বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তাসকিয়া-মহিউদ্দিনের মৃত্যু এবং নিরাপত্তার অসহায়ত্ব

  • আহমেদ রিয়াজ   
  • ১৫ এপ্রিল, ২০২২ ১৫:২৯

যেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদী হওয়া ছাড়াই নিরাপত্তাহীনতার কারণে সাধারণ নাগরিকের প্রাণ দিতে হয়েছে, খোদ পুলিশই যেখানে নিরাপত্তাহীন, সেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদকারীদের নিরাপত্তা কোথায়?

বঙ্গাব্দ নতুন বছরের ঠিক আগের দিন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাড়ির পাশের ডোবায় বাবার সঙ্গে মাছ ধরল তাসকিয়া। চার বছরের ছোট্ট মেয়েটি হঠাৎ বায়না ধরল চিপস খাবে। দুপুর সাড়ে তিনটায় বাবার সঙ্গে দোকানে গেল চিপস কিনতে। আর তখনই হঠাৎ একদল সন্ত্রাসী আক্রমণ করে বসল।

বাবা আবু জাহের ও মেয়ে তাসকিয়াকে লক্ষ্য করে গুলি করল সন্ত্রাসীরা। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে বাবার কোলে থাকা তাসকিয়াকে ইট দিয়ে আঘাত করে। তারপর চলে যাওয়ার সময় আরও দুই রাউন্ড গুলি করে। গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বাবা-মেয়ে।

গুলিতে তাসকিয়ার মাথা, মুখসহ পুরো শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তখনও বাবাকে জাপটে ধরে রেখেছিল শিশুকন্যাটি। আর ওভাবেই তার মৃত্যু হয়। বাবা আবু জাহের তার ডান চোখ হারান। এটি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের ঘটনা।

পরদিন পুরো জাতি যখন বঙ্গাব্দ নতুন বছর উদযাপন করছে, শুভ নববর্ষ বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করছে, সেদিন বিকেলে তাসকিয়ার জানাজা হলো। জানাজা পড়ালেন বাবা আবু জাহের নিজেই। আবু জাহেরের নতুন বছরটা ‘শুভ’ হলো কই? অশুভ হিসেবেই তো শুরু হলো।

ঠিক যেরকম অশুভ হিসেবেই বছর শুরু হলো কুমিল্লার সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাইমের পরিবারে। মাদকের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন এই সাংবাদিক। সীমান্ত দিয়ে মাদক চোরাচালানের কোনো খবর পেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে সে খবর পৌঁছে দিতেন মহিউদ্দিন। গত ছয়মাসে বেশ কয়েকটি মাদকের চালান ধরিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর সে কারণে মাদক কারবারিদের চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন তিনি।

কোনোভাবেই মহিউদ্দিনকে দমানো যাচ্ছিল না মাদকবিরুদ্ধ অবস্থান থেকে। এবার ফাঁদ পাতল কারবারিরা। মাদকের বড় চালান দেশে ঢুকবে বলে বুধবার রাত দশটায় তাকে খবর দিয়ে নিয়ে গেল। আর যাওয়া মাত্রই এক মিনিটের মধ্যে ৩০ জনের একটি মাদককারবারির দল তাকে ঘেরাও করে গুলি ছেড়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন মহিউদ্দিন। গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি মাদক কারবারিরা। গুলিবিদ্ধ মহিউদ্দিনকে তারা বেধড়ক পেটাতে থাকে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার পথেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার শংকুচাইলের কাছাকাছি সীমান্তবর্তী এলাকা হায়দ্রাবাদনগরে ঘটল এই নৃশংসতা।

মহিউদ্দিনের বাবা মোশারফ সরকার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ কর্মকর্তার সন্তান হয়েও মাদক কারবারিদের হাত থেকে রেহাই পেলেন না মহিউদ্দিন।

মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীরা কী রকম বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শেরপুরের ঘটনা তার প্রমাণ। তিনজন পুলিশের উপস্থিতিতেই দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে দিনমজুর শেখবরকে হত্যা করে সন্ত্রাসী দল। পুলিশ বাধা দিতে গেলে পুলিশের উপরও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।

তাতেই ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসে পুলিশ। জননিরাপত্তার দায়িত্বপালনকারী সরকারি সংস্থার সামনে ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় কিন্তু অনেক কিছুরই জানান দেয়। খোদ ঢাকা শহরেই এ বছরের ২৩ মার্চ বংশাল থানার ফটকে আটক ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হন পাঁচ পুলিশ। গত মার্চে ঢাকা শহরে পুলিশের ওপর তিনটি হামলার খবর জানা গেছে।

সিলেটের হবিগঞ্জেও এ বছরের ১ এপ্রিল মাদক কারবারিদের হামলায় আহত হয়েছেন দুই পুলিশ সদস্য।

পুলিশ সদস্যদের উপরই মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের প্রতিনিয়ত হামলা হচ্ছে দেশের নানান জায়গায়। বাদ যাচ্ছেন না বিজিপি সদস্যরাও। পূর্ব ঘোষণা দিয়ে সাংবাদিককে হতা করা হচ্ছে। কাজেই সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থাটা কী, সেটা কিন্তু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন পড়ে না। এখন প্রশ্ন হলো মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীরা এত সাহস পেল কোথায়?

পাশাপাশি আরও কিছু খবরে চোখ বোলালে এ জবাব পাওয়া যাবে অনেকখানি। খোদ পুলিশি তদন্তেই এসব অপকর্মের সঙ্গে পুলিশের জড়িত থাকার খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু সব খবর কি প্রকাশ হয়?

থানা এলাকায় মাদক কারবারি ও সন্ত্রাসীদের খবর পুলিশের অজানা থাকার কথা নয়। জানা থাকার পরও অনেক এলাকায় সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিরা তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদ ছাড়া কি এসব অপকর্ম করা সম্ভব? উল্টো কেউ বাধা দিতে গেলে কিংবা সে খবর প্রকাশ করতে গেলেই হত্যা পর্যন্ত করে ফেলে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের আশঙ্কা পুলিশের উপর হামলা বেড়ে গেলে সমাজে নিরাপত্তহীনতা তৈরি হতে পারে। আমরা কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি অনেকটা। আবু জাহের কিংবা সাংবাদিক মহিউদ্দিন তো অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। পূর্ব শত্রুতার রেশ ধরে সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারিদের হাতে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে তাদের। কিন্তু ডাক্তার বুলবুল?

গত মাসের ২৭ তারিখ বাসা থেকে বেরিয়ে ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ দিলেন ডাক্তার বুলবুল। ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে নিহত হন বুয়েট ছাত্রী সাবেকুন নাহার সনি। ২০১৩ সালে বুয়েটে এক সন্ত্রাসীর এলোপাতাড়ি কোপে প্রাণ হারান বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও যন্ত্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফ রায়হান দ্বীপ।

এরকম আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে অতি সম্প্রতি এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে ওই নেতার পাশাপাশি নিহত হন কলেজছাত্রী প্রীতি। এসব কীসের আলামত?

যেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদী হওয়া ছাড়াই নিরাপত্তাহীনতার কারণে সাধারণ নাগরিকের প্রাণ দিতে হয়েছে, খোদ পুলিশই যেখানে নিরাপত্তাহীন, সেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদকারীদের নিরাপত্তা কোথায়?

সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ভীষণ জরুরি। দেশে এই জননিরাপত্তা বিধান করার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ বাহিনী হিসেবে কাজ করছে পুলিশ। সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা বা অভিযোগ জানানোর রাস্তাটা কিন্তু থানার দিকেই।

পুলিশ বাহিনীর অনেক ভালো কাজের উদাহরণ রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদক নির্মূল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাসহ আরও অনেক অবদান তাদের আছে। কিন্তু অনেক এলাকায় পুলিশের এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তি যে নেই, সেটা সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারীদের কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যায়।

অপরাধীরা এরকম দুঃসাহস দেখায়। পুলিশকেও তোয়াক্কা করে না। খুব সামান্যরাই স্বার্থের কারণে বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। কাজেই দ্রুত এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি নির্মূলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। নইলে একমণ দুধে একফোঁট গোচোনার মতো পুরো পুলিশ বাহিনীর অর্জন ধূলিসাতের দিকেই যাবে। এই বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা ভীষণ জরুরি।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর