বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার দায় সবার

  • লাভা মাহমুদা   
  • ৩০ মার্চ, ২০২২ ১৩:৫৪

ভেবে দেখার সময় এসেছে, যে ভাষার জন্য পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে জীবন দিয়েছি সেই ভাষাকেই কেন এত অবজ্ঞা করছি। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলতে পড়তে এবং লিখতে পারার মধ্যে যে পরমানন্দ আছে, যেদিন আমরা বুঝতে পারব সেদিন থেকেই বাংলা আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। রবীন্দ্রনাথ এই ভাষাতেই সৃষ্টি করেছেন তার অনবদ্য সব রচনা।

জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো যেসব উপাদান আমাদের আছে, সবার আগে আসে আমাদের মিষ্টি-মধুর প্রাণের ভাষা, বাংলা। আহ! ব্যাকুল হয়ে হৃদয়ের আকুতি প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম, আমার ভাষা।

পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের ভাষা বিস্তৃত ও ব্যাপক। এই ভাষার কারণেই আমরা অন্যসব প্রাণী থেকে আলাদা এবং অনন্য। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মানব শিশু কান্নার যে শব্দ দিয়ে তার আগমনি বার্তা এ ধরিত্রীকে জানিয়ে দেয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শব্দই আধো আধো বুলিতে ভাষায় রূপ নেয়। এটাই তার মাতৃভাষা। এই ভাষার মাধ্যমেই ভাবের বিনিময় হয়, কথার আদান-প্রদান হয়, যা বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে বিবেচিত।

সৃষ্টির শুরু থেকে মানব সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি ভাষারও বিবর্তন ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সেই সঙ্গে জন্ম হয়েছে হরেক রকম ভাষার। সেখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে সময়-অবস্থান, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক। এ কারণেই একটি দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে কত বিচিত্র ভাষা রয়েছে— এর কূলকিনারা করা সহজ কাজ নয়।

এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ৮ শ কোটি মানুষ প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ভাষায় কথা বলছে। অনেক ভাষা বিলুপ্তপ্রায়, অনেক ভাষা বদলাতে বদলাতে অন্যরকম হয়ে গেছে, অনেক ভাষায় হয়তো কথা বলে মাত্র গুটিকয়েক মানুষ। ইউনেস্কোর মতে, পৃথিবীতে কোনো ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা ৫ হাজারের কম হলে, সেটি বিপন্ন ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হবে। সেই হিসেবে বিলুপ্ত হয়েছে বা বিলুপ্তির পথে অথবা বিপন্ন ভাষা প্রায় ৪৩%।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাষা ব্যবহৃত হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র পাপুয়া নিউগিনিতে। ৪ লাখ ৬২ হাজার বর্গকিলোমিটারের এ দেশটিতে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ ৮৫২টি ভাষায় কথা বলে। গহীন অরণ্যের কারণে দেশটির বেশিরভাগ অঞ্চল দুর্গম এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না।

এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে এক অঞ্চলের মানুষের ভাষা, অন্য অঞ্চলের মানুষের ভাষা থেকে আলাদা হয়েছে। এ কারণেই দেশজুড়ে এত ভাষার জন্ম। ফলে দেখা যায়, যে অঞ্চল যত দুর্গম, দুর্ভেদ্য; ভাষার বৈচিত্র্য সেখানে তত বেশি। ভাষাবৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য দেশ হিসেবে পাপুয়া নিউ গিনি পৃথিবীর মানুষদের কাছে দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

কথা বলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে দ্রুততম ভাষাটি হলো তেলেগু। যে ভাষায় প্রধানত দক্ষিণ ভারতের ৮ কোটিরও বেশি মানুষ কথা বলে থাকে। অস্ট্রিয়ার ক্ল্যাগেনফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জারট্রড ফেনক-ওজলনের গবেষণায় সামান্য ব্যবধানে জাপানিজ ভাষাকে হারিয়ে দ্রুততম কথ্য ভাষার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে তেলেগু।

আবার পৃথিবীতে ৪৬ রকমের ভাষা আছে, যা মাত্র একজন করে মানুষ কথা বলে। ভারতে ভাষা আছে ৪২৭টি আর আমাদের বাংলাদেশে ৩৮টি।

