বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

শিশুশ্রমের আর্থসামাজিক অবস্থা: প্রয়োজন সমন্বিত কৌশল

  • সম্পাদকীয়   
  • ১৩ অক্টোবর, ২০২৫ ২২:৩১

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের পথ হয়ে উঠছে দুর্গম। শিশুরা শ্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ায় সমাজে তাদের অবস্থান, অশিক্ষিত, দরিদ্র ও মাদকাসক্ত, বখাটে এমনকি নানান অপরাধী মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক তথ্যমতে, শিশুশ্রমের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এটি কোনোভাবেই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক বার্তা নয়। তাই একজন শিশুর জীবনে শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা দেশ ও সমাজের জন্য জরুরি। কারণ একটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক অংশকে অবহেলায় অযত্নে রেখে সে দেশের উন্নতি আশা করা আকাশ কুসুম কল্পনা।বিশ্বের প্রায় প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম একটি গভীর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারতের মতো দেশে, যেখানে দারিদ্র্য এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রকট, সেখানে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে নানাবিধ আইন প্রণয়ন করছে। বাংলাদেশের শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী কিশোর শ্রমিকদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ থেকে ১৮ বছর। এছাড়াও আইনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকেই শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না। শ্রমজীবী শিশুদের বাবা মা কোনো মালিকের সাথে কোনো ধরনের চুক্তি করতে পারবেন না। এবং কোনো কিশোর শ্রমিককে যদি কাজে নিয়োগ করতে হয়, সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তারের কাছে মালিকের খরচে ফিটনেস সনদ সংগ্রহ করে তারপর তাকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এদের কাজের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে দৈনিক সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা। আর সেই সময় হতে হবে সন্ধ্যা সাতটা থেকে ভোর সাতটার বাহিরের সময়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আইনগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাগুজের দেয়ালে বন্ধী। বাস্তব চিত্র পুরোটাই মুদ্রার অন্য পিঠ। সরকারি একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৯ লক্ষ।এর মধ্যে শহরাঞ্চলের সংখ্যা ১৫ লক্ষ ও গ্রামাঞ্চলে ৬৪ লক্ষ। এই জরিপে থেকে আরও জানা যায় আমাদের দেশের শিশুরা যে ধরনের কাজের সাথে জড়িত তার মধ্যে প্রায় ৪৫টি কাজই ঝুঁকিপূর্ণ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রসমূহ অর্থনৈতিক শোষণ থেকে শিশুর অধিকার রক্ষা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম অর্থাৎ স্বাস্থ্য অথবা শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক, সামাজিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর অথবা শিশুর ব্যাঘাত ঘটায় অথবা বিপদ আশঙ্কা করে, এমন কাজ যেন না হয়, তার ব্যবস্থা নেবে’। এজন্য বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ শিশু সনদের এই ধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পেশার তালিকা চূড়ান্ত করে নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি এই শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য বহু পূর্বেই সরকার সারাদেশে ৯৯ শতাংশের বেশি শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ইটভাটা, গ্যারেজ, ওয়ার্ক শপ, হোটেল, দোকান, বিভিন্ন মিল কারখানায় দেখা যাবে বড়দের মতো শিশুরাও দিনরাত সব ধরনের স্বাভাবিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত। এতে করে তাদের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক, সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।এখন প্রশ্ন দাড়ায় শিশুশ্রম কেন হয়? এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। গরিব পরিবারে বাবা-মা যখন নিজেরাই সংসার চালাতে পারে না, তখন তারা সন্তানের হাতে বই না দিয়ে কাজে পাঠায়। কেউ ভাবেন, এখন যদি কাজ করে টাকা আনে, তাহলে অন্তত খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এতে তারা ভুল করে, কারণ পড়াশোনা না করলে সেই শিশু সারাজীবন দারিদ্র্যর শৃঙ্খলেই আটকে থাকবে। আরেকটি কারণ হলো অশিক্ষা। বাবা-মা যদি নিজেরাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তারা বোঝে না যে শিক্ষা ছাড়া জীবনে উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তারা ভাবে- কাজ করলেই টাকা আসবে, পড়াশোনায় সময় নষ্ট কেন! এর ফল হলো- প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। কিছু মালিকও দোষী। তারা জানে শিশুদের দিয়ে কাজ করালে কম টাকায় কাজ করানো যায়। তাই তারা শিশুশ্রমিক খোঁজে। এভাবে শিশুশ্রম চলতে থাকে। অথচ আমাদের আইন আছে, শিশুদের দিয়ে কঠিন কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন মানা হয় না, নজরদারি কম। ফলে শিশুদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হয়।শিশুশ্রমের সমাজতত্ব বিশ্লেষনের প্রয়োজন । যেমন ১. শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তাই তারা অশিক্ষিত থেকে যায়; ২. তাদের কোমল শরীর কষ্টে ভেঙে পড়ে। ভারী ইট বহন করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যায়, হোটেলে ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ফুসফুস নষ্ট হয়; ৩. তাদের মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়। খেলা না করতে পারায় তারা দুঃখী হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস হারায়; ৪. সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো- তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়; ৫. শিশু শ্রমের বেড়াজালে আটকে পড়া এসব শিশুরা হারিয়ে ফেলে তাদের শৈশব, কল্পনা, আনন্দ সবকিছুই। তারা হয় কাজের খাতিরে, নয়তো পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে কঠিন পরিশ্রমে নিযুক্ত থাকে, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর; ৬. শিশুশ্রমিকের জীবন কেমন হতে পারে, তার প্রকৃত চিত্র আমরা খুঁজে পাই আমাদের আশপাশের বহু বাস্তবতায়। শিশুদের শৈশব তো হলো খেলার মাঠে হাসিখুশি সময় কাটানো, বন্ধুর সঙ্গে গল্প করা এবং নতুন কিছু শিখে নিজেদের বিকাশের সুযোগ পাওয়া। কিন্তু যখন শিশুরা শ্রমের বেড়াজালে আটকে যায়, তখন তার জীবন হয়ে ওঠে শুধুই কাজের; ৭. শ্রমের কারণে তাদের পড়াশোনার সুযোগ একদম কমে যায়। এ কারণে শিশুশ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না, যার ফলে তাদের ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতার জন্য একেবারেই অযোগ্য হয়ে পড়ে; ৮. শিশুশ্রমিকদের ওপর কাজের চাপ, নিগ্রহ এবং অভাবের তাড়না তাদের মানসিকভাবে হতাশ ও বিপথগামী করে তোলে। তারা শৈশবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।শিশু শ্রমের অনেক কারণ রয়েছে; যেমন এক: অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের কাজের জন্য পাঠায়। কারণ তারা চায় তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি। পরিবারের অভাব-অনটন শিশুদের শ্রমের দিকে ঠেলে দেয়; দুই: পারিবারিক অশান্তি, বাবা-মায়ের অশিক্ষা অথবা একাধিক সন্তান থাকার কারণে অনেক সময় শিশুদের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ে, কারণ তারা মনে করে যে কাজের মাধ্যমে পরিবারকে সহায়তা করা যাবে; তিন: কিছু সমাজে বিশেষ করে গ্রাম-অঞ্চলে, শিশুদের কাজে লাগানোর একটি প্রচলিত অভ্যাস রয়েছে। এখানে শিশুকে স্কুলে পাঠানো অপেক্ষা কাজে পাঠানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়; চার : শিশুশ্রমে শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, এটি তাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে; পাঁচ: শিশুরা যখন ছোটবেলায় কঠোর কাজ করতে শুরু করে, তাদের শরীর আরও উন্নতি করতে পারে না। এতে তারা দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতায় ভোগে। যেমন- পিঠ, হাড়ের সমস্যার পাশাপাশি দুর্বল শরীরের কারণে রোগবালাইয়ের শিকার হয়; ছয় : শিশুশ্রম শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তারা হতাশাগ্রস্ত, অস্থির ও বিপথগামী হয়ে পড়ে। এছাড়া অনেক ক্ষেত্রে তারা মানসিক নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়; সাত: শিশুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো- তার শৈশব, যেখানে সে কল্পনা, খেলা এবং নতুন কিছু শিখে বেড়ে ওঠে। কিন্তু যখন সে শ্রমের মধ্যে আটকে যায়, তখন তার শৈশব হারিয়ে যায় এবং তা কখনও ফিরে আসে না; আট: আমাদের সমাজে হাজার হাজার শিশু আছে যারা বই হাতে নিতে পারে না। তাদের কাঁধে থাকে ভারী বোঝা, হাতে থাকে কাজের সরঞ্জাম, চোখে থাকে অবসাদের ছাপ। স্কুলে যাওয়ার বদলে তারা কাজ করতে যায়। কেউ হোটেলে থালা ধোয়, কেউ রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে, কেউ ইটভাটায় কাজ করে, কেউ বাসাবাড়িতে ঝাড়– দেয়। অথচ এই বয়সে তাদের বই পড়া, খেলা আর স্বপ্ন দেখার কথা ছিল। তাই আমরা বলতে চাই- শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই; নয়: শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য সরকার, সমাজ এবং পরিবারকেই একযোগে কাজ করতে হবে।এখন শিশুশ্রম বন্ধের এজন্য সরকারের বড় দায়িত্ব আছে; যেমন আইন ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন: শিক্ষা সুযোগ নিশ্চিতকরণ; পরিবারের সদস্যদের আয়ের উৎস বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করা; শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি; ধনী পরিবারগুলো গরিব শিশুদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারে; শিক্ষকরা চেষ্টা করবে, যাতে সব শিশু স্কুলে আসে, আর যারা ছাত্র, তারাও তাদেরকে স্কুলে টানব, যদি সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়। সর্বশেষে বলা যায় শিশুশ্রম সমাজের জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। এটি শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নষ্ট করে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দেয়। শিশু শ্রমের ফলে তারা অল্প মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হয়, যা দারিদ্র্য চিরস্থায়ী করে। অনেক সময় শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ ও অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে হয়, যা তাদের জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি শুধু শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করে না, বরং জাতির ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই শিশুদের সুরক্ষা, শিক্ষা এবং সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে শিশু শ্রম রোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। দেশটা আমাদের সবার। তাই দেশের সকল ভালোমন্দের ফলও ভোগ করতে হবে আমাদেরই। তাই আজকে আমরা শিশুশ্রমকে প্রশ্রয় দিলে ভবিষ্যতে নিরক্ষরতার বোঝা মাথায় করে বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের। তাই নিরক্ষরতার অন্ধকার থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার দায়িত্ব সরকারসহ আমাদের সবার।লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক।

এ বিভাগের আরো খবর