অমিক্রনের ধাক্কায় আবারও বন্ধ হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনার কারণে দেড় বছর কার্যত বন্ধ থাকার পর গত সেপ্টেম্বর থেকে একটু একটু করে চালু হচ্ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে পড়াশোনার কার্যক্রম। নতুন বছরের শুরুতে যখন স্কুল-কলেজে ক্লাসের সংখ্যা বাড়ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিনের আটকে থাকা পরীক্ষা নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা শিক্ষার জন্য একটা বড় আঘাত। আবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। অনেকেই এখনও মনে করেন, জীবন আগে, তারপর অন্য কিছু। কিন্তু করোনামহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দেখা যাচ্ছে౼ সব কিছুই চলছে, শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ থেকেছে। ‘জীবনের ঝুঁকি’ যেন যেন কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই। দেশের হাট-বাজার, অফিস-আদালত, গণপরিবহন— সবকিছু ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ খোলা রেখে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অমিক্রনের প্রবল ঢেউয়ের মধ্যেও বাণিজ্যমেলা চলেছে। খোলা রয়েছে পর্যটনকেন্দ্র। বিপিএল, পিঠা উৎসব, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিবাহ, জন্মদিনসহ সব রকম সামাজিক-ধর্মীয়-পারিবারিক অনুষ্ঠান বহাল আছে। কোথাও কোনো ঝুঁকি নেই, সতর্কতা নেই। তাহলে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেন করোনাঝুঁকি থাকবে?
শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশের শাসক, শিক্ষক, অভিভাবকরা যে উপেক্ষা দেখিয়েছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। বার বার প্রশ্ন উঠেছে, করোনা সংক্রমণ ছড়াবার সব পথ খোলা রেখে, এমনকি নির্বাচনি সভা অথবা বিভিন্ন ধর্মোৎসব উপলক্ষে জনসম্মেলনেও নিষেধাজ্ঞা না ঘোষণা করে, কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ রাখা হয়েছে কেন? সংক্রমণের আভাস পাওয়ামাত্র সবার আগে বন্ধ হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা এবং তা সবার পরে খুলেছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি উচ্চ শিক্ষা, সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কার্যত স্থগিত হয়েছে। ‘শিশুদের স্বার্থেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে’౼ এই বক্তব্য ক্রমেই দুর্বল মনে হচ্ছে।
আপাতত টিকাকরণও ধীরে হলেও শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে টিকা পেয়েছেন। বাকিদের টিকার আওতায় এনে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাজীবন চালু করার বিষয়টি না ভেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা বন্ধ করা কতটা সুবিবেচনাপ্রসূত হলো, সে প্রশ্ন থাকছেই। এমনিতেই পঠন-পাঠনের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সরকারি স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন পাঠদানের প্রযুক্তি পৌঁছেনি। সাপ্তাহিক লিখিত প্রশ্নোত্তর আদান-প্রদান নিয়মিত পঠনপাঠনের অতি সামান্য অংশ মেটাতে পারছে। শিশুদের দৌড়ঝাঁপ, আনন্দ, বিনোদনও শিকেয় উঠেছে।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাদের মধ্যে শিক্ষার অনাগ্রহ সৃষ্টি হওয়া, একাংশের পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া, মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেয়া, একা থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া, স্কুল-পাড়ায় খেলাধুলা-দৌড়াদৌড়ি না থাকায় শারীরিক সমস্যা বাড়া, বইয়ের চেয়ে ডিভাইসে আসক্তি মাত্রাতিরিক্ত হওয়া, পড়তে না বসায় অভিভাবকদের চাপ-বকার কারণে জেদ বেড়ে যাওয়া, নানাবিধ মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হওয়া প্রভৃতি বহু ধরনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, জানা-অজানা সমস্যা নতুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে, যা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।
সবচেয়ে দুঃখের কথা: দীর্ঘ দুই বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অচল হলেও কোনো মহল থেকেই বিকল্প উপায় সন্ধান করা হয়নি। রাজধানী ঢাকাতেও হয়নি, দেশের অন্য কোথাও তেমন প্রচেষ্টা হয়নি। স্কুল আংশিক খোলা রেখে, বিভিন্ন দিনে কিছু ছাত্রছাত্রীকে এনে, স্কুল ও পড়াশোনার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব কি না, সেই আলোচনাও শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে ঘটেনি। দীর্ঘ দিন পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাবার রীতি কী হবে, তার বিধি তৈরি করা হয়নি। এর প্রত্যাশিত ফলই ফলেছে— দুই বছরে অগণিত ছাত্রছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে গেছে।
শ্রেণিকক্ষের পড়ুয়া থেকে শিশুশ্রমিক, নাবালিকা বধূ ও সন্তানের মা হওয়ার হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলো সবার চোখের সামনেই ঘটে চলেছে। গ্রামের স্কুলগুলো কার্যত বন্ধ রাখার ফলে শিক্ষায় বৈষম্য আরও গভীর হয়েছে। শহরে ব্যয়বহুল বেসরকারি স্কুলগুলোয় নিয়মিত ডিজিটাল মাধ্যমে পঠনপাঠন হচ্ছে। গ্রামের দরিদ্র এলাকার স্কুলগুলোতে অনলাইন শিক্ষাদান হয়নি, হলেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী তার নাগাল পায়নি। ডিজিটাল বিভাজন দেখিয়েছে, শিক্ষার দ্বারা সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করার লক্ষ্য থেকে আমাদের দেশ ক্রমশই ভ্রষ্ট হয়েছে। তার প্রমাণস্বরূপ অনেক পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সংগঠনগুলো তা নিয়ে অনেক শোরগোল করেছে। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি।
করোনা মহামারি ঠিক কবে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। তা হলে তত দিন পর্যন্ত কি আমরা সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখব? লোকজন জীবিকার জন্য কাজে বেরোচ্ছেন, বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন, রেস্তরাঁয় খেতে যাচ্ছেন, উৎসব-অনুষ্ঠানে আনন্দ করছেন, আর স্কুল খুলতে গেলেই ভয় চেপে ধরছে? স্কুল বন্ধ থাকায় শহুরে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের খুব যে ক্ষতি হচ্ছে, তা নয়।
বরং তারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সময়মতো পড়াশোনা করতে পারছে। কিন্তু ছোট শহর বা গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের কথা কি একবারও ভেবেছেন কেউ? এদের কাছে ন্যূনতম প্রাথমিক শিক্ষাটুকু পৌঁছানো কত কঠিন! এদের ফোন নেই, ফোন আছে তো ইন্টারনেট নেই, অনলাইন ক্লাস করার দক্ষতা নেই। অনেকে আবার অনলাইন ক্লাসের নামে সারাদিন মোবাইলে বুঁদ হয়ে থাকছে। অভিভাবকদের অসচেতনতার জন্য ফোনটার অপব্যবহার করছে। এতে শিশুদের যে কী সর্বনাশ হচ্ছে, তা কি আমরা ভালোভাবে তলিয়ে দেখছি?