আবুধাবিভিত্তিক গবেষক কাই চ্যান, যিনি ইনসেড ইনোভেশন এবং পলিসি ইনিশিয়েটিভের একজন বিশিষ্ট ফেলো, তিনি বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে ভাষার শক্তি পরীক্ষা করে উপসংহার টেনেছেন ইংরেজিই সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা। তারপরেই রয়েছে ম্যান্ডারিন, ফরাসি, স্প্যানিশ এবং আরবি ভাষা।

এমনকি চীনের বিশাল অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদের কথা বিবেচনা করেও তিনি বলেছেন যে, ২০৫০ সালের মধ্যেও ইংরেজি ভাষাই সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা থাকবে। তবে স্প্যানিশ তৃতীয় স্থানে উঠে আসবে এবং ফরাসি আর আরবি যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থান দখলে নেবে।

অষ্টম শতকে শুরু হয়ে সময়ের বিভিন্ন ধারাপথে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অষ্টাদশ শতকের শেষে এসে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে। বাংলার নব জাগরণে, বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে এক সূত্রে গাঁথতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে সর্বোপরি বাংলাদেশ গঠনে বাংলা ভাষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদার আন্দোলন ১৯৪৭-এ শুরু হয়ে ১৯৫২তে পূর্ণতা পায়। এর আগে ভাষার জন্য আর কোথাও জীবন দেয়নি কেউ, ভাষার দাবিতে মরণপণ সংগ্রাম-লড়াই-আন্দোলন হয়নি তখনও কোথাও। সর্বোপরি আমাদের ভাষার কারণেই ২০০০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। ১৯০টি দেশের মানুষ এ দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে নিজের ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা ব্যক্ত করে, যাতে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিটি ভাষা স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তাই দুনিয়াজোড়া এত ভাষার মধ্যে আমাদের বাংলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও অনন্য ভাষা।

ভাষাভাষীর সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীতে বাংলার স্থান পঞ্চম। প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। সেই হিসাবে বাংলা বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ মাতৃভাষা। সম্প্রতি ‘ওয়ার্ড টিপস’ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ১০০টি ভাষার একটা তালিকা তৈরি করেছে। সেখানে মোট জনসংখ্যার হিসাবে বাংলা বিশ্বের সপ্তম ও মাতৃভাষার জনগোষ্ঠীর হিসাবে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, ঝাড়খন্ড, ওডিশা, আন্দামান-নিকোবর, মানভূম, সাঁওতাল পরগনা প্রভৃতি এলাকায়ও বাংলা ভাষার প্রচলন রয়েছে। এর বাইরে পৃথিবীর দেশে দেশে বিপুল পরিমাণ বাংলাভাষী অভিবাসী ও প্রবাসী রয়েছেন।

ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, অলংকরণ, সাহিত্য সব মানদণ্ডেই বাংলা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ভাষা। ‘তুই-তুমি-আপনি’র মতো এমন বৈচিত্র্যময় প্রকাশ আর সুললিত সুমধুর আবেগের কারণে প্রিয় বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমাদের ভালোবাসা আর গর্বের শেষ নেই।

ভাষার সমৃদ্ধি নির্ভর করে এর যথাযোগ্য ব্যবহার, চর্চা, গ্রহণযোগ্যতা আর সর্বজনীনতার ওপর। ভাষা দুর্বল হয়ে যাওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে রয়েছে ভাষার বিকৃতিসাধন, রূপান্তর, ব্যবহারে অসচেতনতা, অপব্যবহার, ক্ষমতাসীন মহলের উদাসীনতা।

বিশ্বায়নের কালে আকাশসংস্কৃতি আর অবাধ তথ্য প্রবাহের এই সময়ে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় অন্যান্য ভাষার সঙ্গে আমাদের সমৃদ্ধ বাংলা ভাষাকেও নামতে হয়েছে কঠিন পরীক্ষায়। কিছু বিদেশি শব্দ সময়ের দাবিতেই বাংলায় ঢুকেছে। ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকায় আমাদের ভাষায় ইংরেজির প্রাধান্য লক্ষণীয়। আর কে না জানে বাঙালি নিজেদের কৌলিন্য প্রকাশ করতে ইংরেজিকেই যুৎসই বিবেচনা করে। ইংরেজি জানলে সমাজের উঁচু শ্রেণিতে স্থান পেতে আর কোনো বাধা নেই এমন ধারণাও মজ্জাগত। একাধিক ভাষায় দক্ষতা থাকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এ সময়ে বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটোছুটি করতে ইংরেজির বিকল্প নেই। তবে ম্যান্ডারিন, স্পেনীয় বা পর্তুগীজ ভাষাও বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে নিজেদের দাবি করতে পারে। কারণ অর্থনীতির সঙ্গে ভাষার যোগসূত্র অনস্বীকার্য। তাই ভাষাগত দক্ষতা একজন মানুষের অর্জিত সাফল্য বলা যেতে পারে।

