বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিপথগামী তারুণ্য ও আদর্শহীন রাজনীতি

  •    
  • ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ১৭:২৫

দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের গঠন পক্রিয়া ও তাদের আদর্শ-দর্শনগত বিষয়টির ইতিহাস থেকে জানা যায়, একমাত্র ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ যা ১৯৪৭ সাল থেকেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাদের অবৈধভাবে দখল করা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য দর্শনহীন রাজনৈতিক ব্যক্তি, যারা শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি পছন্দ করেন, তাদের দিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করেন।

চলতি মাসের সতেরো তারিখের গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সদ্য নবগঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে ২০১৯ সালেই পরিবার থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। যশোরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি ও আমার পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু ছোট ছেলে রওনকুল বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত।

‘আওয়ামী লীগ বাবার পরিবারচ্যুত সন্তান হলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি’- গণমাধ্যমের এই শিরোনামের ভেতর একটি আদর্শ প্রতীয়মান যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে। উদীয়মান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নতুন করে ভাবতে সহযোগিতা করেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি কীসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে!

ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুইভাগে বিস্তার লাভ করেছে। এক. মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘আদর্শ’কেন্দ্রিক রাজনীতি, দুই. অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সেটি ধরে রাখার জন্য ‘ক্ষমতা’কেন্দ্রিক রাজনীতি। আবার কিছু সংগঠন বিভিন্ন দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সে দেশের নেতাদের আদর্শকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, রাজনৈতিক সংগঠনও গড়ে উঠেছে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মাঠের রাজনীতিতে সরকারের আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও মূল রাজনীতিতে ‘আদর্শ’ ছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু আদর্শকেন্দ্রিক রাজনীতিকে হত্যা করেনি, বাহাত্তরের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ‘ক্ষমতাকেন্দ্রিক’ রাজনীতির সঙ্গে সুকৌশলে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে ধর্মভিত্তিক ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ও চালু করা হয়েছে।

উপমহাদেশের প্রাচীনতম ও শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিষয়ে প্রখ্যাত লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদের ‘আওয়ামী লীগ: উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মওলানা আকরম খাঁ এবং খাজা নাজিমুদ্দিন।

আর সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রগতিশীলও উদারপন্থি নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোগলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মীশিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত হন।

তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক। কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনি ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

আর তখন তারাও এসে এই মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান।

সেই সভা করার জন্য কোনো অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান।

মুসলিম লীগের প্রগতিশীল একটি অংশের উদ্যোগে ২৩ জুন বিকাল বেলায় রোজ গার্ডেনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন আড়াই-তিনশ নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।

প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।”

লেখক-গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার জন্য তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু মানিক মিয়া তাতে রাজি হননি, কারণ তিনি লেখালেখি নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। জাস্টিজ মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের সাবেক একজন মন্ত্রীকেও অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু তিনিও সভাপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হননি।’’

‘‘তখন ১৯৬৪ সালের কাউন্সিল সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক থেকে যান।’’

বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমান একদিকে প্রধান সামরিক কর্মকর্তা, অন্যদিকে নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অবৈধভাবে দখল করেন। আর এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যই তার রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং শুরুতেই ‘জাগদল’ দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জিয়া রাজনৈতিক দল তৈরির আগেই একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের চিন্তা করেন, যাতে করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটা বিস্তৃত প্ল্যাটফরম বানানো যায়। একটা নির্দিষ্ট দর্শন ও কর্মসূচির চেয়ে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের পাল্টা একটা বড়সড় মঞ্চ তৈরি করা।

চতুর জিয়া তার রাজনৈতিক দল তৈরির প্রক্রিয়াটিও রীতিমতো রহস্যময় করে তোলেন। জিয়া সব কটি ডিম যেন এক ঝুড়িতে রাখতে চাননি। দল তৈরির কাজে অনেক ব্যক্তি ও মাধ্যমকে তখন ব্যবহার করেছেন। আর তখনকার সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর অফিসে রাতের বেলায় রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু শীর্ষনেতা আসতেন এবং আলাপ-আলোচনা করতেন। জিয়াও মাঝে-মধ্যে সেখানে উপস্থিত থাকতেন।

অন্যদিকে জিয়ার একান্ত সচিব কর্নেল অলি আহমদের সঙ্গে তখন মাঠপর্যায়ের অনেক নেতারই বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, যা এই সুযোগও তিনি কাজে লাগিয়েছেন।

জিয়াউর রহমান একদিকে তার ‘সমমনা’ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক জোট তৈরির কাজ করছেন, অন্যদিকে তিনি নিজস্ব একটা রাজনৈতিক দল তৈরির বিষয়টিও খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখলেন। জিয়ার মনে হলো, জোটের মধ্যে শতভাগ অনুগত একটা দল না থাকলে জোটকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

আর সে লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল’ বা ‘জাগদল’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরির ঘোষণা দেন। জিয়া নিজে থাকলেন তার নেপথ্যে।

বলা হয়, জিয়ার নতুন এই ‘জাগদল’ তখনকার রাজনীতিতে তেমন একটা ঢেউ তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক মাঠের চেনা মুখগুলোও জাগদলে খুব কমই যোগ দিয়েছিল, যা জিয়াউর রহমান চেয়েছে, তা আর হয়ে ওঠেনি!

১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল জিয়াউর রহমান নিজেই নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নোতি দিলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে এমনভাবে ক্ষমতা দখলের নজির নেই। আর ১৯৭৮ সালের ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট‘ ঘোষণা করা হলো।

আর ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে জিয়া হয়ে গেলেন পুরাদস্তুর একজন রাজনীতিক!

জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করা, টাকার বিনিময় রাজনৈতিক নেতবৃন্দ তৈরি বা রাজনৈতিক নেতাদের ক্রয় করা। আর এই উদ্দেশ্য-উপলব্ধি থেকে জিয়া বলেন, ‘‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট।” অর্থাৎ তিনি রাজনীতি কঠিন করে দেবেন। তার ‘মানি ইজ নো প্রোবলেম’ বহুশ্রুত কথাটি এখনও প্রচলিত। বর্তমানে আমরা তাই দেখছি।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও জিয়াউর রহমানের পদ-পন্থা অনুস্মরণ করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। আর এই অবৈধভাবে দখল করা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা টিকেয়ে রাখার জন্য ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতীয় পার্টি’ গঠন করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও।

অর্থাৎ দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের গঠন পক্রিয়া ও তাদের আদর্শ-দর্শনগত বিষয়টির ইতিহাস থেকে জানা যায়, একমাত্র ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ যা ১৯৪৭ সাল থেকেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, বিশ্বের বুকে বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাদের অবৈধভাবে দখল করা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য দর্শনহীন রাজনৈতিক ব্যক্তি, যারা শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি পছন্দ করেন, তাদের দিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করেন।

তার মানে আপনি ইচ্ছে করলেই যখন-তখন আওয়ামী লীগার হতে পারবেন না। কারণ, আওয়ামী লীগ একটি আদর্শ-দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠন।

এখানে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নবগঠিত সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের মুক্তিযোদ্ধা বাবা কাজী রফিকুল ইসলামের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, ‘‘কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ মূলত ‘আদর্শচ্যুত’ হওয়ার কারণেই ‘পরিবারচ্যুত’ হয়েছেন’।

আদর্শচ্যুত নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক, গবেষক কলাম লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি চমৎকার কথা মনে পড়ে। ‘বিলেত বাংলা’র একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি মানে কী? বিএনপি মানে হচ্ছে ১২-আনা রাজাকার, ৪-আনা সাবেক দেশপ্রেমিক’।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)

এ বিভাগের আরো খবর