বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতি কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? 

  •     প্রদীপ মালাকার   
  • ৫ এপ্রিল, ২০২২ ১৪:৫৬

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে।

রাশিয়া প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেন আক্রমণ করে গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন তথা দেশটির সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্রীকরণ, জাতীয়তাবাদী সরকারের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে অপসারণ করে রুশপন্থি একজন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় বসানোর অভিপ্রায় এবং সেই সঙ্গে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়া দ্বীপসহ অন্য দুই অঞ্চলের স্বীকৃতি আদায়ে এই বিশেষ সামরিক অভিযান চালান। ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনে রাশিয়া লক্ষাধিক সৈন্যের বিশাল বহর নিয়ে রাজধানী কিয়েভ দখলের জন্য অভিযান পরিচালনা করেছে।

ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী ও সাধারণ জনতা দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে পুতিন বাহিনীকে শক্তভাবে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। এই যুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোটসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমেরিকাসহ ন্যাটো জোট ইউক্রেনের হয়ে সরাসরি যুদ্ধে না নেমে ইউক্রেনকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দেয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার ওপর এ-যাবৎকালের কঠিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

পুতিন বাহিনী ইউক্রেনের সমুদ্রবন্দরসহ কয়েকটি শহর দখল করে নিয়েছে এবং রাজধানী কিয়েভ দখলের জন্য ক্ষেপণাস্ত্র হামলা, বোমা বর্ষণ করে যাচ্ছে। ইউক্রেন বাহিনীও শক্তভাবে তা প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। উভয় পক্ষে সেনা হতাহতের পাশাপাশি রুশ হামলায় হাজার হাজার সাধারণ নারী-পুরুষ ও শিশু মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে। রুশ বোমাবর্ষণে অসংখ্য বাড়িঘর, হাসপাতাল ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ২৫ লাখ উদ্বাস্তু শরণার্থী প্রতিবেশী দেশগুলোয় আশ্রয় নিয়েছে এবং দেশের ভেতর আরও ২৫ লাখ উদ্বাস্তু অবস্থান করছে। যুদ্ধ বন্ধে সংশ্লিষ্ট পক্ষের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

এদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেন একে অপরকে জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র তৈরি নিয়ে দোষারোপ করছে। রাশিয়া সিরিয়া থেকে আনা ১৬ হাজার যোদ্ধাকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য নিয়োগ দিয়েছে। ইউক্রেনের পক্ষেও বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধা যোগ দিয়েছে। ওদিকে যুদ্ধের তৃতীয় দিনেই ন্যাটো জোটকে ঠেকাতে পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের হুমকি দিয়ে রেখেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে!

বিষয়টি বোঝার জন্য আমাদেরকে পেছনে ফিরে দেখা দরকার।

২০২১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক দিমিত্রি মারাটভ মন্তব্য করেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ২৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভিযানের প্রাক্কালে ভাষণের শব্দচয়নে মনে হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র যুব্ধের হুমকি দিয়েছেন পুতিন। মারাটভের কথার কিছুটা যথার্থতা পাওয়া গেল যখন ২৭ ফেব্রুয়ারি পুতিন রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার কর্তৃপক্ষকে তৈরি থাকার নির্দেশ দেন।

পুতিন ওইদিনের ভাষণে বলেন, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে ইউক্রেন রাশিয়ার অংশ। তাই তিনি সামরিকবাদ ও ফ্যাসিবাদের কবল থেকে ইউক্রেনকে মুক্ত করবেন। তার অর্থ তিনি ইউক্রেন রাশিয়ার দখলে আনবেন এবং বর্তমান সরকারকে সরিয়ে রুশ অনুগত সরকারকে কিয়েভের ক্ষমতায় বসানো হবে।

ন্যাটো বাহিনী ইউক্রেনের অভ্যন্তরে যুদ্ধে অংশ নেবে না। এই ঘোষণা বহাল থাকলে একটা সময়ে রাশিয়া তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে। তবে এর পরিণতি হবে সুদূরপ্রসারী এবং ভবিষ্যতে আরও বড় বিপদের মধ্যে পড়বে বিশ্ববাসী।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের দীর্ঘ ২২ বছর ক্ষমতায় থাকা, তা আরও দীর্ঘায়িত হওয়ার সম্ভাবনা, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পুতিনের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং চীনের সঙ্গে নিবিড় ঘনিষ্ঠতার ফলে যে চিত্র ফুটে ওঠে তার বিপরীতে পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি বিচার-বিশ্লেষণ করলে আরেকটি মহাযুদ্ধের পূর্বাভাসই যেন সামনে চলে আসে।

রাশিয়া ২০০৮ সালে জর্জিয়ার বিরুব্ধে সামরিক অভিযান চালায় এবং দুটি ছোট অঞ্চল দক্ষিণ ওসিটিয়া ও আবখাজিয়া জর্জিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। এখনও সে অবস্থাই বিরাজমান। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে স্ট্র্যাটেজিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ ক্রিমিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ২০১৪ সালে রাশিয়া দখল নেয় এবং পরে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়। বেলারুশ ও কাজাখস্তানে মস্কোপন্থি সরকারকে রক্ষার জন্য সেখানে সম্প্রতি রাশিয়া সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে।

বৈশ্বিক শক্তি বলয়ের বিপরীতমুখী মেরুকরণ এবং বিভিন্ন সময়ে একেকটি ঘটনার ফলে যে প্রেক্ষাপট ক্রমশ তৈরি হচ্ছে তার সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব প্রেক্ষাপটের অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওপর একটু নজর দেয়া যাক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ইউরোপে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য। জার্মানিও তখন অনেক শক্তিশালী।

এর বিপরীতে বড় শক্তি ছিল জারশাসিত রাশিয়া। বলকান অঞ্চল অর্থাৎ সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও স্নোভেনিয়া অঞ্চলের ওপর প্রভাব বিস্তার এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির মধ্যে সব সময় দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে ছিল। অনেক ঘটনাপ্রবাহের এক পর্যায়ে সার্বিয়ার কাছ থেকে (বসনিয়া-হার্জেগোভিনা) প্রথমে দখলে নেয় এবং ১৯০৮ সালে তা নিজেদের সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয় অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি।

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যুবরাজ আর্ক ফ্রাঞ্জ ১৯১৪ সালে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো সফরের সময় সার্ব আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। এর পেছনে সার্বিয়ার হাত আছে এমন অভিযোগ এনে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়ার বিরুব্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর সার্বিয়ার পক্ষে যুদ্ধে নামে রাশিয়া। তার সঙ্গে প্রথমে যোগ দেয় ফ্রান্স। পরে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা যোগ দেয় ১৯১৭ সালের এপ্রিলে। অপরদিকে জার্মানি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পক্ষ নেয়।

এবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট দেখি। ভারসাই চুক্তি এবং হিটলার-মুসোলিনির উত্থান ও জোটবদ্ধতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বড় কারণ হলেও প্রেক্ষাপটটি ধাপে ধাপে তৈরি হতে থাকে ১৯৩১ সালে জাপানের মাঞ্চেরিয়া ও ১৯৩৫ সালে ইতালির ইথিওপিয়া দখলের মধ্য দিয়ে। এই আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের বিরুব্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় । তার কারণেই ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করে নেন।

তখন প্রতিবাদ তো হলোই না, বরং ১৯৩৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মিউনিখ চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ সবাই এই অন্যায় দখলদারিত্ব মেনে নেয়। চুক্তিতে হিটলার অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি আর আগ্রাসন চালাবেন না। কিন্তু এক বছরের মাথায় চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রেই যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেমনি আজকের সংঘাত ও যুদ্ধের বীজ রোপিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে।

১৯৪৫ সালের ৮ মে হিটলারের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট স্টালিন ও আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান জুলাইয়ে জার্মানির পটসড্যাম শহরে আলোচনায় বসেন। মূল বিষয় ইউরোপের নতুন মানচিত্রের বিন্যাস প্রসঙ্গে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত। জার্মানিকে দুই ভাগ করতে তিনজনই রাজি হলেন, কিন্তু স্টালিন পোল্যান্ডের কর্তৃত্ব দাবি করলে ট্রুম্যান বেঁকে বসেন।

আলোচনার একপর্যায়ে ট্রুম্যান তুরুপের তাসটি বের করেন। পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার ও জাপানের দুটি শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে ট্রুম্যান বুঝিয়ে দেন কোনো ছাড়ই আর দেয়া হবে না। কয়েক বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নও পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়। শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধের কাল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।

এ যেন শেষ হয়েও শেষ হয়নি, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে হিটলার শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কারে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বকে যেমন তছনছ করে দিয়েছিলেন, তেমনি স্নায়ুযুদ্ধ-উত্তর সময়ে রচিত প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে পুতিন ক্ষুব্ধতার উত্তেজনায় আজ যা করলেন, তাতে বিশ্ব ব্যবস্থা আবার তছনছের মধ্যে পতিত হলো।

পুতিন প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে সামরিক পন্থা বেছে নিয়েছেন। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সামরিক পন্থা ধ্বংস, বিভীষিকা ছাড়া কোনো সমাধান দেয় না। বড় শক্তি বলয়ের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র আগ্রাসনের শিকার হলো। এটা ঐতিহাসিক ভুল, যা বিশ্বকে আরেকটি মহাযুব্ধের দিকে ধাবিত করতে পারে।

লেখক: শিক্ষক-গবেষক, কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর