বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

খাঁটি বাংলা ব্যাকরণের খোঁজে

  •    
  • ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৬:৪১

খাঁটি বাংলার জন্য খাঁটি ব্যাকরণ রচনার কথা বহুবার শোনা গেছে, কার্যত কিছুই হয়নি। এই কাজে সংশ্লিষ্টরাও এগিয়ে আসেননি। শুদ্ধরূপে বাংলা পড়তে লিখতে ও বলতে পারব- এমন ব্যাকরণের জন্য শতাব্দীকাল পাড়ি দিলেও সেই মহানায়কের সন্ধান মেলেনি, যিনি আমাদের বলবেন, এই হচ্ছে সেই ব্যাকরণ, যা বাংলার মানুষের কথা ও চলিত ভাষার রূপ ধারণ করেছে। বিশ শতকের গোড়ায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বাংলা ব্যাকরণকে সহজসাধ্য করে সংস্কৃত অনুশাসন মুক্ত করার জন্য।

বাংলা ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ তৈরির জন্য রামমোহন রায় ও রবীন্দ্রনাথ থেকে পরবর্তীকালের অনেক বিদগ্ধজন হা হুতাশ করেছেন। ব্যাকরণবিদরা নিজেরাও বলেছেন, ‘বাঙলা ভাষায় খাঁটি ব্যাকরণ একখানিও নেই।’ রবীন্দ্রনাথ ব্যাকরণ রচনার নির্দেশিকা দিলেও সে গুরু দায়িত্ব পালনে কেউ এগিয়ে আসেননি। বরং ব্যাকরণের বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ রচনা এবং চলিত বাংলার ব্যাকরণ রচনার জন্য রবীন্দ্রনাথকে বিরুদ্ধ পক্ষের তীব্র বিষোদ্গার সহ্য করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বার বার বলেছেন, চলিত বাংলা ব্যাকরণের ভিত্তি হওয়া উচিত প্রাকৃত বাংলা। রবীন্দ্রপূর্ব ও পরবর্তী যুগের ব্যাকরণবিদরা বাংলা ব্যাকরণের ভিত্তি সংস্কৃত ব্যাকরণের ওপর স্থাপন করেছিলেন। বাংলা ভাষা যে সংস্কৃত থেকে যে আলাদা সেটা জানা সত্ত্বেও ব্যাকরণবিদরা ওই নির্ভরতা থেকে সরে আসেননি। হাজার বছরের পথ পেরিয়ে আসা বাংলা ভাষা, মূলত বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক।

রাজনৈতিক বিপর্যয়, অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ত ও সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যেও বাংলার মানুষ বাংলা ভাষার মাধ্যমে নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এই ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলেছে রাজপথে। এই ভাষার পথ ধরেই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করেছে। বিস্ময়কর যে, সেই বাংলা ভাষার নেই নিজস্ব কোনো ব্যাকরণ। গত দু’শ বছরের বেশি সময়ে অনেক ব্যাকরণ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কিন্তু তার একটিও বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নয়। সবই সংস্কৃতানুসারী।

বাংলা এখন রাষ্ট্রভাষা। বিশ্বের ত্রিশ কোটি মানুষের ভাষা। এই ভাষায় উন্নতমানের শিল্প-সাহিত্য রচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি নিজেও সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন এবং একজন সুলেখকও বটে, তিনি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা শুধু নয়, বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা ও গ্রহণের জন্য প্রস্তাবও রেখেছেন। বাংলা ভাষার প্রসার ও বিকাশ গঠনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে দুই বাংলার গবেষক ও ভাষাবিদদের সমন্বয়ে বাংলা একাডেমী গত ২০০৯ সালে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ তৈরির কাজ শুরু করেছে। যার লক্ষ্যই হলো সংস্কৃত ব্যাকরণের জটিল ঘেরাটোপ থেকে বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণকে মুক্তিদান।

অবশ্য জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথম দফা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। দেশে ফিরে তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য বাংলা একাডেমীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ লালিত চলিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ প্রণয়নের জন্য উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর তার এই উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে। এটা বাঙালি জাতির জন্য অবশ্যই গর্বের বিষয়। এত প্রাচীন এবং নানারকম কলাবতী বিচিত্র সাজের মাতৃভাষার কোন রূপের ব্যাকরণ করা প্রয়োজন- সে সিদ্ধান্তের ভার শেখ হাসিনা বিশেষজ্ঞদেরই নিতে বলেছিলেন। শেখ হাসিনা নিজে লেখালেখি করেন সেই আশির দশক থেকেই। নিজেও বাংলাভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন ও চর্চা করছেন। তাই বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে ভাবনাটা সহজাত। তিনি নিজেও আক্ষেপ করে বলেছেন, এখনও একখানি খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ রচিত হয় নাই- এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’

দল এবং প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে দাপ্তরিক ভাষা বাংলার হালহকিকত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিশ্চয় জানা। তাই তার কার্যকালেই বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও প্রসার শুধু নয়, খাঁটি বিশুদ্ধ বাংলা ব্যাকরণ পাবে জাতি- প্রত্যাশা স্বাভাবিক। বাংলাভাষার গঠন বৈশিষ্ট্যর সম্যক রূপটি জানতে বাংলা ব্যাকরণ পাঠ অবশ্য কর্তব্য-শুদ্ধতাবাদীদের এই যুক্তি সন্দেহাতীত রূপে সত্য হলেও বাংলা ব্যাকরণ বাংলাভাষাকে শৃঙ্খলিত করে তাকে সর্বজনস্বীকৃত ভাষারূপে দাঁড়াবার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে- এ-ও এক বাস্তব সত্য। আর এই সত্য তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জানা। তাকে এই ব্যাকরণচর্চা এখনও করতে হয় লেখালেখির সুবাদে হলেও।

আমাদের বাল্যকালে বিদ্যালয়ে প্রথমেই যে সংজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা হচ্ছে ‘যে বিদ্যা পাঠ করিলে ভাষা শুদ্ধ করে লিখিতে,পড়িতে ও বলিতে পারা যায় তাকে ব্যাকরণ বলে।’ আরও ধাপ উপরে ওঠে সংজ্ঞার বিস্তার মিলল এভাবে- “যে শাস্ত্রে ভাষার বিশ্লেষণ দ্বারা অংশসমূহের বিচার, পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ বিচার, যোগাযোগের প্রণালির বিচার, ভাষা রচনার প্রণালির বিচার এবং ভাষার শুদ্ধাশুদ্ধির বিচার করা হয়- তাকেই সে ভাষার ব্যাকরণ বলে।’ সংজ্ঞা যথার্থ হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।

এসব ব্যাকরণ পাঠে আর যাই হোক ভাষা শুদ্ধভাবে শেখা যায়নি, যায় না। প্রচলিত বাংলা ব্যাকরণ এখানেই নিষ্ফল মাথা কুটে মরে যেন। রামমোহন রায়, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বা রবীন্দ্রনাথের মতো মহাজ্ঞানীরা চেয়েছিলেন বাংলা ব্যাকরণকে সংস্কৃত ব্যাকরণের আঁচল থেকে বের করে খাঁটি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচনা করতে। এ জন্য তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামতও দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘পতাকা বহিবার শক্তি’ নিয়ে কেউ এগিয়ে আসেননি সে অর্থে।

বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার প্রস্তাবের পাশাপাশি ভাষার উন্নয়ন যে জরুরি- এ চিন্তাও শেখ হাসিনার সমভাবে কাজ করেছে। তাই ভাষার ব্যাকরণ যে প্রয়োজন এবং গুরুত্ববহ সেই উপলব্ধিটাই সামনে এসেছে। আসাটাই স্বাভাবিক। কারণ বাংলা ভাষার জন্য জেল-জুলুম, হুলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলার ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য তিনি আপ্রাণ সচেষ্ট ছিলেন। তার উদ্যোগে স্বাধীনতার পর ঢাকায় আর্ন্তজাতিক সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল। ওই প্রথম এবং ওই শেষ। আর হয়নি।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ বাংলা একাডেমীর একুশের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে জাতির পিতা বলেছিলেন ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষার পণ্ডিতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন তারপরে বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না।

পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন- আমরা ক্ষমতা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে।’ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনের জন্য নানা উদ্যোগও নিয়েছিলেন, সে সবই ইতিহাসের অংশ।

বাংলা ভাষার ব্যাকরণের দুর্ভাগ্য যে, রবীন্দ্রপূর্ব যুগ থেকে আজও সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণের ওপর নির্ভশীল রয়ে গেছে। বাংলা ভাষাকে এখনও অনেকাংশে সংস্কৃত ভাষার অনুশাসন দিয়ে চলতে হয়। যদিও বাংলাভাষার শৃঙ্খলা ও অনুশাসন সংস্কৃতের প্রশ্ন বাদ দিয়ে সম্পূর্ণরূপে বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতি লক্ষ করে নির্ধারণ করাই ছিল সংগত। সংস্কৃতের পুরোনো শৃঙ্খলার মধ্যে বাঙালির আধুনিক চিন্তা বিড়ম্বিত হোক রবীন্দ্রনাথ তা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা ভাষার উন্নততর নতুন শৃঙ্খলা।

এটাতো ঠিক যে, সংস্কৃত থেকে বাংলার পার্থক্য ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। তারপরও বাংলা বর্ণমালা বানান পদ্ধতি এবং ব্যাকরণ মৃতভাষা সংস্কৃতানুসারী। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাভাষার প্রায় শতকরা সত্তরটা শব্দকে সংস্কৃত, সংস্কৃতজাত ও বিকৃত বা ভাঙা সংস্কৃত শব্দ। আর সম্ভবত, সে কারণে মন-মননের প্রবণতা ও যুক্তিনিষ্ঠার ক্ষেত্রে এখনও সংস্কৃত ব্যাকরণ মেনে চলা হয়।

দিও জানা যে, শব্দই ভাষা নয়, অন্বিত ধ্বনিই ভাষা। আর বাংলাভাষা কখনই সংস্কৃত নয়। অবশ্য বাংলা বর্ণের, বানান ও ব্যাকরণের উচ্চারণের ত্রুটি অনেক। ভাষাবিদরা এমন আশঙ্কাও করছেন যে, সংস্কার না হলে স্থানিক, দৈশিক,রাষ্ট্রিক, গোষ্ঠীক পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্জনের মাধ্যমে নানা ভাষাগোষ্ঠীর সৃষ্টি হবে। যেমন হয়েছে উড়িয়া- অহোমি বাংলা ভাষার মতো। বাংলাভাষায় পরিবর্তন, গ্রহণ-বর্জন, অদল-বদল চলেছে সবসময়। কিন্তু সবক্ষেত্রে যে তা সর্বজনগ্রাহ্য হয়েছে, তা নয়।

ব্যাকরণের কাছে প্রত্যাশাটা কী? ব্যাকরণ মূলত, চলমান ভাষার নিয়মরীতি আবিষ্কার করে। অবশ্য ভাষা কখনই ব্যাকরণকে অনুসরণ করে না। বরং ব্যাকরণই ভাষার নিত্যদিনের গতিকে পর্যবেক্ষণ করে নীতি-নিয়ম খুঁজে নেয়।

বাংলা ব্যাকরণ তো আসলে প্রবহমান কার্যক্রমই হওয়ার কথা।নিয়ত ভাষার শব্দ ভান্ডার, বিচাররীতি, বানান পদ্ধতি ও বাক্য সংযোগের মধ্যে নানা কারণে নতুন নতুন পথ খুলে যাওয়ার কথা। ব্যাকরণ পরবর্তীকালে সেসব পথ ধরে নিয়মকে আবিষ্কার করবে বা ভাষার ব্যবচ্ছেদ করবে- তেমন আশা করা হয়েছিল সব সময়ই। ভাষা যদি স্থির এবং অপরিবর্তনীয় থাকে তবে একটা ব্যাকরণই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ব্যবহারিক প্রবহমান যে একটি ভাষা বাংলা- সে বাংলার ব্যাকরণ গড়ে নেয়ার কাজটিও একটা ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড হওয়া জরুরি হলেও তা হয়নি।

