প্রতি বছর শবেবরাত এলে সেই শৈশব-কৈশোরের ছবিটাই ভেসে ওঠে। আমি নিশ্চিত যে আমাদের মতো মাঝবয়সী বা কাছাকাছি বয়সের যারা, তাদের সবার কাছেই শবেবরাত মানে বাল্য-শৈশবের স্মৃতি। শবেবরাতকে ঘিরে বাসায় বাসায় বিভিন্ন ধরনের হালুয়া-রুটি রান্না হতো। সেটা আবার পাড়া-প্রতিবেশীর বাসায় ট্রেতে করে পাঠানো হতো।
দরিদ্র মানুষের মধ্যে সাধ্যমতো হালুয়া-রুটি বিতরণ করা হতো। বাসায় হাতের তৈরি চালের রুটির পাশাপাশি দোকান থেকে কিনে আনা হতো মাছ, কুমির সাইজের বড় বন রুটি। বাড়িঘর, বারান্দা মোমবাতি দিয়ে সাজানো হতো। সকালে আমাদের নিউকলোনিতে এবং অনেক পাড়া-মহল্লায় গরুর মাংসের ভাগ বিক্রি হতো। প্রাণভরে খাওয়া-দাওয়া, বিলিবণ্টন শেষে রাতে সবাই মিলে নামাজ পড়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা। ছেলেরা দল বেঁধে মসজিদে যেত, পাড়াময় স্বাধীনমতো করে ঘুরে বেড়াত। সঙ্গে ফুটাত পটকা, জ্বালাত তারাবাতি।
অথচ এখনকার বাচ্চাদের কাছে শবেবরাতের কোনো আলাদা মহিমা বা আনন্দ নেই। একক পরিবার এসে পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন এই সম্পর্কগুলোকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। এখন শবেবরাত, ঈদ, মহরমের মতো উৎসব আয়োজনগুলো পরিবারভিত্তিক হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের পরিবারের শিশুদের কাছে এর কোনো আলাদা ছায়া পড়ে না। এসব আয়োজন বা এর কোনো আনন্দই এখন আর তাদের স্পর্শ করে না। তাদের কাছে এর চেয়ে ঢের আনন্দের বিষয় মোবাইল বা ল্যাপটপে চোখ রেখে থাকা, বার্গার বা মুরগিভাজা খাওয়া। এই জমানাতে আমরা সবাই বর্তমান নিয়ে বাঁচি, আরও সচ্ছলতার পেছনে ছুটি আর আবেগ-ভালেঅবাসাকে কবরস্থ করার চেষ্টা করি।
আমাদের মতো পাড়া, কলোনিভিত্তিক জীবন এবং ছোটবেলা যাদের কেটেছে, যাদের সেই পরিচিত বলয় ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে কিংবা নতুন ভবন গড়বে বলে নিজেদের স্মৃতিতে ভরা আবাসন ভেঙে ফেলা হয়েছে- তারা জানে স্মৃতি কী, আবেগ, ভালোবাসা কতটা মহার্ঘ।
ঠিক সেরকমই একটি স্মৃতির কথা লিখছি। আমি জানি অনেকের সঙ্গেই হয়ত এ ধরনের স্মৃতিকথা মিলে যাবে। আমার মা আজ থেকে সাত বছর আগে ২০১৫ সালে আসাদগেট নিউকলোনির যে বাসাটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, সেই বাসায় সে পা রেখেছিল নতুন বউ হয়ে ৫১ বছর আগে। এই বাসায় আম্মা তার দু’সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, স্বামীর সঙ্গে ২৮ বছর সংসার করেছেন। আমাদের অসংখ্য আত্মীয় এখান থেকে তাদের পড়াশোনা শেষ করেছে। এর চেয়েও আরও বেশি সংখ্যক আত্মীয়-অনাত্মীয় এখানে এসেছে- থেকেছে বিভিন্ন কাজে। আর অগণিত মানুষ এই সরাইখানা টাইপ ছোট, সাদামাটা বাসাটিকে ঘিরে ঢাকা শহরে তাদের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। সবচেয়ে বড় স্মৃতি আব্বা এই বাসা থেকেই শেষবিদায় নিয়েছেন ১৯৯২ সালে।