অভিভাবক ও কোনো কোনো নাগরিকের ক্ষোভ অনেকটাই বর্ষিত হতে দেখা যায় শিক্ষকদের ওপর। ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাবঞ্চিত, অথচ শিক্ষকরা সবেতন ছুটি কাটাচ্ছেন। যদিও শিক্ষকরা এমন অভিযোগ মানতে নারাজ। তারা স্কুলে যাচ্ছেন, বিভিন্ন দাপ্তরিক কাজ সামলাচ্ছেন, নিজেদের মতো শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিচ্ছেন, অনলাইন ক্লাস নেয়ার চেষ্টা করছেন, নানা কাজে ব্যস্ত থাকছেন। শিক্ষকরা মোটেও স্বস্তিতে নেই। একথা ঠিক যে, নিরুপায় শিক্ষকরা অনেক কিছুই করেছেন, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কতটুকু হচ্ছে, সে প্রশ্ন থাকছেই।
ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আঘাত হেনেছে দীর্ঘস্থায়ী মহামারি। কিন্তু শিক্ষায় তার আঘাত সর্বাধিক। সেই ক্ষত ও ক্ষতি সামলে শিক্ষার ঘুরে দাঁড়ানোটাও তাই অনেক বেশি সমস্যাসংকুল। মডেল স্কুল, স্মার্ট ক্লাসরুম, সবার জন্য ডিজিটাল শিক্ষা থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ পর্যন্ত শিক্ষার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে হাজারও প্রশ্নের কাঁটা। প্রশ্ন উঠছে, করোনাকালের দাবি মেনে গত কয়েক মাসে সার্বিকভাবে শিক্ষার পরিকাঠামো কোথায় কতটা বেড়েছে? তাতে সামগ্রিক পঠনপাঠনের বিপুল ক্ষতির সুরাহা হবে কি?
মহামারিতে সবচেয়ে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। প্রাইমারি থেকে হাই স্কুলের বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের যে সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্কুলকে, সঙ্গে বন্ধুবান্ধবদের— সে সময়ে প্রায় গৃহবন্দি জীবনযাপন করতে হয়েছে তাদের। এর চেয়ে বড় শাস্তি এই বয়সের ছেলেমেয়েদের কাছে আর কী হতে পারে? স্কুল নেই। পাড়া-প্রতিবেশী ও সেখানকার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশাতেও বিধিনিষেধের বেড়া। সমবয়সি সবাই প্রায় গৃহবন্দি।
খুব ছোটদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রকৃতি এমনভাবে আমাদের সৃষ্টি করেছে, যেখানে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো গড়ে ওঠার জন্য তাদের নিয়মিত সঞ্চালন একান্ত জরুরি। সে জন্য ছোট বয়সে দৌড়তে ভালো লাগে, খেলতে ভালো লাগে, যাতে তার সুষম শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ঘটে। এই নিউরো-মোটর সিস্টেম ঠিকঠাক কাজ না করলে ভাবনাচিন্তা ও তার প্রয়োগের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
এই দুইয়ের সমন্বয় ব্যবস্থাটাই ঠিকমতো গড়ে ওঠে না। একটি জীবনে তার পরিণতি কী ভয়ংকর, সেটা সহজেই অনুমেয়। সরকারের উচিত ছিল, করোনাকালে স্বাস্থ্যের মতো শিক্ষাকেও অত্যাবশ্যক পরিষেবা হিসেবে গণ্য করা। বিভিন্ন সংগঠন, অভিভাবক, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন, শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ স্কুলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় ও সহযোগিতার ভিত্তিতে একটা প্রচেষ্টা অন্তত শুরু করা যেত। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ বা ভাবনা কোনো মহল থেকেই আসেনি। শিক্ষা চালু রাখার কোনো আকুতি বা তাগিদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যেও দেখা যায়নি।
শিশুদের জীবনের কথা ভাবা অবশ্যই জরুরি। সেই চিন্তা থেকেই স্কুল খোলার দাবি ওঠে। শিশুদের জীবন মানে শুধু রোগের হাত থেকে বেঁচে থাকা নয়, নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার হাত থেকেও বাঁচা। এই দুটো দিককেই এক সঙ্গে গুরুত্ব দিতে বলে সুস্থ সমাজচিন্তা। দৈহিক সুস্থতা জরুরি, কিন্তু বুদ্ধির সুস্থতাও সমান জরুরি।
গত দুই বছরে অবহেলা উপেক্ষা আর সৃজনশীল উদ্যোগের অভাবে শিক্ষার খোলস ছাড়া আর কিছুই কি অবশিষ্ট আছে? এই অবস্থার পরে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী রূপ নিয়ে সমাজে আত্মপ্রকাশ করবে, সেই চিন্তাও করতে হবে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধকার ও রম্য লেখক