মুন্সীগঞ্জের রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের একটি ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে ১৯ দিন কারাভোগের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন তিনি। কারাফটক দিয়ে তার বেরিয়ে আসার ছবিটি অনেকেই ফেসবুকে শেয়ার করে তাদের লজ্জার কথা লিখেছেন। পড়ানোর ‘অপরাধে’ একজন শিক্ষকের কারাগারে যাওয়া অবশ্যই আমাদের জাতীয় লজ্জা। বাংলাদেশে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্কটি কলুষিত হয়েছে অনেক আগেই। তবে হৃদয় মণ্ডলের ঘটনায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস ঢুকে গেল তা মেরামত করতে অনেক সময় লাগবে।
দশম শ্রেণির কজন শিক্ষার্থী পরিকল্পিতভাবে হৃদয় মণ্ডলকে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন। ছাত্ররা শিক্ষককে প্রশ্ন করতেই পারে। হৃদয় মণ্ডলও শিক্ষকসুলভ সততা এবং ধৈর্যের সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি বুঝতেই পারেননি, প্রশ্নগুলো শিক্ষার্থীরা তাদের কৌতূহল থেকে করছে না, করছে তাকে বিপদে ফেলার জন্য। শিক্ষার্থীরা তার কথোপকথন রেকর্ড করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে তাকে বিপদে ফেলতে পারে, এটা হয়তো হৃদয় মণ্ডল স্বপ্নেও কল্পনা করেননি। ২১ বছর ধরে যে স্কুলে তিনি অঙ্ক এবং বিজ্ঞান শিখিয়ে আসছেন, সেই স্কুলেই তার জন্য এমন ফাঁদ পাতা হতে পারে, সেটা কল্পনা করা আসলেই কঠিন।
এই ঘটনা শোনার পর আমি শুধু নিজের ছেলেবেলার কথা ভাবছি। এখন তো স্কুলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ। আমাদের সময় শিক্ষার্থীদের পেটানো ছিল শিক্ষকদের বিনোদনের অংশ। শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার কত বিচিত্র এবং সৃষ্টিশীল কৌশল যে তাদের জানা ছিল; এখন ভাবতেই অবাক লাগে। বেঞ্চের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখা, চুল ধরে টান দেয়া, মাথায় গাট্টা দেয়া, পেটের চামড়া ধরে টান দেয়া, ডাস্টার ছুড়ে মারা, কপালে চাড়া দিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা- শাস্তির কোনো শেষ নেই। জালি বেত তো ক্লাশের অংশই ছিল। পেটাতে পেটাতে বেত ভেঙে ফেলার রেকর্ড অনেক শিক্ষকেরই ছিল। তখন অভিভাবকরা স্কুলে ভর্তি করার সময় শিক্ষকদের বলতেন, মাংস আপনার, হাড্ডি আমার। গাধা পিটিয়ে মানুষ বানিয়ে দেবেন।
প্রতিবাদ করা বা আন্দোলন করার কথা ভুলেও কখনও মাথায় আসত না। কারণে-অকারণে কত মার খেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। বরং স্কুলে মার খেয়েও বাড়ি ফিরে সেটা লুকিয়ে রাখতাম। মার খেয়েছি শুনলে আম্মা বলতেন, নিশ্চয়ই অপরাধ করেছিস বলেই মেরেছে। ফলে বাড়িতে আরেক দফা মার খাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে মার খেয়ে চেপে যেতাম। ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতা পড়ে আমরা বড় হয়েছি। এখনও স্মৃতিতে টাটকা, ‘‘বাদশাহ আলমগীর/কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।’’ একদিন মোগল বাদশাহ আলমগীর দেখেন তার শাহজাদা শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছেন।
এই দৃশ্য দেখে বাদশাহ আলমগীর ক্ষিপ্ত হলেন। শিক্ষক ভাবলেন, শাহজাদা তাকে পানি ঢেলে দিয়েছে, এটা দেখেই বুঝি বাদশাহ ক্ষিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু বাদশাহ শিক্ষককে ডেকে বললেন, শাহজাদা কি শিক্ষকের সৌজন্য কিছু শেখেনি? শাহজাদা কেন শুধু পানি ঢেলে দিচ্ছে। কেন শিক্ষকের পা ধুইয়ে দিচ্ছে না? কবিতার শেষটা ছিল, ‘‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির/সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’’ আজ আর সেই শিক্ষকও নেই, সেই ছাত্রও নেই, সেই অভিভাবকও নেই। কিন্তু তাই বলে দশম শ্রেণির ছাত্ররা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষককে উত্ত্যক্ত করে, তাকে একের পর এক প্রশ্নের ফাঁদে ফেলে, সেটা রেকর্ড করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনবে এটা ভাবা যায়! বাংলাদেশ আসলে এখন এক অসম্ভবের দেশ।
এখন জানা যাচ্ছে, ধর্ম অবমাননা বিষয় নয়, হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত তার সহকর্মীরাই ছাত্রদের উস্কে দিয়ে এই অপকাণ্ড ঘটিয়েছে। আর একজন ‘সংখ্যালঘু’ মানুষকে বিপাকে ফেলতে ধর্মের চেয়ে সহজ অস্ত্র আর কিছু নেই। তবে যারা হৃদয় মণ্ডলকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিলেন, তারাই এখন উল্টো বিপদে পড়েছেন। হৃদয় মণ্ডল শুধু তার স্কুলে জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি সারা দেশের মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর সাংবাদিকরা ছুটে গেছেন মুন্সীগঞ্জে। তারা দেখেছেন গ্রামের স্কুলের একজন বিজ্ঞানশিক্ষকের জীবনযাপন।
তার ঘরের দেয়ালে দেয়ালে বিজ্ঞানের নানা সূত্র আঁকা, বিজ্ঞানীদের ছবি ঝোলানো। দেখলেই বোঝা যায়, হৃদয় মণ্ডলের জীবনজুড়েই বিজ্ঞানের বাস। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুরের মতো গ্রামে হৃদয়চন্দ্র মণ্ডলের মতো শিক্ষকরা এখনও আছেন, এটা আমাদের গর্বিত করে। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নানা বিতর্ক আর হতাশার মধ্যে হৃদয় মণ্ডল আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। বিনা দোষে ১৯ দিন কারাভোগের পর বেরিয়ে হৃদয়চন্দ্র মণ্ডল আবারও প্রমাণ করেছেন, তিনিই সত্যিকারের শিক্ষক। কারো বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। তাকে যারা বিপদে ফেলেছে সেই শিক্ষার্থীদের ক্ষমা করে দিয়ে তিনি বলেন, কোমলমতি শিশুরা ভুল করেছে। ওদের মাফ করে দিতে হবে। এই ঘটনা থেকে মানুষ শিখবে। সারা দেশে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে।
বরং সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উল্টো তিনি বলেছেন, ক্ষমাই যদি করতে না পারি, তাহলে আমি কীসের শিক্ষক। তিনি বলেছেন, সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা, সব ধর্মের লোকদের আমি শ্রদ্ধা করি, শ্রদ্ধা করে যাব। সবাই যেন এই মন নিয়ে বাংলাদেশে বসবাস করে। হৃদয় মণ্ডলের কাছ থেকে শিক্ষক-ছাত্র, অভিভাবক থেকে শুরু করে আমাদের সবার অনেক কিছু শেখার আছে। মুক্তি পেয়ে তিনি বলেছেন, স্রষ্টাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে ধৈর্য ধরার ক্ষমতা দিও, তিনি দিয়েছেন। তার ধৈর্য দেখে সত্যি আমি অবাক হয়েছি। শিক্ষার্থীরা তাকে ১৩ মিনিট ধরে প্রশ্নের ফাঁদ পেতেছেন। আমি নিজেকে ধৈর্যশীল বলে দাবি করি। কিন্তু হৃদয় মণ্ডলের জায়গায় আমি হলে অতক্ষণ ধৈর্য ধরতে পারতাম বলে মনে হয় না। আমাদের ছেলেবেলায় শিক্ষকদের সঙ্গে ১৩ মিনিট ধরে অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে তর্ক করা অসম্ভব ছিল। তার আগেই বেত চলে আসত।
হৃদয় মণ্ডল আমাদের শিখিয়েছেন, প্রশ্নের জবাব যুক্তি দিয়ে দিতে হয়। অসহিষ্ণুতা-সংঘাত, হানাহানি দূর করতে পারে যুক্তি। এখানেই আমাদের সমস্যা। আমরা কেউ কারো কথা মানি না। সবাই নিজেকেই চূড়ান্ত মনে করি। যুক্তিতে না পারলে জবাব দেই গালিতে, মামলা, হামলা, চাপাতিতে। কিন্তু হৃদয় মণ্ডল অনড় ছিলেন যুক্তিতে।
হৃদয় মণ্ডলের মুক্তিতে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। তার বিরুদ্ধে করা এই মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যারা শিক্ষকের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়েছে খুঁজে বের করতে হবে সেই নোংরা মানুষদের। যে পুলিশ কর্মকর্তা ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি ছাড়াই অতি উৎসাহী হয়ে হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন মামলা নিয়েছে এবং তাকে গ্রেপ্তার করেছে, ব্যবস্থা নিতে হবে তাদের বিরুদ্ধেও।
মুক্তি পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে ক্লাশরুমে ফিরে গিয়ে হৃদয় মণ্ডল প্রমাণ করেছেন, তিনি সাহসী, তিনি বীর। শুরুতে যে ছবিটির কথা বলেছি, সেই ছবিটি দেখে গর্বে আমার বুক ফুলে গেছে। একজন শিক্ষক অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছেন মাথা উঁচু করেই। হৃদয় মণ্ডলের মতো সাহস নিয়ে, যুক্তি নিয়ে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে সব সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতা। কাজী নজরুল ইসলাম তার মতো মানুষের কথা ভেবেই হয়তো লিখে গেছেন- “অসত্যের কাছে নত/নাহি হবে শির/ভয়ে কাঁপে কাপুরুষ/লড়ে যায় বীর।”
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক