ঈদযাত্রা চলছে। যে যেভাবে পারে শেকড়ের টানে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছে। রেলের ছাদে উঠতে মই ভাড়া নেয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। একই সঙ্গে সব পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি এখনও আলোচনায় আছে। ফেরিঘাটের ভোগান্তি, লঞ্চ-রেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার দৃশ্য আমরা দেখছি বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এ দৃশ্য নতুন নয়। তারপর এসব কথা এবারও বলতে হচ্ছে। এই ভোগান্তি যেন এ দেশ ও সমাজের অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে। ঈদ আসে যতবারই অঅসে ততবারই একই দৃশ্য আমরা দেখি।
শেকড়ের টানে মানুষ বাড়ি ফেরে, এর জন্য কত কষ্ট সহ্য করতে হয়। এর মধ্য দিয়ে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, দেশের বৃহত্তম উৎসবটিত নির্বিঘ্ন ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাড়ি যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টিতে কোনো কর্তৃপক্ষের যেন দায় নেই।
রমজান মাস চলছে। রমজান শেষেই উঠবে খুশির চাঁদ। রমজানে বিশ্বের ইসলামি দেশগুলোয় সব পণ্যের দাম কমে। দ্রব্য বিক্রিতে কত রকমের ছাড় থাকে। আমাদের দেশে তার উল্টো পরিবেশ। একশ্রেণির ব্যবসায়ী মুনাফা লাভে যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। মূল্যবোধের বালাইমাত্র নেই। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা আদায় করে। রমজানের আগে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের সরকারি যত পরিকল্পনেই করুক তা সাধারণ মানুষের কোনো কাজে আসেনি। সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে করতে পারেনি।
রমজান উপলক্ষে কৃষক যে লাভবান হয়েছে তা নয়। গত ২৫ এপ্রিল রংপুরের কৃষকরা আলু ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মহাসড়কে আলু ফেলে বিক্ষোভ করেছে সে খবর গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। আলু রোপণ থেকে পরিচর্যা ও কোল্ড স্টোরেজে রাখা পর্যন্ত তাদের প্রতি কেজিতে খরচ হয়েছে ১১ থেকে ১৩ টাকা। কিন্তু এখন মাঠে বিক্রি হচ্ছে ৯ থেকে ১০ টাকা। অনেকেই ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেছে, তারা অসহায় হয়ে পড়েছে।
এছাড়া কৃষকদের মহাবিপদ থেকে উদ্ধারের সিন্ডিকেট চক্রকে নস্যাৎ করার আহ্বান জানান কৃষকরা। এই ঘটনার উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে ঈদ-উৎসবের পাশাপাশি মহান মে দিবসও রাত পোহালেই। শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকের সংগ্রামের স্মরণীয় দিন এটি। ১৮৮৬ সালের এদিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য ও দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল শ্রমিকরা। আন্দোলনে বেশ কিছু শ্রমিক আত্মাহুতিও দিয়েছিল। তাদের সেই আত্মত্যাগের স্মরণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশও দিবসটি ‘ মে দিবস’ হিসেবে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। আর যাদের জন্য দিবসটি, তাদের কাছে আর পাঁচ-দশটা দিনের মতেই মনে হয়। এ দিবস নিয়ে বর্তমান বাস্তবতায় তাদের তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই। তাদের কাছে আসে নেহায়েত ৩০ এপ্রিলের পরের দিন ১ মে সেই হিসেবে।
শ্রম আইনে শ্রমিকের সংজ্ঞায় কৃষিশ্রম অন্তর্ভুক্ত হলেও ব্যবস্থা নেই কৃষিখাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের। ফলে এ খাতে নিয়োজিত শ্রমিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তেমনই তারা বঞ্চিত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকেও। করোনার এই মহাদুর্যোগকালে ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রমিক ভাবতেইপারে না। এমনটা চলতে থাকলে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। সম্প্রতি চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে লেবাননের সরকার দেশটিকে ‘দেউলিয়া’ ঘোষণা করেছে। এদিকে আর্থিক দুরবস্থা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কাকে। সব কিছুর মূলে ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা মূল্যবোধ, নৈতিকতার সংকট। পুঁজির অসম বিকাশের প্রধান নিয়ামকই হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা।
এই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আামরা দেখছি দেশ বহু আগে থেকে ৮০ ও ২০ ভাগে বিভক্ত। মাত্র ২০ ভাগ মানুষ দেশের সব সুবিধা ভোগ করে আর ৮০ ভাগ মানুষ বঞ্চিত হয়। এই ২০ ভাগ মানুষের কারণে ভোক্তাদের ঠকতে হচ্ছে। এই ভোক্তাও ৮০ ভাগের মধ্যে। পাকিস্তান আমলে এ দুর্দশাজনক বাস্তবতা আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। যা থেকে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেছি। চরম ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করলেও এই চক্র থেকে আমরা মুক্তি পাইনি। যেজন্য আজ স্বাধীনতা লাভের আনন্দের জায়গায় বিষাদ দখল করে নিচ্ছে।
আসলে, এ দুর্দশা স্থায়ী রূপ পেয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাতে চালু হওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এর ফলে ব্রিটিশ শাসক, তাদের পদলেহী ও বাংলার কৃষকদের মাঝে কয়েক স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী তৈরি হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রভু, জমিদার, জোতদার, নায়েব, বরকন্দাজ সবার ‘খাই’ মেটাতে উৎপাদক শ্রেণি কৃষক হয়ে পড়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর। এখন ব্রিটিশ শাসক নেই। কিন্তু তাদের শোষণের কৌশল রপ্ত করেছে আমাদেরই পাশের মানুষেরা। রমজানের আগে আমারা সরকারের কত আশ্বাস পেলাম. ঈদযাত্রার ব্যাপারে কত নতুন ধারণা শুনলাম। কিন্তু সেই ‘যথা পূর্বং তথা পরং’।
রাত পোহালে মে দিবস অথচ এখনও বেতন ও ঈদের বোনাস পায়নি অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। রমজানে ঠকেছে কৃষক, এবার ঠকবে শ্রমিক। অর্থাৎ দেশ চলে যাদের শ্রমে সেই কৃষক-মেহনতি মানুষ ঠকবে, ঠকবে শতকরা ৮০ জন। রাষ্ট্র এই ৮০ জনের প্রতিনিধিত্ব করে না; নির্ভর করে। আর এই নির্ভরতা শুধু ভোটের জন্য। তারপর শাসকদের বক্তব্য একই- ‘মর ব্যাটা পাবলিক’। কিন্তু এমন হওয়ার তো কথা ছিল না।
প্রত্যেকবার মে দিবসে আমরা দেখি লাল পতাকা হাতে শ্রমিক। যে দলের হয়ে তারা আসে সে দল তাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের দেখিয়ে সুবিধা নেয়। ঈদ একেবারেই সমাগত, দরজায় কড়া নাড়ছে। আজ বেতন-বোনাস না পাওয়া মানে এরা ঈদেও বাজার করতে পারেনি। পরিবার নিয়ে ঈদ তাহলে কীভাবে করবে? এ তালিকায় সংবাদপত্রও আছে। তাদের খবর কে রাখবে? এ তো গেল শ্রমিকের কথা। আমাদের কৃষকেরা মধ্যস্বত্বভোগীদের সেই ‘চিরস্থায়ী দৌরাত্ম্য’ থেকে কতটা মুক্তি পেয়েছে?
কেননা কৃষক চায় ন্যায্য মূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য আর ব্যবসায়ী চায় বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে তরমুজের দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে বাগবিতণ্ডা ও অপ্রীতিকর ঘটনা তাই প্রমাণ করে। তরমুজ সাধারণত কোনাবেচা হয় কৃষকের ক্ষেত বা জমি থেকে। কিন্তু বাজারে এনে পিস হিসেবে নয়, কেজি দরে বিক্রি করে মুনাফা লুটে নেয়। এই অরাজকতা রুখতে মোবাইল কোর্ট পর্যন্ত বসাতে হয়েছে। তারপরও পুরোপুরি সুরাহা মিলছে না। অর্থাৎ সব রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
প্রতিনিয়ত বাজার চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের হাতে। মানুষের মূল্যবোধ, সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম সব কি চলে যাবে? মানুষের দেশপ্রেম পারে যেকোনো বিপর্যয় থেকে দেশকে বাঁচাতে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া একটা জাতি। আমাদের দেশে কিছু অসৎ, মূল্যবোধহীন মানুষ দৌরাত্ম্য দেখাবে কোনোমতেই মেনে নেয়ার নয়।
লেখক: গবেষক-প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক