বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যুক্তরাষ্ট্রের ভুল স্বীকার করা উচিত

  • মোনায়েম সরকার   
  • ১৩ এপ্রিল, ২০২২ ১৪:০৪

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যত বেশি সময় নেবে ততই অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ন্যাটোর গঠনতন্ত্র অনুসারে ইউক্রেনকে ন্যাটোর কোনো সামরিক সহায়তা দিতে পারে না। কেননা ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়। তবু যেহেতু একটি যুদ্ধ বাধাতে হবে এবং সেই যুদ্ধ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মুনাফা করতে হবে- তাই সে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে ব্যবহার করছে ন্যাটোকে।

বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শক্তিমান রাষ্ট্র বলে স্বীকৃত। বলা হয়ে থাকে বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাধর রাষ্ট্র এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কথাটা সত্য-মিথ্যা যাই হোক- সারা বিশ্বে যত যুদ্ধ-বিগ্রহ, অশান্তি-হাহাকার আছে সেসবের পিছনে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ জড়িত এতে কোনো সন্দেহ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য অস্ত্রের শাসন দেখিয়ে ‘ডলারের পাহাড় গড়ে’ সারা পৃথিবীকে দাসের মতো শৃঙ্খলে রাখা। কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনাবশ্যক হস্তক্ষেপ করে, সে দেশের সাংবিধানিক রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রপ্রধান ও তার পরিবারবর্গকে হত্যা- শক্তিমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর ‘রুটিন ওয়ার্ক’ হয়ে উঠেছে। বিশ্বকে নিঃস্ব করার গভীর দুরভিসন্ধি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা কোণঠাসা হয়েছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকের সুখের ঘরে অশান্তির আগুন জ্বেলেছে। অনেক সমৃদ্ধ শহর বোমার আঘাতে তছনছ করে পুরাকীর্তি ধ্বংস করেছে। অনেক জাতির ঐতিহাসিক নিদর্শন গুঁড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে ইতিহাসহীন জাতি হিসেবে গড়ে তোলার ষড়যন্ত্র করেছে। তার এসব ষড়যন্ত্র অনেকাংশে বাস্তবায়িত হলেও পুরো পৃথিবী এখনও তার বশ্যতা মেনে নেয়নি- এটাই আশার কথা।

এতদিন এশিয়ার বিভিন্ন মুসলিম ভূখণ্ডজুড়ে ইসলামি মৌলবাদ সৃষ্টি করে একের পর এক রাষ্ট্র লুণ্ঠন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব রাষ্ট্র লুণ্ঠন করতে গিয়ে তার যে পরিমাণ ডলার যুদ্ধের জন্য ব্যয় করতে হয়েছে সেটাও একেবারে কম নয়। তাছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে অর্থনৈতিকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব একটা সুবিধানজক অবস্থানে ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর বেকার বৃদ্ধি, কর্মজীবী মানুষের চাকরিচ্যুতি, স্বাস্থ্য খাতের বিপর্যয়- এইসব পরিসংখ্যানই স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয় এশিয়ার অনেক রাষ্ট্র গিলে খেয়েও তার দানবীয় অর্থক্ষুধা এতটুকু প্রশমিত হয়নি। অর্থলোভী নির্মম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবার অর্থশালী ইউরোপের ভূখণ্ডে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়েছে। ইউরোপে সে ধর্মীয় মৌলবাদ নয়, যুদ্ধ বাধানোর জন্য আশ্রয় নিয়েছে সরাসরি সামরিক কৌশল।

ন্যাটো নামের সামরিক জোটের সদস্য সংগ্রহ করতে গিয়ে রাশিয়ার গায়ে হাত দিয়ে পুরো ইউরোপে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, কৌশলে ইউরোপের ধনী দেশগুলোর কাছে মারণাস্ত্র বিক্রির হাট মিলিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র ব্যবসা এই মুহূর্তে জমজমাট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। রাশিয়ার হাত থেকে বাঁচতে পুরো ইউরোপ এখন অস্ত্র কিনতে বাধ্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। ‘ন্যাটো’ অনেক অন্যায় যুদ্ধ বাধিয়েছে পৃথিবীর দেশে-দেশে।

এতদিন শক্ত প্রতিপক্ষ না-থাকার কারণে সে অপ্রতিরোধ্য মনে করেছিল নিজেকে। ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে এসে ন্যাটো যেন অনেকটাই নেতিয়ে পড়েছে। ন্যাটোর থাকা-না-থাকা নিয়ে এখন গলির মোড়ের চায়ের দোকানদারও মন্তব্য করছে। বস্তুতপক্ষে, ন্যাটো মরতে বসেছে, এখন শুধু তার কফিন সমাধিস্থ করার জন্য বিশ্ববাসীকে অপেক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী যখন প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বন্ধুভাবাপন্ন কিছু রাষ্ট্র নিয়ে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে এই চুক্তি North Atlantic Treaty Organization সংক্ষেপে NATO নামে স্বাক্ষরিত হয়। ন্যাটোভুক্ত কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্র-কর্তৃক অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হলে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্র এসে আক্রান্ত রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়াবে এমন কথাই লেখা আছে ন্যাটোর গঠনতন্ত্রে। নিঃসন্দেহে এমন একটি সামরিক জোটে থাকা ইউরোপীয়দের জন্য সে সময় প্রয়োজন ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বর্ণনাতীত। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপ যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচার জন্যই ন্যাটোভুক্ত হতে উৎসাহিত হয়েছিল। কিন্তু যতই সময় গড়াতে থাকে ততই বেরিয়ে আসতে থাকে ন্যাটোর ভয়ংকর রূপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বশ্যতা যারা মানতে চায়নি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ব্যবহার করতে থাকে।

ধীরে ধীরে ন্যাটো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সন্ত্রাসে পরিণত হয়। ইরাক-আফগানিস্তান, সিরিয়া-মিশর, লিবিয়া-তিউনেশিয়াসহ অসংখ্য রাষ্ট্র সিআইএ, পেন্টাগন ও ন্যাটোর কাঁধে ভর দিয়ে ধ্বংস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বছরের পর বছর সেসব দেশের তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের ঘর ভরে। অথচ এসব কাজের জন্য ন্যাটোভুক্ত সব সদস্য রাষ্ট্রকে কোটি কোটি ডলার গুণতে হয়েছে।

ন্যাটোর গঠনতন্ত্র অনুসারে ন্যাটোভুক্ত সব সদস্যকেই একটি নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদার পরিমাণ নেহাত কম নয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্যাম্প ন্যাটোকে ‘শ্বেতহস্তী’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। বিনা প্রয়োজনে এই শ্বেতহস্তী পুষতে তিনি রাজি ছিলেন না। তার আমলে ন্যাটোর বরাদ্দ বাতিল করার জন্য বহুবার তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম খুঁজলে এখনও সেসব কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে। করোনা পরবর্তী সময়ে ইউরোপজুড়ে যখন ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা চলছে সে সময় ন্যাটোর ব্যয়ভার বহন করতে না-পারার আগ্রহ ইউরোপের দেশগুলো করতেই পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের এই নেতিবাচক মনোভাব বুঝতে পেরে ইউরোপের দেশগুলোকে শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্র সন্ধান করছিল। তারা চাচ্ছিল এমন একটি দেশকে শত্রুপক্ষ বানাতে যার ভয়ে ইউরোপের সব দেশ আতঙ্কে থাকবে এবং সেই কাজটি করেছে শক্তিশালী রাশিয়ার পার্শ্ববর্তী ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য করতে গিয়ে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানে রাশিয়া তার আশেপাশে ন্যাটোর উপস্থিতি বরদাস্ত করবে না। সুতরাং তাকে যদি কোনোভাবে ক্ষেপিয়ে তোলা যায় ইউরোপের বিরুদ্ধে, তাহলে ইউরোপকে ভালোমতো শিক্ষা দেয়া যাবে- সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ইউক্রেনকে সবরকম আশা দিয়ে যুদ্ধে নামিয়ে ইউরোপের সব রাষ্ট্রকে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য করছে।

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যত বেশি সময় নেবে ততই অস্ত্র ব্যবসা জমজমাট থাকবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ন্যাটোর গঠনতন্ত্র অনুসারে ইউক্রেনকে ন্যাটোর কোনো সামরিক সহায়তা দিতে পারে না। কেননা ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র নয়। তবু যেহেতু একটি যুদ্ধ বাধাতে হবে এবং সেই যুদ্ধ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মুনাফা করতে হবে- তাই সে নিজের পরিকল্পনা অনুসারে ব্যবহার করছে ন্যাটোকে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনই। নিজের স্বার্থই তার কাছে বড়। অন্যায় করে হোক আর মানুষ মেরে হোক অর্থ তার চাই-ই চাই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে ন্যাটোর অনেক কিছু শেখার আছে। এই যুদ্ধ সবার সামনে ন্যাটোর সন্ত্রাসী ভূমিকাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সামরিক সন্ত্রাসকে পছন্দ করছে না। যেখানে ওয়ারস (WARSAW) জোট নেই, সেখানে ন্যাটো জোটের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? হয়তো প্রয়োজন নেই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা ভালো করেই বুঝে গেছে যুদ্ধ না থাকলেও যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখতে হবে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে না রাখলে তার কোনো দাম থাকবে না, কেউ তাকে মানবে না। এ কারণেই সারা বিশ্বে সে এমনভাবে সংকট জিইয়ে রাখে যেন সব সময় তাকে প্রয়োজন হয়।

আমি ২০১৬ সালে একটি ইংরেজি বই লিখেছিলাম যার শিরোনাম ‘NATO at Crossroads’ সেই বইয়ে আমি ‘ন্যাটোর জন্ম, কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ’ নিয়ে যেসব কথা বলেছিলাম, আজকাল সেসব কথারই প্রতিধ্বনি শুনছি বিভিন্ন কলাম লেখকের লেখায়। আমি আমার গ্রন্থে ন্যাটোর অবসায়ন কামনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সম্প্রীতিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলাম। আজ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যেভাবে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে ন্যাটোর ভয় দেখিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না। আজ বিশ্বব্যাপী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল স্বীকার করা জরুরি।

ন্যাটো তার সদস্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা দিতে অক্ষম, সেটা রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন পরাজিত হলেই প্রমাণিত হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পরিস্থিতি আগের মতো নেই। বিশ্বজনমত এবং রাশিয়ার জনমত রাশিয়ার আক্রমণকে যৌক্তিক বলেই মনে করেছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের হার শুধু ইউক্রেনকেই লজ্জায় ফেলবে না, ন্যাটোর সম্মানেও চুনকালি মাখাবে।

এই চলমান যুদ্ধ শেষদৃশ্যে কোন দিকে মোড় নেয় এখন তা চূড়ান্তভাবে বলা না গেলেও এটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে- এই যুদ্ধ শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অহংকার কিছুটা হলেও চূর্ণ হবে। পৃথিবী যুদ্ধ চায় না, শান্তি চায়। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুধু যুদ্ধই হবে না সেটা হবে পৃথিবী ধ্বংসের নীলনকশা। পারমাণবিক যুদ্ধের হোলি খেলায় না মেতে মানবিক বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই হোক বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর অঙ্গীকার।

লেখক: রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক। মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

এ বিভাগের আরো খবর