ভাষা প্রবহমান নদীর মতোই, যার হাজারো বাঁক। বাঁকে বাঁকে পরিবর্তনের ছোঁয়া। কালের যাত্রাপথে তাই অন্য ভাষার ব্যবহার ব্যকরণগতভাবেই মেনে নেয়া হয়েছে। বিদেশি শব্দ বাংলায় রূপান্তর করার পরীক্ষা নিরীক্ষায় কিছু শব্দের রূপান্তর বাংলায় স্থান পায় আবার কিছু রূপান্তর অনুত্তীর্ণ হয়। যেমন ‘মোবাইল ফোন’-এর বাংলা ‘মুঠোফোন’ শব্দটি বেশ ভালোই জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু ' ‘ফেসবুক’ শব্দের বাংলা ‘বদন বই’ বা ‘ইন্টারনেট’ শব্দের বাংলা ‘অন্তর্জাল’ শব্দটি খুব একটা কদর পায়নি। ‘ ফেসবুক’ বা ‘ইন্টারনেট’-এর মতো শক্তিশালী শব্দের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এর বাংলা অর্থগুলো। তাই সময়ের দাবিতে সর্বজনীন শক্তিশালী বিদেশি শব্দ মেনে নেয়ার বিকল্প নেই। তবে অতিমাত্রায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার ভাষাকে সংকটে ফেলে, ভাষার নিজস্বতা বাধাগ্রস্ত হয়।

ভাষার বিকৃতি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ইংরেজি হরফে বাংলা লেখা যেমন দূষণীয় তেমনি ভুল বা অশুদ্ধ বানানে বাংলা লেখা, পড়া ও বলাও অগ্রহণযোগ্য। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ, আমরা খুব অসচেতনভাবে আমাদের প্রাণের ভাষাটিকে বিকৃতির চূড়ান্তপর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি। আবার অনেক শিক্ষিত সচেতন মানুষও অতি আধুনিকতার নামে লেখায় এবং বলায় ভাষাকে বিকৃত করছে। আঞ্চলিক ও কথ্যভাষার সংমিশ্রণে অদ্ভুত উচ্চারণে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, যা বাংলাভাষাকে দুর্বল করছে, শক্তিমত্তা ক্ষুণ্ণ করছে।

সৈয়দ শামসুল হকের মতো আঞ্চলিক ভাষায় ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ লেখার সক্ষমতা কজনেরইবা আছে। ভেবে দেখার সময় এসেছে, যে ভাষার জন্য পৃথিবীর একমাত্র জাতি হিসেবে জীবন দিয়েছি সেই ভাষাকেই কেন এত অবজ্ঞা করছি। মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলতে পড়তে এবং লিখতে পারার মধ্যে যে পরমানন্দ আছে, যেদিন আমরা বুঝতে পারব সেদিন থেকেই বাংলা আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। রবীন্দ্রনাথ এই ভাষাতেই সৃষ্টি করেছেন তার অনবদ্য সব রচনা। রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে, গান শুনে হৃদয়ে যে আবেগ উথলে ওঠে তা কি অন্য ভাষায় ধরা যেত? জীবনানন্দ এই ভাষাতেই জীবন ও প্রকৃতির অনুপম আলেখ্য রচনা করেছেন।

জীবনের সব আকুলতা, ব্যকুলতা, হৃদয় নিংড়ানো অনুভূতি, যা চিত্তকে আলোড়িত করে, চেতনাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে, তা শুধু নিজের ভাষাতেই ব্যক্ত করা সম্ভব। অন্তরের গভীর আবেগকে স্বরে এবং সুরে প্রকাশে নিজের ভাষাই একমাত্র আশ্রয়। একজন গর্বিত বাঙালি হিসেবে, একজন বাংলাভাষী হিসেবে আমার ভাষাই আমার প্রথম এবং শেষ অনুপ্রেরণা, ভালো লাগা, ভালোবাসা।

লেখক: প্রাবন্ধিক, শিক্ষক।

এ বিভাগের আরো খবর