আমরা অনেকেই মনে হয় জাজমেন্টাল। কথায় কথায় রায় দিয়ে দেই- অমুককে দিয়ে কিছু হবে না বা কিছু হলো না। বা অমুক খুব সফল মানুষ। কিন্তু এই সাফল্য বা ব্যর্থতার মাপকাঠিটা কী? একটা সামাজিক মাপকাঠি অবশ্যই আছে। কিন্তু সামাজিক মাপকাঠির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছা। মানুষের জীবন একটাই। একজন ব্যক্তি কীভাবে তার জীবন যাপন করবেন, সেটা তার ইচ্ছা। একজন জেলে অল্প কিছু মাছ ধরে নৌকায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছিল। তার সঙ্গের মাঝিরা জানপ্রাণ দিয়ে মাছ ধরছিল। একজন সেই জেলেকে বলল, তুই শুয়ে আছিস কেন? আরও মাছ ধর। সেই জেলে জবাব দিল, আরও মাছ ধরলে কী হবে? তার বন্ধু বলল, আরও মাছ ধরলে, আরও টাকা পাবি। তারপর? আরও টাকা হলে আরও ভালো নৌকা কিনতে পারবি। তারপর? আরও নৌকা হলে আরও টাকা আসবে। তারপর? আরও টাকা হলে নৌকার পাশাপাশি একটা জাহাজ কিনতে পারবি। তারপর? আরও টাকা হলে সেই জাহাজের ডেকে শুয়ে শুয়ে আরাম করতে পারবি। সেই জেলে জবাব দিলো, আমি তো এখন তাই করছি। তাহলে আমার অত কষ্ট করার দরকার কী? যেটুকু দরকার সেটুকু মাছ তো আমি এরই মধ্যে ধরে ফেলেছি।
এখন আপনি প্রয়োজনীয় মাছ ধরা শেষে সেই জেলের মতো শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবেন নাকি ভবিষ্যতে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখার আশায় প্রাণান্তকর পরিশ্রম করবেন, সেটা আপনার ইচ্ছা। দুইটার পক্ষেই অনেক যুক্তি আছে। প্রয়োজন মিটলেই হলো, বাড়তি পরিশ্রম করে লাভ কী। আবার সবাই যদি সেই জেলের মতো প্রয়োজনীয় মাছটুকুই ধরে, তাহলে অগ্রগতি থেমে যাবে, মাছের আকাল পড়বে, কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাবে। তারপরও আপনি শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখবেন নাকি আরও মাছ ধরবেন; সেই সিদ্ধান্ত আপনারই। ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারপরও আমরা সাফল্য-ব্যর্থতা মাপি সমাজের কাঠিতে। পদ-পদবি,ক্ষমতা-অর্থ, অ্যাকাডেমিক সাফল্য, সন্তানের উন্নতি দিয়েই আমরা মাপি সাফল্য-ব্যর্থতা।
এবার আসুন মাপি, ফেসবুকে লাইভ করে আত্মহত্যা করা ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান সফল ছিলেন না ব্যর্থ? আত্মহত্যার আগে প্রায় ১৭ মিনিটের লাইভে আবু মহসিন খান প্রতারিত হওয়ার কথা, একাকিত্বের কথা, বঞ্চনার কথা, আশঙ্কার কথা, হতাশার কথা, অসুস্থতার কথা বলেছেন। তিনি হতাশ হতে পারেন, কিন্তু সামাজিক মানদণ্ডে তাকে ব্যর্থ বলা যাবে না। ৫৮ বছর বয়সি ব্যবসায়ী। তার হিসাব মতো দুই বন্ধু তার সাড়ে ৫ কোটি লোপাট করে দিয়েছে। তারপরও তিনি নিঃস্ব হয়ে গেছেন এমন দাবি তিনি করেননি। ধানমন্ডির যে ফ্ল্যাটে তিনি থাকতেন, সেটি তার নিজের। পত্রিকায় তার আরও একাধিক ফ্ল্যাটের খবর জেনেছি। তার নিজের গাড়ি আছে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। সামাজিক বিবেচনায় দুজনই প্রতিষ্ঠিত। ছেলে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়।
উন্নত অস্ট্রেলিয়ায় সচ্ছল জীবনযাপন করেন বলেই পত্রিকায় এসেছে। কন্যা তিনা মডেল এবং তার স্বামী চিত্রনায়ক রিয়াজ। আবু মহসিন খান নিজেও দীর্ঘদিন আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ায় থেকেছেন। ভিসা জটিলতায় এখন যেতে পারছিলেন না। কন্যা তিনা তাকে তাদের সঙ্গে থাকার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু আবু মহসিন খান নিজের সিদ্ধান্তে একা থাকতেন। ৫৮ বছর বয়সি একজন মানুষের কানায় কানায় পূর্ণ জীবন। জীবনের কাছে আর কী চাইতে পারতেন আবু মহসিন খান? তার ছেলে বা মেয়ে কি সব ছেড়েছুড়ে সারাক্ষণ তার পাশে থাকবে? এটা কিন্তু বাস্তবতা নয়। তারপরও তিনি আত্মহত্যা করলেন কেন? এই প্রশ্নের আসলেই কোনো জবাব নেই।
আবু মহসিন খান ক্যানসার আক্রান্ত ছিলেন। তবে অপারেশন করে তিনি ভালো হয়ে গিয়েছিলেন। অসুস্থতা তার আত্মহত্যার কারণ, এমন দাবি তিনি করেননি। আবু মহসিন খানের চেয়ে আরও অনেক বেশি অসুস্থ মানুষ বছরের পর বছর বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন; এমন অনেককে চিনি আমি। আবু মহসিন খান ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রতারিত হওয়ার কথা বলেছেন। তার মানে তার আরও অনেক টাকা ছিল। কিন্তু প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় জানেন না, পরদিন কী খাবেন; এমন হাজারও মানুষ আমাদের চারপাশে। রাজধানীর কারওয়ানবাজারে টুকরির ওপরে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখলে কোনটা সাফল্য, কোনটা ব্যর্থতা; কোনটা সুখ, কোনটা অসুখ- বিভ্রমে পড়ে যাই। দুঃখ কারো কারো কাছে বিলাসও বটে। আবার পেটের ভাত জোগানোর চেষ্টায় কারো কারো দুঃখের কথা ভাবারই সময় নেই।
ছেলে অস্ট্রেলিয়ায়, মেয়ে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত বলে আবু মহসিন খান একাকিত্বে ভুগছিলেন। কিন্তু এই একাকিত্বের ফাঁদ তো নিজেই পেতেছিলেন। ছেলে যখন অস্ট্রেলিয়ায় যান, তখন নিশ্চয়ই আবু মহসিন খান সবাইকে গর্ব করে বলেছেন ছেলের কথা। মেয়ে যখন মডেলিংয়ের সাফল্য পেয়েছেন, চিত্রনায়ক রিয়াজের সঙ্গে সুখে সংসার করছেন, তখনও নিশ্চয় সবাইকে আত্মতৃপ্তি নিয়েই মেয়ের কথা বলেছেন। এখন একাকিত্বের কথা বললে হবে কেন!
আপনাকে আগেই ঠিক করে নিতে হবে, আপনার কাছে সাফল্যের সংজ্ঞা কী? আপনি জীবনের কাছে, সন্তানদের কাছে কী চান? ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবেন, কলেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে দেবেন; পরে আশা করবেন, ছেলে আপনার পাশে থাকবে, আগলে রাখবে; সবটা তো একসঙ্গে হবে না। সাফল্যের নামে আমরা আসলে কীসের পেছনে ছুটছি?
লেখক: সাংবাদিক, কলাম লেখক