বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পুরস্কার কেন বিতর্ক সৃষ্টি করে

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২০ মার্চ, ২০২২ ১৬:০১

সামরিক শাসকের দোসর ও স্বাধীনতাবিরোধীরা এই পুরস্কার মাহবুবুল আলম চাষীর হাতেও তুলে দিয়েছে। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু হত্যায় তার সমর্থন আর মোশতাকের দোসর হওয়ার উপহারস্বরূপ তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছিল! সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু নামে এক নৌ-কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এই পুরস্কার দেয়া হয়। অথচ পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। এমন অনেকের গলাতেই ‘স্বাধীনতা পদক’ তুলে দেয়া হয়েছে যাদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো যোগ ছিল না। শর্ষিনার পীরকে পুরস্কার দেয়া নিয়ে অতীতে অনেক কথাই হয়েছে।

সমালোচনার মুখে মো. আমির হামজার স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করা হয়েছে। চলতি বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য তার নাম ঘোষণা করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার পর আমির হামজার নাম বাদ দিয়ে নতুন করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামের তালিকা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এর আগে ২০২০ সালেও সাহিত্য ক্যাটাগরিতে যাকে প্রথমে মনোনয়ন দিয়েছিল তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। পরে সমালোচনার মুখে এস এম রইজ উদ্দিন আহম্মদের মনোনয়ন বাতিল করেছিল সরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ একটি পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে বার বার কেন একই ভুল হচ্ছে? অযোগ্য ব্যক্তিকে যারা মনোনয়ন দিচ্ছেন, বাছাই ও অনুমোদন করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না? দেশটা কি তবে কিছু ব্যক্তির খেয়াল-খুশি মতোই চলবে?

পুরস্কার, পদক, খেতাব, সম্মাননা ইত্যাদিতে মানুষের এক চিরন্তন ভালোলাগার অনুভূতি আছে। আছে তৃপ্তি ও ভালোবাসা। কারণ এতে স্বীকৃতি ও সম্মান আছে। কেউ তার অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান পেলে অবশ্যই ভালো লাগবে। কারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত কাজ, অবদান ও অর্জনের স্বীকৃতি পেতে চায়। এ স্বীকৃতি দেয় সম্প্রদায়, সমাজ ও দেশ। কখনও কখনও সে স্বীকৃতি একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যের একটি কাজের পুরস্কার, যেমন পুলিৎজার পুরস্কার বা বুকার পুরস্কার। আবার কখনও কখনও কোনো কোনো পুরস্কার কোনো একটি বিষয়ে সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেয়া হয়। যেমন নোবেল পুরস্কার।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হচ্ছে স্বাধীনতা পুরস্কার। জাতীয় জীবনে কিংবা নির্ধারিত কয়েকটি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ পুরস্কার প্রতি বছর দেয়া হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার হচ্ছে একুশে পদক। শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি-শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রতি বছর একুশে পদক দেওয়া হয়। বাংলাদেশের আরেকটি অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার হচ্ছে বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এটিও একটি বাৎসরিক পুরস্কার, যা বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য প্রদান করা হয়।

এই তিনটি পুরস্কার নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক ক্রমেই বাড়ছে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যোগ্যদের পাশাপাশি অযোগ্যরাও পুরস্কৃত হচ্ছেন। একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশ ও মানুষের কল্যাণে অসাধারণ, প্রশংসনীয় ও গৌরবোজ্জ্বল অবদান না থাকলেও ওপর মহলের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ থাকায় অনেকে রাষ্ট্রীয় এসব পদক-পুরস্কার-সম্মান পেয়ে যাচ্ছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকার-সমর্থকেরাই সব সময় বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। কখনও কখনও কম যোগ্যতা সত্ত্বেও অন্ধ দলীয় সমর্থককে পুরস্কৃত করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি কলঙ্কিত হয়েছে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার। সামরিক শাসকের দোসর ও স্বাধীনতাবিরোধীরা এই পুরস্কার মাহবুবুল আলম চাষীর হাতেও তুলে দিয়েছে। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু হত্যায় তার সমর্থন আর মোশতাকের দোসর হওয়ার উপহারস্বরূপ তাকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছিল! সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু নামে এক নৌ-কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এই পুরস্কার দেয়া হয়। অথচ পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। এমন অনেকের গলাতেই ‘স্বাধীনতা পদক’ তুলে দেয়া হয়েছে যাদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো যোগ ছিল না। শর্ষিনার পীরকে পুরস্কার দেয়া নিয়ে অতীতে অনেক কথাই হয়েছে। সেটা তো আমাদের জন্য একটা মস্ত জাতীয় কলঙ্ক।

আবার রাজনৈতিক মতলব থেকে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির পিতাকে পুরস্কৃত করে তাকে খাটো করার অপপ্রয়াসের ঘটনাও আছে। উল্লেখ্য, যারা দেশের স্বাধীনতার স্থপতি তাদের স্থান সব রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ঊর্ধ্বে। গান্ধী, ওয়াশিংটন বা লেনিনকে রাষ্ট্রীয় কোনো খেতাব বা পদক দেয়া হয়নি। তাদের নামে পদক দেয়া হয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে বিএনপির আমলে স্বাধীনতার পদক দেয়া হয়েছে, তাও আবার তার সরকারের অধীনস্থ সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যুক্তভাবে।

এর পেছনে রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য ছিল অবশ্যই। এটা ছিল একই সঙ্গে মতলব ও অজ্ঞতার মিশেল। মতলব ছিল জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমপর্যায়ে তুলে আনা এবং অজ্ঞতা ছিল জাতির পিতাকে কখনও সবার জন্য প্রচলিত সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক বা খেতাবও দেয়া হয়নি এটা জানানো। অথচ বিএনপির আমলে এই খারাপ দৃষ্টান্তটি স্থাপন করা হয়েছে।

যাহোক, অনেক অযোগ্য, অখ্যাত, কুখ্যাত ব্যক্তি পদক পেলেও আজও অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে পদক-পদবি দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, এমন অনেক ব্যক্তিত্বও এসব রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাননি। দেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। ওই কমিশনের সদস্য হিসেবে ছিলেন তিন অর্থনীতিবিদ ড. মোশাররফ হোসেন (প্রয়াত), ড. আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তাদের মধ্যে একমাত্র রেহমান সোবহান ২০০৮ সালে স্বাধীনতা পদক পান।

অনেক নাম আছে স্বাধীনতা পুরস্কার কিংবা একুশে পদকের জন্য। অথচ যার নাম কেউ শোনেননি, যার কোনো অবদান বিষয়ে কেউ অবগত নন, তেমন ব্যক্তিরাও স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন এবং এখনও পাচ্ছেন। কম্পিউটার ও মোবাইলে ‘অভ্র’ ইউনিকোডে বাংলা লেখা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে গেছে দমকা হাওয়ার মতো। অভ্র’র উদ্ভাবক মেহেদী হাসান খানকে আজ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন আরও অনেককেই পাওয়া যাবে যাদের অবদান জাতিকে এগিয়ে দিয়েছে কিন্তু তাদের পুরস্কৃত করা হয়নি।

আসলে আমাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার কজন পাবেন, কারা পাবেন এবং কী অবদানের জন্য পাবেন, তা নির্দিষ্ট করে কোথাও বলা নেই। সরকারের কাগুজে একটি নীতিমালা থাকলেও তা সচরাচর মানা হয় না। নিয়মে বলা আছে, যেকোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানকে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার স্বাধীনতা পুরস্কার বা একুশে পদক দিতে পারে। এসব পুরস্কারের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো পুরস্কারের জন্য প্রার্থীকে বা তার পক্ষে মনোনয়ন দানকারীকে আবেদনের ৩০টি অনুলিপি জমা দিতে হয়। কৃতী ব্যক্তিরা নিজের উদ্যোগে এসব করতে স্বস্তি বোধ করেন না।

আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি এই কাজটি করেন না। জুরিবোর্ডে, মন্ত্রণালয় বা সরকারের কমিটিতে যারা থাকেন, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য বিশিষ্ট নাগরিককে খুঁজে বের করার দায়িত্ব আসলে তাদের ওপরই বর্তায়। কিন্তু তারা এই কাজটি যথাযথভাবে করেন না। তাদের সেই গরজও নেই। এই পুরস্কারের জন্য তারাই সবচেয়ে বেশি আবেদন করেন বা তাদেরই মনোনয়ন দান করা হয়, যাদের পুরস্কার-লিপ্সার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ প্রবল। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থের গচ্চা গেলেও প্রায় ক্ষেত্রেই যথাযথ ব্যক্তিরা পুরস্কৃত হন না। অযোগ্যদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ায় যোগ্যদেরও প্রকারান্তরে অপমান করা হয়।

আমাদের দেশে পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নানা ধরনের অসংগতি লক্ষ করা যায়। অনেক যোগ্য ব্যক্তি পুরস্কার পেয়েছেন, অযোগ্যদের সঙ্গে, একই মঞ্চে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য ব্যক্তিটি আগে বিবেচিত হননি। অযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে হয়তো আগের বার পুরস্কৃত করা হয়েছে, পরের বার যোগ্য ব্যক্তিটিকে। এর মাধ্যমেও আসলে যোগ্য ব্যক্তিটিকে অসম্মান করা হয়।

অনেক সময় যোগ্যদের পুরস্কৃত করা হয় অযোগ্যদের জায়েজ করার অংশ হিসেবে। এটাকেও কেউ কেউ পুরস্কার-ইঞ্জিনিয়ারিং হিসেবে অভিহিত করছেন। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন শাখায় যদি দশজনকে পুরস্কার দেয়া হয় তাহলে সেখানে আটজনকে নির্বাচিত করা হয় অযোগ্যতার মাপকাঠিতে আর বাকি দুজনকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে। কিন্তু যে-দুজনকে যোগ্যতার মাপকাঠিতে নির্বাচন করা হয় তারা বলি হন অন্য আটজনের। এই দুজনকে দিয়ে তারা অন্য আটজনকে বৈধ করে নেন। আর অযোগ্যতাকেই যখন যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়, তখন তা যোগ্যদের জন্য লজ্জার কারণ হয়ে ওঠে।

পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মরণোত্তর শব্দটিও বাংলাদেশে বহুল পরিচিত। সরকারি পদক-পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সম্ভবত মৃত ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান। এসব ক্ষেত্রে পদক-পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা থাকে ‘মরণোত্তর’। এটা নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যদি বিপত্নীক হন এবং তার ভাই-বোন ভাতিজি-ভাগনি কিছুই না থাকে, তার শ্বশুর-শাশুড়ি বা শ্যালক-শ্যালিকা মেডেল নিতে আসেন তাতে প্রাপকের কী প্রাপ্তি? তারপরও ‘মরণোত্তর’ পুরস্কার প্রদানের প্রথা চলছেই।

স্বাধীনতার পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পদক-পুরস্কার তো বটেই যেকোনো পদক পুরস্কার প্রদানে নাম বাছাইয়ের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সততা ও সুবিবেচনা থাকা উচিত। দলপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি থেকে এই সম্মানজনক পুরস্কার ও পদকগুলোকে ঊর্ধ্বে রাখা দরকার। নইলে এগুলো তার সম্মান ও মর্যাদা হারাবে। রাজনৈতিক অনুগ্রহ হিসেবে যেন এই পদক ও পুরস্কারগুলোকে ব্যবহার করা না হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক ছাত্রনেতা

এ বিভাগের আরো খবর