১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর দেশে যে সামরিক সরকারের অপশাসন জেঁকে বসেছিল তা থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণের ক্রান্তিকালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পালন করেছেন এক ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব এবং একারণেই তিনি সবার কাছে হয়ে আছেন সবচেয়ে প্রশংসিত ব্যক্তি। ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলনের মুখে তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের পতন ঘটলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দেশশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তনে ভূমিকা রাখেন।
এরশাদ সরকারের পতনের পর আন্দোলনরত সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করে এরশাদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পলান করেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ দেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান যা পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই ধরনের সরকার ব্যবস্থা যেহেতু গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাংলাদেশেই প্রথম গৃহীত হয় তাই সেই বিবেচনায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদই হচ্ছেন ইতিহাসের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সেই সময়ের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসেবে একটি সফল এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক ইতিহাস রচনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও সেই নির্বাচন নিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সূক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ তুলেছিলেন। অভিযোগটি মোটেই অমূলক ছিল না, বরং অভিযোগের যথেষ্ট ভিত্তি ছিল। একটি মৌলবাদী পত্রিকায় একচেটিয়া আওয়ামী লীগবিরোধী অপপ্রচার, গোপনে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে পবিত্র ধর্মের নামে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট দলকে ভোটদানে অঙ্গীকার করানো, অগণতান্ত্রিক এবং ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশ ভারত হয়ে যাবে বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছে নির্বাচনি প্রচারের অংশ হিসেবে।
এসবই ছিল মূলত সূক্ষ্ম কারচুপি। কেননা সেই নির্বাচনে কোনো দলের জয়-পরাজয়ের নেপথ্যে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একটি সত্যিকার অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এসব সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র এড়াতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। যদিও এসব সূক্ষ্ম কারচুপি সংঘটিত হয়েছিল মাঠপর্যায়ে এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরে যা বুঝে ওঠা সেই সময় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্বটা তার উপরই বর্তায়।
এটুকু বাদ দিলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সত্যিকার অর্থে একটি সফল ও গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছিলেন। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং সবচেয়ে কম প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একজন সফল বিচারকের পাশাপাশি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং এই দক্ষ ও কঠোর প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের সাক্ষ্য তিনি রেখেছেন সেই নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার সময়। সাধারণত দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে কোনো স্বৈরশাসকের পতন ঘটলে দেশের আইনশৃঙ্খলার যথেষ্ট অবনতি হয়ে থাকে। কিন্তু বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কঠোর প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে তেমন কিছুই ঘটেনি।
সবকিছু চলেছে যথানিয়মে এবং কোনোরকম ব্যাত্যয় ঘটেনি। এমনকি তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান থাকাকালে অন্যায়, দুর্নীতি, সন্ত্রাস অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। জনমনে এমন ধারণা হয়েছিল যে, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ক্ষমতায় থাকলে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় না তার ভয়েই দুর্নীতি সন্ত্রাস অন্যায় এমনিতেই অনেক হ্রাস পায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন শেষে তিনি তার স্বীয়পদ প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যান। যদিও এজন্য দেশের সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছিল। একজন ব্যক্তির জন্য সংবিধান সংশোধন নিয়ে অনেকে সমালোচনাও করেছেন, কিন্তু এটি করতে হয়েছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নীতি এবং ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে যেয়ে। সেই বিবেচনায় এটি যে খুব দোষের তা বলা যাবে না। সেই প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব সফলভাবে সম্পন্ন করেই তিনি ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অবসরে যান।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজি হননি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে সরাসরি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে কথা বলে তার অভিভাবক হিসেবে তাকে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানালে তিনি রাজি হন এবং সবার সম্মতি ও সমর্থন লাভ করেন। এমনটাই আমরা তখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জেনেছিলাম।
আওয়ামী লীগের অনেক ত্যাগী, বর্ষীয়ান এবং নিবেদিতপ্রাণ নেতা থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেছিলেন শুধু একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যে দেশের সর্বোচ্চ স্থানে যেন একজন নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি আসীন থাকেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে সংসদে ভাষণ প্রদানের সময় রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নিজের একটি মন্তব্য জুড়ে দেন এবং সেখানে তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন যে, এই ভাষণটি তার লেখা নয়, তিনি শুধু পাঠ করছেন মাত্র। মহান জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণের প্রারম্ভে তার এমন মন্তব্য সেসময় যথেষ্ট সমালোচিতও হয়েছিল। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক প্রণীত ভাষণ রাষ্ট্রপতি পাঠ করবেন এটাই রীতি ও রেওয়াজ যা সবাই জানেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সম্মান করেছেন এবং মর্যাদা দিয়েছেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসরে যাওয়ার পর থেকেছেন নীরবে-নিভৃতে। এখানেও তিনি সৃষ্টি করেছেন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। দেশের প্রধান বিচারপতির পদে সফল দায়িত্ব পালন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পালন এবং দেশের ক্রান্তিকালে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার মতো সফল অভিজ্ঞতার ঝুলি থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেকে অবসরপ্রপ্ত ব্যক্তি হিসেবেই বিবেচনা করেছেন।
দেশের কোনো বিষয়ে মুখ খোলেননি। তাকে নিয়ে যে কথা বা আলোচনা-সমালোচনা হয়নি, তেমন নয়। কিন্তু তিনি কোনো কথার জবাব দেননি। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তার কাজের সমালোচনা থাকবেই। তিনি তার বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন যার মূল্যায়নের ভার দেশের মানুষ এবং রাজনীতিবিদদের। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ জানতেন কোথায় থামতে হবে এবং সেখানেই তিনি থেমেছেন। আর এটাই হওয়া উচিত। দেশের সর্বোচ্চ পদে দায়িত্ব পলানের পর আর কিছু বলার নেই, দেওয়ারও নেই, তাইতো তিনি থেকেছেন নীরবে নিভৃতে।
এমনটাই হওয়া উচিত এবং এটিই সবার অনুসরণ করার কথা যেমনটা বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে হয়ে থাকে। ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ বুশ বা এমনকি প্রতিবেশী দেশের অনেকেই অবসরে যেয়ে কোনো কথাই বলেন না। এমনকি সদ্য অবসরে যাওয়া অ্যাঞ্জেলা মার্কেলকেও বর্তমান বিশ্বের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে ইউরোপের সংকটকালেও কোনো মন্তব্য করতে দেখিনি। যদিও এমন আদর্শের বড় অভাব আমাদের দেশে কেননা এখানে মানুষ মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত পরামর্শ দিয়ে যান। সেদিক থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
দোষে-গুণে মানুষ। সাহাবুদ্দীন আহমদও একজন মানুষ তাই তারও কিছু ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে তিনি যে আদর্শ-নীতি, সততা এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তা সবার জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। রাজনীতির ব্যক্তি না হয়েও দেশের রাজনীতিতে তিনি যেভাবে আলোচিত তাই তাকে মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের গণতন্ত্র উত্তরণের পথে যে অবদান রেখেছেন তা জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গেই স্মরণ করবে। যতদিন দেশে গণতন্ত্র সুসংহত না হবে, যতদিন দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাবে এবং যতদিন দেশে নির্বাচন নিয়ে কথা হবে ততদিনই সবার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
দীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য জীবন পার করে প্রধান বিচারপতি পদে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে এবং জাতির ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের সফল দায়িত্ব পালন শেষে নীরবে-নিভৃতে থেকে সাহাবুদ্দীন আহমদ পরিণত বয়সে চলে গেলেন না ফেরার দেশে সেখানে তিনি ভালো থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন এ কামনা করি।
লেখক: ব্যাংকার, কলাম লেখক। টরনটো, কানাডাপ্রবাসী