডাকে না কোনো রাজনৈতিক দল। জ্বালাও-পোড়াও নেই; নেই জঙ্গি হামলা। স্যারের জোর দিয়ে বলা কথাগুলোর জোরালো প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশে।

এই দেশকে সব দিক দিয়ে উজাড় করে দেয়া মানুষটিই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন শুক্রবার গভীর রাতে। শুধু দেশ নয়, দেশের মানুষকে নয়, নিজেকেও তিনি চিনেছিলেন পরিপূর্ণভাবে।

তাই তো স্যার নিজেকে নিয়ে বলেছেন, ‘আমি আমার জীবন নিয়ে গর্বিত। অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয় বরং এর জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। প্রাপ্তির নিয়ম-কানুন ঠিক করা এবং সেগুলো প্রতিপালনের দায়িত্ব নেয়া, এটা জীবনের একটি বড় শিক্ষা।’

গত ১৬ মার্চ জীবনের সবশেষ অনুষ্ঠানে ঠিক এমনভাবেই নিজের জীবন সম্পর্কে অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন ভাষা সৈনিক, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার মতো করে নিকটকালে নিজের জীবন সম্পর্কে ঠিক এভাবে ‘তৃপ্তিবোধ’ করতে শুনিনি কাউকে। একজন আবুল মাল মুহিত যে জীবন যাপন করে গেছেন, তাকে এক কথায় পরিপূর্ণ জীবনই বলা চলে।

সে কারণেই জীবন নিয়ে তার এই উচ্চারণকে আত্মগরিমা বলার উপায় নেই। ভণিতাহীন তার এই অকপট স্বীকারোক্তি স্যারের ব্যতিক্রম প্রজ্ঞারই পরিচায়ক। নিজেকে জানতে পেরেছিলেন বলেই, এমনটি বলতে পেরেছিলেন তিনি। আর সেই গর্ববোধ নিয়েই গর্বিত জীবনের ইতি টেনেছেন সময়ের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতি হারিয়েছে একজন নিখাদ দেশপ্রেমিককে, অদ্ভুত-দুর্দান্ত একজন সাদা মনের মানুষকে।

মুহিত স্যারের কাছে তার জীবন ছিল ‘মহাতৃপ্তির, মহাপ্রাপ্তির’। ৮৮ বছরের সেই কর্মময় জীবনের যবনিকা টেনে চিরবিদায় নিলেন টানা ১০টিসহ মোট ১২টি বাজেট দিয়ে অনন্য রেকর্ড সৃষ্টিকারী সাবেক এ অর্থমন্ত্রী।

মুহিত স্যারের নাম শুনেছি সেই ছোটবেলা থেকে। পরিচয় বা সখ্য গড়ে ওঠে ২০০৯ সাল থেকে, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে, বলা যায়, স্যার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর দিন থেকে। সেই যে শুরু, সচিবালয়-অর্থমন্ত্রণালয়-ইআরডি, বাজেটের সময় জাতীয় সংসদে কত স্মৃতি কত কথা…স্যার বলছেন, নোট নিচ্ছি, দ্রুত লিখে অফিসে রিপোর্ট পাঠাচ্ছি। দিন-মাস-বছরের পর বছর।

একদশক চলে গেছে এভাবে। মাঝেমধ্যে স্যারের সঙ্গে চলে গেছি সিলেটে। সাক্ষাৎকার নিয়েছি ভিন্ন পরিবেশে, নতুন আঙ্গিকে। দশ বছরে স্যারের কত সাক্ষাৎকার নিয়েছি, তার সংখ্যা বলতে পারব না। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গেছি স্যারের সঙ্গে; ছয়-সাতবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছি; পেরু গিয়েছি, ফিলিপাইন গিয়েছি, ভারত গিয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, স্যারের হাত ধরেই আমি বিশ্ব দেখেছি, জেনেছি-শিখেছি অনেক কিছু, যা আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে।

আমার এই লেখায় বার বার ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করছি মুহিত স্যারকে। এ ছাড়া আমার পক্ষে কিছু লেখা সম্ভব নয়। শুধু আমি নয়, আমরা যারা ২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রণালয়, সচিবালয়, ব্যাংক, পুঁজিবাজার বিট কাভার করেছি, তারা সবাই মুহিত স্যারকে ‘স্যার’ বলে ডেকেছি। এমনকি অনেক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককেও এই শিশুমনের মানুষটিকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে শুনেছি।

সেই ‘স্যার’ চলে গেলেন, একজন অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক, ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবেশবিদ চলে গেলেন।

অর্থনৈতিক কূটনীতিতে মুহিত স্যার সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিনি একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। লেখক হিসেবেও মুহিত সমান পারদর্শী। মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস, জনপ্রশাসন এবং রাজনৈতিক সমস্যা-বিষয়ক বইসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৩০টির বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে তার।

আবুল মাল আবদুল মুহিত মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসৈনিক, কলমযোদ্ধা এক প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ‘প্রতিষ্ঠান’। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম পুরোধা পুরুষ ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের খেলাধুলার অঙ্গনেও তার শক্তিশালী ভূমিকা ছিল। পরিণত বয়সে উচ্চ দায়িত্ব পালনের সময় খেলাধুলার প্রসারে তিনি সহায়ক ভূমিকা রেখেছেন।

চিত্রকলা ও সংগীতের প্রতিও সম্মানজক জ্ঞান ও আগ্রহ ছিল তার। বাংলাদেশের শিল্পী ও সাহিত্যিক সমাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব, পারস্পরিক সম্মানবোধ ও সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল এই গুণী মানুষের। রাতভর মাঠে বসে ধ্রুপদি সংগীতের স্বাদ গ্রহণ করতেন তিনি। আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক অনষ্ঠান আয়োজনেও অকাতরে সহযোগিতা করেছেন; প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দ দিয়েছেন।

এমন প্রজ্ঞা ও গভীর জ্ঞানের অধিকারী আবুল মাল আবদুল মুহিত ‘স্যার’ এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিরন্তর। ওপারে ভালো থাকবেন ‘স্যার’। বাংলাদেশ আপনাকে মনে রাখবে চিরকাল।

লেখক: সাংবাদিক।

এ বিভাগের আরো খবর