বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি ও সম্ভাবনা

  • মো. মুফাসসির রশীদ   
  • ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৭:৩৯

গত এক দশকে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের এক উর্বরভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ অর্থনীতির একটি ধরা হচ্ছে। একইসঙ্গে, বাংলাদেশের নীতিমালায় উন্নয়নের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে, ফরাসি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফ্রান্স বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতেই পারে।

বাংলাদেশ-ফ্রান্স দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০ বছর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ণ হলো। এই ৫০ বছরে দুটি দেশই উল্লেখযোগ্য সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পেরেছে। একদিকে ফ্রান্স যখন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়দের কাতারে চলে এসেছে, ঠিক তখন বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। পুরো সময়েই রাষ্ট্র দুটি তাদের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে এবং ফলে বর্তমান বাস্তবতায়, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির এই সময়ে দুই রাষ্ট্রের জন্যই সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ-ফ্রান্স দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সুচনা হয় ১৯৭২সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবসে। সেদিন ফ্রান্স সরকার সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর ঠিক পরের মাসেই, ১৭ মার্চে প্যারিসে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের মধ্য দিয়ে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তবে, বাঙালির সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্কের সূচনা এখানেই নয় বরং আরও পুরোনো। সতেরো শতকে ফরাসি বণিকদের তৎকালীন বাংলায় আগমনের মধ্য দিয়ে দুটি জাতির সম্পর্কের সুচনা হয়। এমনকি পলাশীর যুদ্ধে ফরাসি সৈনিকেরা শেষ নবাব সিরাজউদৌলার পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন বলেও ইতিহাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধেও বাংলাদেশের পক্ষে ফ্রান্সে জনমত তৈরি হয়েছিল।

বিগত ৫০ বছরে দুদেশের মধ্যে বেশ কিছু উচ্চপর্যায়ের রাষ্ট্রীয় সফর হয়েছে। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদ প্যারিসে যান। পরের বছর, ১৯৯০ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁ বাংলাদেশে আসেন। এছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ এবং অতিসম্প্রতি নভেম্বর ২০২১-এ প্যারিসে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সফরে। মন্ত্রিপর্যায়েও বেশ কটি সফর দুদেশেই হয়েছে যার মধ্যে ফরাসি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লির ২০২০ সালের ঢাকা সফর উল্লেখযোগ্য।

রাষ্ট্রীয় সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বহু আগেই। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তিসহ (১৯৮৭) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনেও ফ্রান্সের সহযোগিতা পেয়েছে বাংলাদেশ। সমস্যার শুরুর দিকেই ফ্রান্স জাতিসংঘে বেশ কটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিল।

রাজনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি একই সময়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও বৃদ্ধি পেয়েছে উত্তরোত্তর। ২০২০ সালে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২.৭৬ বিলিয়ন ইউরো; যার মধ্যে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ২.৫২ বিলিয়ন; এবং আমদানি ছিল ২৫ মিলিয়ন ইউরো। ফ্রান্সে বাংলাদেশ মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে এবং বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি আমদানি করে থাকে।

বাণিজ্যিক সম্পর্কের পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়নে ফ্রান্সের সহযোগিতাও রয়েছে। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট মিতেরাঁর বাংলাদেশে আগমনের মধ্য দিয়ে এই সহযোগিতার সূচনা হয়। সেই সফরে, ফ্রান্স বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ প্রকল্পে সাহায্য করে। বর্তমানে, বাংলাদেশে পানি শোধনাগার, পরিবেশ প্রকল্পসহ বেশ কটি ফরাসি প্রকল্প ও যৌথ ব্যবসা রয়েছে।

অর্থনৈতিক সহায়তার পাশাপাশি, ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশ প্রযুক্তি সহায়তাও পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট-বঙ্গবন্ধু-১ নির্মাণ করে ফরাসি প্রযুক্তি কোম্পানি থেলস। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু-২-এর ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। এছাড়াও, থেলস বাংলাদেশের এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়েও এই মুহূর্তে কাজ করছে। প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিয়েও দুদেশের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ ফরাসি কোম্পানি ‘দাস্যো এভিয়েশন’ থেকে রাফালে বিমান ক্রয়ের চিন্তাভাবনা করছে।

মহামারি মোকাবিলাতেও ফ্রান্স বাংলাদেশ সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। মহামারি মোকাবিলায় ফ্রান্স বাংলাদেশকে ১৫০ মিলিয়ন ইউরো লোন দিয়েছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ৫.৩৮ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাক্সিন সহায়তা দিয়েছে যা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।

বিশ্বায়নের এই যুগে, বিগত ৫০ বছর ধরে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে আন্ত-সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বা ‘ক্রস কালচার’ রিলেশনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮৭ সালের সাংস্কৃতিক সহায়তা চুক্তির পর থেকে এই সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে উত্তরোত্তর। ধীরে ধীরে ফরাসি ‘সফট পাওয়ার’-এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সমাজে। ফরাসি ভাষার প্রসারের জন্য আলিয়াস ফ্রঁসেস কাজ করে যাচ্ছে। একই সঙ্গে ফ্রেঞ্চ জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশ কিছু বিভাগে পড়াশোনার পাশাপাশি ফরাসি ভাষা শেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও তরুণদের মাঝে ফরাসি সংগীত, সিনেমা এবং দর্শন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

একই সঙ্গে, ফরাসি সমাজেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধীরে ধীরে ফ্রান্সে বাংলাদেশের ডায়াসপোরা কমিউনিটি বড় হচ্ছে। ২০১৭ সালের ইনসি পরিসংখ্যান অনুযায়ী তখন ফ্রান্সে ১ লাখ ৪ হাজার ৪শ ০০ বৈধ বাংলাদেশি বসবাসরত ছিলেন। ২০২২ সালে সংখ্যাটি নিঃসন্দেহে আরও বেশি হবে। প্যারিসে এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ের ওপর প্রদর্শনীও হচ্ছে। ফ্রান্সে কর্মরত বাংলাদেশিরা একইসঙ্গে ফ্রান্সের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছে, সেইসঙ্গে রেমিটেন্সও পাঠাচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের উষ্ণতা বিচারে দেখা যায়, দুদেশের জন্যই সম্পর্ক আরও জোরদার করার সুযোগ রয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। গত এক দশকে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগের এক উর্বরভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে ‘ফ্রন্টিয়ার ফাইভ’ অর্থনীতির একটি ধরা হচ্ছে। একইসঙ্গে, বাংলাদেশের নীতিমালায় উন্নয়নের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে, ফরাসি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ফ্রান্স বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতেই পারে। একইসঙ্গে, ফ্রান্সের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থেকে বাংলাদেশও উপকৃত হবে। দুদেশের মধ্যে এ ব্যাপারে আলোচনাও চলমান। সর্বশেষ সফরে যৌথ বিবৃতিতে রাষ্ট্রদুটি প্রযুক্তি সহায়তা বিশেষ করে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে তাদের লক্ষ্যবৃদ্ধির ঘোষণাও দিয়েছে।

এছাড়া, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিজেদের ভেতর সম্পর্ক বৃদ্ধির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। চলমান কোয়াড-চায়না দ্বন্দ্ব এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থান এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ বরাবরই পররাষ্ট্রনীতিতে সমতা বিধানের নীতি মেনে চলে তাই এখনও কোনো পক্ষাবলম্বন করছে না। অন্যদিকে, গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে ফ্রান্স নিজস্ব কৌশলনীতি ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থে দুটি দেশের মধ্যে সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে এ ক্ষেত্রে। দুটি দেশই অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল চাইছে। যৌথ বিবৃতিতেও এই চাওয়ার প্রতিফলন রয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে দুদেশ অবাধ, মুক্ত এবং নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নীতির প্রতি তাদের বিশ্বাসের ঘোষণা দিয়েছে।

অপরদিকে, দুদেশের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা সম্পর্ক উন্নয়নেরও সুযোগ রয়েছে। ফ্রান্সের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত এবং তরুণ শিক্ষার্থী ও উদীয়মান গবেষকদের জন্য উচ্চশিক্ষার জন্য অন্যতম সেরা পছন্দ। দুই দেশেরই তাই উচিত হবে স্কলারশিপ প্রোগ্রাম এবং সহজ ভিসা ব্যবস্থা তৈরি করা। এর ফলে, বাংলাদেশি মেধাবীরা যেমন ফ্রান্সের জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখতে পারবে একইসঙ্গে তারা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়েও দেশে ফিরতে পারবে। ফলে দুদেশই উপকৃত হতে পারে। এর বাইরেও, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশ হবে, তখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জিএসপি প্লাস প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত হতে ফ্রান্সের সাহায্য প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য গতিশীল রাখতে জিএসপি প্লাস স্কিমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো মতপার্থক্য নেই। যা রয়েছে সেগুলো খুবই সামান্য এবং সমাধানযোগ্য। তাই দুদেশের উচিত হবে ৫০ বছরপূর্তির এই বিশেষ ক্ষণে তাদের মধ্যকার উষ্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ এবং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় এই সম্পর্ককে সামনের দিনে আরও জোরদার করা। এতে বাংলাদেশ এবং ফ্রান্স দুদেশেরই উপকার হবে আশা করা যায়।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স উত্তীর্ণ।

এ বিভাগের আরো খবর