বাংলা ব্যবহারিক রচনার কাজটিও শিক্ষাক্রম রচনার মতো ধারাবাহিক একটি কর্মকাণ্ড হওয়া সংগত বলে ভাষাবিদরা মনে করে এসেছেন। কার্যত কাজ তেমন হয়নি। শতবর্ষেরও আগে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন, ব্যাকরণ নতুন কোনও কথা সৃষ্টি করতে পারে না, ব্যাকরণ শুধু ‘দেখিয়া যাইবে, দেখাই ইহার কাজ’, ভাষার শতমুখী গতি আবিষ্কার করাই ব্যাকরণের কাজ।

একটি ভাষাকে চলমান রাখে সে ভাষার ব্যাকরণ। কথ্যভাষাতেও ব্যাকরণের অনুশাসন আছে। আমি, আমরা, তিনি, তারা, করেছিলাম, করছি, করব প্রভৃতি শব্দ যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা যায় না। আর লেখনের ক্ষেত্রে ব্যাকরণের অনুপস্থিতি অকল্পনীয়। ব্যাকরণ ভাষার মেরুদণ্ডকে সোজা রাখবে, তার সচল, সরল প্রবহমানতা ক্ষুণ্ন করবে না। তাই ব্যাকরণ লেখকের কাছেও চর্চার বিষয়।

অনুরূপভাবে অভিধান ভাষার ক্ষেত্রে পরিভাষা, বানান প্রভৃতির অভিভাবক স্বরূপ। কোনো একটি বিদেশি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ, অথবা বাংলায় কোনো শব্দের নানা অর্থ অভিধানের মাধ্যমে পাওয়া যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যমান বাংলা ভাষার ব্যাকরণ বাংলা মুখের ভাষা নিয়ে। বাংলা সাধুভাষা সংস্কৃত ভাষারই আদর্শভিত্তিক। আর সাধু ভাষারই বিবর্তিত রূপ বাংলা চলিত ভাষা। অথচ এই চলিত ভাষাপোযোগী ব্যাকরণ রচিত হয়নি। এটা আজকের বাস্তবতা যে, বাংলা ভাষায় কেবল মান-কথ্য বাংলার বা বাংলা চলিত রীতির একটি ব্যাকরণ রচনা করা প্রয়োজন।

দেখা গেছে বিদেশিদের বাংলা শেখানোর জন্য ইংরেজি ভাষায় যেসব বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোতে মান বাংলা কথ্যরীতিভিত্তিক চলিত রীতিকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন, চলিত বাংলা “চলতি বলেই সম্পূর্ণ নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা যায় না। হয়তো উচ্চারণে এবং বাক্য ব্যবহারে একজনের সঙ্গে আর একজনের সকল বিষয়ে মিল এখনো পাকা হতে পারে নি। কিন্তু যে ভাষা সাহিত্যে আশ্রয় নিয়েছে তাকে নিয়ে ক্ষতি হবার আশংকা আছে। এখন থেকে বিক্ষিপ্ত পথগুলিকে একটি পথে মিলিয়ে নেবার কাজ শুরু করা চাই।” ভাষা বিষয়ে খুবই সচেতন এবং স্পর্শকাতর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা আধুনিক ভাষার অনেকখানিই তিনি মার্জনা- পরিমার্জনা করেছেন।

বাংলা ব্যাকরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন। প্রথমত, বিশেষ সংক্রান্তি ভাবনায় তিনি বাংলা বহুবচন, বাংলা নির্দেশক, বাংলা স্ত্রীলিঙ্গ প্রসঙ্গে লিখেছেন। দ্বিতীয়ত, শব্দ গঠন ভাবনায় বাংলা কৃৎ ও তদ্বিত প্রত্যয় বাংলা শব্দদ্বৈত; বাংলা ধনাত্মক শব্দ, বাংলা বিশেষ্য বিশেষণ এবং তৃতীয়ত বাংলা ক্রিয়াপদ সম্পর্কে সুগভীর চিন্তা ও নির্দেশাত্মক প্রবন্ধ লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার সম ও পূর্বকালে বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে বিভিন্ন পণ্ডিতদের রচনা সম্পর্কে মতামত রেখেছেন প্রবন্ধগুলোয়।

খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ না থাকার আক্ষেপ গত এক শতকের বেশি শুনে আসা হয়েছে। শতবর্ষেরও আগে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন ‘‘বাঙ্গালা ভাষায় খাঁটি ব্যাকরণ একখানিও নাই।’’ আর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছিলেন, “এখন যাহাকে বাঙ্গালা ব্যাকরণ বলা হয়, উহা বাঙ্গালা ব্যাকরণ নহে। বাঙ্গালা ভাষা সংস্কৃত হইতে যাহা পাইয়াছে, সংস্কৃতের নিকট যে অংশ ঋণস্বরূপ গ্রহণ করিয়াছে- সেই অংশের ব্যাকরণ। বাঙ্গালার যে অংশ সংস্কৃত হইতে ধার করা নহে, সে অংশ খাঁটি বাংলা সে অংশের ব্যাকরণ নাই। সে অংশের ব্যাকরণ এখন গড়িতে হইবে। খাঁটি বাংলার আলোচনা করিয়া তাহাকে খাড়া করিয়া তুলিতে হইবে।”

বিবর্তনের প্রথম দশক থেকেই মানুষের কণ্ঠধ্বনির সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশের চেষ্টার ফলে সৃষ্টি হয়েছে ভাষা। প্রাচীনকালে একটি নির্দিষ্ট ভাষা থেকে ধ্বনিগত অর্থগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে জন্ম হয়েছে বহু ভাষার। ভাষাগুলিকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছে ব্যাকরণ। অর্থাৎ ব্যাকরণ হলো একটি বিদ্যা। যার প্রয়োগে ভাষাকে সুষ্ঠুভাবে লেখা, পড়া এবং কথায় ব্যবহার করা যায়।

উনিশ শতকের আগে রচিত বাংলা ছিল পদ্য ছন্দে। উনিশ শতকের গোড়ায় গদ্য সৃষ্টি হলো কতিপয় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দ্বারা। মুখের ভাষাকে তারা সাহিত্য রচনার অনুপযুক্ত মনে করে ইচ্ছেমতো সংস্কৃত সন্ধি ও সমাস প্রয়োগ করে এক কৃত্রিম দুর্বহ বাংলার সৃষ্টি করলেন। যার ক্রিয়া ও সর্বনামের রূপটি থাকল প্রাচীন বাংলা কবিতার অনুরূপ। এই সংস্কৃত ভাষার ওপর ভিত্তি করে রচিত হলো বাংলা ব্যাকরণ। যা বাংলা ভাষাকে আরও দুরূহ ও জটিল করেছে।

প্রশ্ন ওঠেছে এমনও যে, মানভাষার ওপর ভিত্তি করে খাঁটি বাংলা ব্যাকরণ রচনা কি আদৌ সম্ভব? যাকে স্টান্ডার্ড ভাষা বলা হচ্ছে; তার সমস্ত উপাদান তো ব্যাকরণের বিধিবিধানের তোয়াক্কা করে গড়ে ওঠে না। এটাতো চিরন্তন বাস্তবতা যে, কোনো সৃজনশীল লেখক ও কবি কখনোই ব্যাকরণের নির্দিষ্ট পথে এগোতে পারে না। তা হলে সৃষ্টিতে বন্ধ্যত্ব আসা স্বাভাবিক। তবে বহুল প্রচলনের ব্যবহারিক বাংলা অর্থাৎ মান বাংলা হিসেবে কথ্য বাংলায় ব্যাকরণ গড়ে তোলাটাই অত্যাবশ্যক।

রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেনই এবং মান্য মুখের ভাষার ব্যাকরণের কথা তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, চলিত বাংলা ব্যাকরণই হবে প্রাকৃত বাংলা ব্যাকরণ। রাজা রামমোহন বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেননি। তিনি লিখেছেন ‘ গৌড়ীয় ব্যাকরণ।’ সেই গ্রন্থে নিজেই প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, ‘পদে পদে সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসনে কেন চলবে বাংলা ভাষা?’ রামমোহন বাংলা ভাষাকে সংস্কৃত ভাষা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ভাষারূপে বিবেচনা করতে চেয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষার ব্যাকরণকেও সংস্কৃত ব্যাকরণের ওপর নির্ভরশীল থাকার বিষয়ে তিনি আক্ষেপ করেছিলেন।

বাংলা ব্যাকরণ রচনা শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতকেই। প্রথম পর্বের ব্যাকরণ রচয়িতা ছিলেন ইউরোপীয়রা। মিশনারি পাদ্রিরা এ কাজে এগিয়ে এসেছেন। উদ্দেশ্য ধর্ম প্রচার ও ধর্মান্তকরণ। ইউরোপীয় বণিকরাও বাণিজ্যের সুবিধার্থে স্থানীয় ভাষার ব্যবহারে আগ্রহী ছিলেন। সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজ মিশনারিরা ধর্মপ্রচারে এ দেশে আসেন। বাংলা মিশনের অধ্যক্ষ ফাদার মার্কস আন্তনিও সাঁতুচি এবং সহযোগীরা ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে বাংলা ব্যাকরণ ও অভিধান সংকলন করেন। আঠারো শতকের গোড়ায় বাংলায় মুদ্রণ যন্ত্র প্রতিষ্ঠারও আগে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের লিসবনে রোমান হরফে ছাপা দুটি বাংলা বই প্রকাশিত হয়।

ম্যানোএল আসসুঁপসাঁও রচিত ‘ভোকাবুলারিও এম ইদিওমা বেঙ্গঁলা এ পর্তুগয়েজ’- অর্থাৎ বাংলা ও পর্তুগীজ ভাষার শব্দকোষ। অপরটি ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’। গবেষকদের ধারণা, ফাদার সাঁতুচি ও সতীর্থদের সংস্কৃত অভিধান ও ব্যাকরণ অবলম্বনে পাদ্রি ম্যানোএল গ্রন্থ দুটি প্রণয়ন করেন। এরপর পরবর্তী সময়ে হ্যালহেড ও উইলিয়াম কেরি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। তাদের আদর্শ ছিল লাতিন গ্রামার।

ম্যানোএল তার ব্যাকরণে কথ্য বাংলার রূপকে ধরবার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। যদিও সেই সময়ে লেখা সাধু ভাষাকে প্রাধান্য না দেয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। এমনকি তাদের পক্ষেও। বলা হয়, ধর্মপ্রচারের জন্য আগত পাদ্রি ম্যানোএল জীবন্ত বাংলা ভাষার প্রকৃত বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধানের ঐতিহাসিক স্বাক্ষর রেখেছেন তার রচিত ব্যাকরণ ও শব্দকোষ গ্রন্থে। অবশ্য বাংলাভাষায় প্রথম ব্যাকরণ রচয়িতা ন্যাথানিয়েল ব্রাসী হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩৯)। উইলিয়াম কেরি ১৮০১ সালে ‘এ গ্রামার অব দি বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলা অভিধানও রচনা করেন। বাংলা ব্যাকরণচর্চার ধারায় তাদের নাম অবশ্য স্মতর্ব্য।

পাদ্রি ম্যানোএল দা আস্সুম্পসান রচিত বাংলা ব্যাকরণ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রিয়রঞ্জন সেনের সম্পাদনায় ও অনুবাদে ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। বাংলা সংস্করণটি মূল গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ। মূল গ্রন্থে অভিধান অংশে প্রায় ৬ হাজার ৫৫০টি বাংলা শব্দ ছিল। বাংলা সংস্করণে রয়েছে ২ হাজার ৫০০টি বাংলা শব্দ। ১৮৮০ সালে প্রকাশিত হয় হর্নসের ‘এ কম্পারেটিভ গ্রামার অব দি গৌড়ীয়ান ল্যাঙ্গুয়েজস্’। জন বীমসের বাংলা ব্যাকরণের একটি সমৃদ্ধ সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। লেখাটি তার শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে সংকলিত আছে।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ বিশ শতকের গোড়ায় ব্যাকরণ সমিতি গঠন করেছিল। উদ্যোক্তা ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ এই সমিতির সদস্য ছিলেন। সমিতি বেশ কিছু সুপারিশ করেছিল। তবে সে নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থান তৈরি হয়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ভাষা আমরা ইচ্ছা করলে গড়তে ও ভাঙতে পারি, তা নয়। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু কোথায় কোথায় কী রূপ পার্থক্য আছে, সে-সব চিহ্নিত করা গেলে বাংলা ব্যাকরণ গঠন করা যায়।

‘বাংলা ব্যাকরণ সংস্কৃতমূলক হইবে কেন?’ প্রশ্ন রেখে রবীন্দ্রনাথ বিদগ্ধজনের কাছে জানতে চান, সংস্কৃত শব্দের বাহুল্য বাংলায় বেশি বলিয়াই ভাষার গঠনাদিও সংস্কৃত ব্যাকরণানুসারে করতে হবে কেন? রবীন্দ্রনাথ ব্যাখ্যা করলেন যে, বাংলা ভাষার প্রকৃতি কাঠামো সংস্কৃত থেকে পুরোপুরি আলাদা। তবে সংস্কৃত ব্যাকরণ আলোচনা করা প্রয়োজন। তা বাংলা ব্যাকরণের প্রয়োজনেই। সে সময়ই বাংলা ব্যাকরণের ক্ষেত্রে দু’টি পক্ষ দাঁড়ায়, একপক্ষ সংস্কৃতানুসারী, অপরপক্ষ চলিত বাংলা ব্যাকরণের পক্ষে। রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করিয়ে দেন যে, চলিত বাংলা ব্যাকরণ হবে প্রাকৃত বাংলা ব্যাকরণ।

পরবর্তীকালে স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ রচনার প্রয়োজন দেখা দিলে বাংলা ব্যাকরণ নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়। সে সময় এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, ব্যাকরণ ভাষা শিল্পের সহায়ক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভাষা কখনোই ব্যাকরণকে অনুসরণ করে না; বরং ব্যাকরণই ভাষার নিত্যদিনের গতিকে লক্ষ করে নীতি-নিয়ম খুঁজে নেয়। কিন্তু ব্যবহারিক প্রবহমান ভাষা বাংলার ব্যাকরণ গড়ে নেয়ার কাজটি ধারাবাহিক কর্মকাণ্ড হওয়া অত্যাবশকীয় হলেও সে কাজে নিষ্ঠাবান ব্যাকরণবিদ মেলেনি।

সাধু ও চলিত ভাষার রীতি; বানান সংস্কার, যুক্তাক্ষরের ব্যঞ্জনা, সবকিছুর যোগাযোগ ও বিশ্লেষণ নিয়ে বাংলা ব্যাকরণ গড়ে তোলার কথা ভাষাবিদরা সবসময় বলে এসেছেন। কিন্তু যুগ যুগ ধরে সংস্কৃতের ছাঁচেই রয়ে গেছে বাংলা ব্যাকরণ। সংস্কৃত ব্যাকরণের রূপরেখা ধরে ব্যাকরণবিদরা যে ব্যাকরণ রচনা করেছেন তাতে বাংলাভাষা মুক্তি পায়নি। যদিও ব্যাকরণবিদরা আশা করেন যে, বাংলা ভাষার প্রাণশক্তি এত প্রবল, এত প্রচুর যে সামান্য ঔদাসীন্যে তার অবনমন ঘটবে না। যারা শক্তিমান লেখক তারা স্বল্পশক্তি লেখকদের অনুপ্রাণিত করবেন। স্রোতের বেগে সমস্ত দূষণ অপহৃত হবে। কিন্তু কার্যত সে দূষণ আরও বাড়ছে নিয়ত। বাংলা ব্যাকরণে পাশ্চাত্য চিন্তার প্রসার ঘটানো গেলেও সে কাজ স্বতঃপ্রবৃত্ত বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা হয়নি।

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর পর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষা প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। এরপরও অনেকে ব্যাকরণ রচনায় নিয়োজিত হয়েছেন। কিন্তু সাধুরীতি বহাল থাকলেও এসব গ্রন্থে চলিত রীতি উপেক্ষিত হয়েছে। কথ্য বাংলা ব্যাকরণ রচনায় এগিয়ে এসেছিলেন ঢাকার ধামরাইয়ে জন্ম রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার। তবে তিনি কোনো পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ রচনা করেননি। করেছেন ‘পকেট বাংলা ব্যাকরণ’। কথ্য বাংলার ব্যাকরণ। অবশ্য বাংলা ব্যাকরণের রূপরেখার একটি খসড়া প্রস্তাব তিনি রেখেছিলেন গত শতকের শেষ দশকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এর কপি দিয়েছিলেন সাক্ষাৎকালে।

বাংলাভাষী মানুষ শতাব্দীকালেরও বেশি এক জটিল ব্যাকরণের আবর্তে আছে। খাঁটি বাংলার জন্য খাঁটি ব্যাকরণ রচনার কথা বহুবার শোনা গেছে, কার্যত কিছুই হয়নি। এই কাজে সংশ্লিষ্টরাও এগিয়ে আসেননি। শুদ্ধরূপে বাংলা পড়তে লিখতে ও বলতে পারব- এমন ব্যাকরণের জন্য শতাব্দীকাল পাড়ি দিলেও সেই মহানায়কের সন্ধান মেলেনি, যিনি আমাদের বলবেন, এই হচ্ছে সেই ব্যাকরণ, যা বাংলার মানুষের কথা ও চলিত ভাষার রূপ ধারণ করেছে। বিশ শতকের গোড়ায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বাংলা ব্যাকরণকে সহজসাধ্য করে সংস্কৃত অনুশাসন মুক্ত করার জন্য। শুদ্ধ বাংলা ব্যাকরণ রচিত হোক- সচেষ্ট হয়েছিলেন সে নিয়ে। ১৮৮৫ সালেই তিনি লিখছিলেন ‘প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ একখানিও প্রকাশিত হয় নাই।... বাংলা ব্যাকরণের অভাব আছে, ইহা পূরণ করিবার জন্য ভাষাতত্ত্বানুরাগী লোকের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিৎ।”

শতবর্ষ পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও লেখক শেখ হাসিনা ভাষাতত্ত্বানুরাগী হিসেবেই হোক আর জাতির পিতার কন্যা হিসেবেই হোক, বাঙালি জাতির ভাষাকে আরেক কঠিন অর্গল থেকে মুক্তি দেবার পথ প্রশস্ত করেছেন। তার উদ্যোগে বাংলা একাডেমী বাংলাভাষী ব্যাকরণবিদদের সমন্বয়ে যে ব্যাকরণ রচনার কাজ করছেন, তা সার্থক ও সফলপ্রসূ হবে, এমনটা প্রত্যাশা সহজাত। শেখ হাসিনা বলেছেনও, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালি রক্ত দিয়েছে। জেল, জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়েছে। সেই ভাষাকে কঠিন অর্গল মুক্ত করাই হবে জাতি হিসেবে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালি জাতি ব্যবহারিক শুদ্ধ বাংলা ব্যাকরণ অচিরেই পাবে এমন প্রত্যাশা থাকবে। আর এর মধ্যে রয়েছে অমর ভাষা শহীদদের রক্তদানের প্রতি সম্মাননা প্রদর্শন।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

এ বিভাগের আরো খবর