নতুন ভবন হবে বলে আমাদের যখন বলা হলো- এই পলেস্তারা খসে পড়া ও প্রায় ভেঙে পড়া ভবনটি ছাড়তে হবে, তখন একদিকে দারুণ আনন্দ হলো যে, আমরা নতুন বাড়ি পাব। অন্যদিকে পরিচিত পরিবেশ, প্রতিবেশী-স্বজন ছেড়ে যেতে আনন্দের চেয়ে কষ্ট হলো ঢের বেশি। এত বছরের সাজানো সংসার গুটিয়ে নিয়ে ৩/৪ বছরের জন্য চলে যেতে আম্মার এবং আমাদেরও বুক ফেটে যাচ্ছিল। এত স্মৃতি কি ব্যাগে ভরে নিয়ে যাওয়া যায়? কিন্তু আম্মা তাই চাচ্ছিলেন।
এই বাড়ির প্রতিটি ইট কাঠ আমাদের চেনে, আমাদের সব কথা জানে। আম্মা কোন জিনিসটা সঙ্গে নেবে, আর কোনটা ছেড়ে যাবে, তা ভাবতে ভাবতেই তার চোখ জলে ভিজে যাচ্ছিল। বার বার বলছিল, এইতো এই বারান্দায় তোর আব্বা অফিস থেকে এসে বসে থাকত, এই চেয়ারে বসে গল্প করত, এই দুটো ট্রাংক নিয়ে আমরা গ্রামের বাড়ি যেতাম, এই যে তোর দাদির ট্র্যাংক, তোর আব্বার বই, লেখা, স্মারক উপহার, সংসার খরচের পয়সা কষ্ট করে বানানো আমার কাঠের আসবাব, হাঁড়ি-পাতিল, জগ-গ্লাস এতকিছু কী করব, কোথায় রাখব এসব ?
আম্মাও জানে, আমরাও জানতাম সব পুরোনো স্মৃতি আমরা টেনে নিয়ে যেতে পারব না। কিন্তু তারপরও এই দীর্ঘ পথচলার নুড়ি-পাথর, ছবি, মায়া আমাদের ডাক দিয়ে যাচ্ছিল। এই বাড়িটা শুধু আমাদের কাছে বাড়ি ছিল না, ছিল অপরিমিত হাসি-আনন্দ, শক্তি আর শান্তির উৎস। শুধু কি আত্মীয়-স্বজন? বন্ধুদের অবাধ যাতায়াত, আড্ডা আর আনন্দের জায়গা ছিল আমাদের ছোট বাসাটা। এখানে যেটুকু কষ্ট ছিল, তা আমরা, মানে এই বাসায় থাকা একঝাঁক মানুষ ভাগ করে নিয়েছিলাম।
কেন যেন আম্মার এই বাড়ি ছাড়ার দৃশ্যটি দেখে আমার বার বার মনে পড়েছে দেশবিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা গল্প-উপন্যাসের কথা। সাম্প্রতিক সময়ে এসে দেখেছি করোনাকালে মানুষের ঘরবাড়ি ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য, দহগ্রাম-আঙ্গোরপোতার মানুষগুলোর দেশ, স্বজন ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ কষ্ট। তাদের চোখে মুখে যে কষ্ট ছিল, আম্মার চেহারাতে সেটাই দেখতে পেয়েছিলাম। এতবছর একসঙ্গে থাকা মানুষগুলো যে কে, কোথায় চলে গেল, কে জানে ।
আব্বা ১৯৯২ সালে চলে যাওয়ার পর থেকে এই বাসাটিকে ঘিরেই আম্মা দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আব্বাকে, তৎকালীন মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদককে, অভিজাত এলাকায় বাসা বরাদ্দ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আব্বা এই কলোনিতেই বরাদ্দ চেয়ে নিয়েছিলেন। পরে আব্বা বলেছিলেন অন্য বাসা নিলে আমরা তা ধরে রাখতে পারতাম না বিভিন্ন কারণে, বরং এখানে সবার সঙ্গে কম খরচে থাকব সেটাই ভালো। আব্বার সেই কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল।
আব্বা অকালে চলে যাওয়ার পর এই ফ্ল্যাটটি ছিল বলেই আমরা ঢাকার বুকে টিকে থাকতে পেরেছিলাম। আসাদগেট নিউকলোনির ৭টি বিল্ডিংয়ে যারা বসবাস করেছে বা করছিল, তারা শুধু প্রতিবেশী ছিল না, ছিল সবার আত্মার আত্মীয়। কলোনির মাঠে আমরা খেলেছি, রাস্তায় রাস্তায় দলবেঁধে ঘুরেছি, মাঠে বৃষ্টির পানি জমে গেলে তাতে মাছ ধরেছি, খেলাঘর, কবিতার দল ‘স্বগতোক্তি’ করেছি। ঈদ, শবেবরাত, পূজা, পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি সব উৎসবই করেছি সবাই মিলে।
আম্মাদের দেখিনি কোনো একটি ভালো খাবার পাশের বাড়িতে না দিয়ে খেতে। আমাদের বন্ধুবান্ধবের দলটাও ছিল অনেক বড়। আমরাও যেকোনো খাবার ১০ জনে ভাগ করে খেতাম। কিন্তু আইয়ুব খানের সময়ে তৈরি এই কলোনির ভবনগুলোর বয়স হয়েছিল। দিনে দিনে জৌলুস হারিয়ে, রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় চলে গিয়েছিল আমাদের বহু স্মৃতিবিজড়িত বাসাগুলো। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়িগুলো ভেঙে নতুন ভবন তৈরি করেছে।
তখন দেখেছি আমরা যেভাবে বাড়িভাঙার এই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পেরেছিলাম, আম্মা বা আম্মার বয়সি মানুষগুলো তা পারেননি। কারণ আম্মার কাছে জীবন মানে সবাইকে নিয়ে থাকা, হাসি আনন্দ, কষ্ট ভাগ করে নেয়া। আম্মা চারটা বছর খেতে পারতেন না, গল্প করতে পারতেন না, চোখ ছলছল করতো। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা আমাদের জানা ছিল না। আম্মা করুণ কণ্ঠে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমরা কি তাহলে উদ্বাস্তু হয়ে গেলাম?’
এরও চারবছর পর নতুন বাসাটিতে দাঁড়িয়ে আম্মা তার প্রশ্নের জবাব পেয়েছেন। অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। আম্মা বাসার চাবিটা হাতে পাওয়ার পর আনন্দে আমাদের সবার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছিল। শুধু বার বার আব্বার কথা মনে হচ্ছিল। এই কলোনিতে বছরের পর বছর যারা বাস করেছে, যারা ঈদ-পার্বণে খাবার ভাগ করে খেয়েছে, যে শিশুরা এই মাঠে খেলেছে, যে কিশোর, তরুণ-তরুণীরা কলোনির পথে-ঘাটে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিয়েছে, তারা কিন্তু অনেকেই হারিয়ে গেছে। ফিরে পায়নি তাদের পুরোনো সম্পর্ক, হারানো আবাসন।
সময়ের আবর্তে আমরাও হারিয়ে ফেলেছি স্মৃতি-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সৌহার্দ্য। আর তাইতো বাড়ছে অপরাধ, হিংসা, হানাহানি। মমতাহীন সমাজ ভালোবাসাহীন মানুষেরই জন্ম দেবে। আজ এইক্ষণে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করি জীবনে ব্যাগভরা স্মৃতি ও ভালোবাসার দামই সবচেয়ে বেশি। যদি পারতাম ব্যাগ থেকে ভালোবাসাময় স্মৃতিগুলোকে বের করে আনতাম।
লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন