বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফলে ইসি পুনর্গঠন নিয়ে তোড়জোড় চলছে। নতুন আইনের আলোকে সার্চ কমিটির মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নজর রাখলে বোঝা যাবে, এই সার্চ কমিটি নিয়ে মানুষের অনেক আগ্রহ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সার্চ কমিটিতে যারাই আসুন না কেন, সেটি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং কারা সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হবেন— সেটিই মূল বিবেচ্য।
ধরা যাক, সিইসি ও কমিশনার হিসেবে দেশের সবচেয়ে মেধাবী, যোগ্য, সৎ ও সাহসী মানুষেরাই নিয়োগ পেলেন। কিন্তু একটি নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের উপরে নির্ভর করে না। পুরো সিস্টেম যদি ভালো নির্বাচনের সহায়ক না হয়, তাহলে একজন সিইসি এবং চারজন কমিশনারের পক্ষে কিছুই করার নেই।
একটি ভালো নির্বাচন নির্ভর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো, প্রধানত ক্ষমতাসীন এবং তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের আচরণের উপরে। মাঠ প্রশাসন যদি ইসিকে সহায়তা না করে; তারা যদি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর মতো আচরণ করে; মাঠ প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না থাকে বা থাকতে না পারে— তাহলে খুব ভালো নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। তার চেয়ে বড় কথা, আমরা যে মানসিকতার, যে চরিত্রের, যে স্ট্যান্ডার্ডের—আমাদের সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা তার চেয়ে উন্নত মানসিকতা, উন্নত চরিত্রের এবং বেটার মানুষ হবেন—এটা ভাবার কি কোনো কারণ আছে?
তারপরও প্রশ্ন হলো, কারা হবেন পরবর্তী সিইসি ও কমিশনার—যাদের ওপরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হবে— যে নির্বাচনি ব্যবস্থাটি গত কয়েক বছরে বিতর্কিত হয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রধান অর্থাৎ সিইসি কে এম নুরুল হুদা এবং তার দুই সহকর্মী মাহবুব তালুকদার ও রফিকুল ইসলাম সাবেক আমলা। একজন (কবিতা খানম) সাবেক বিচারক এবং অন্যজন (শাহাদাত হোসেন চৌধুরী) অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। এবারও যে নতুন কমিশন গঠিত হবে, সেটিও যে মোটামুটি এই কাঠামোতেই হবে— সেটা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। কারণ সদ্য পাস হওয়া আইনেও সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে ওই ব্যক্তিদের কমপক্ষে ২০ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তার মানে পাঁচজনের মধ্যে হয়তো তিনজন সাবেক আমলা, একজন সাবেক বিচারপতি এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা থাকবেন।
প্রশ্ন হলো, এর বাইরে সমাজের আর কোনো অংশের কেউ কি সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না? এই আইনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হচ্ছে সিইসি ও কমিশনারদের বয়স। আইনে বলা হয়েছে, তাদের বয়স কমপক্ষে ৫০ বছর হতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতে গেলে যেখানে ন্যূনতম ৩৫ এবং প্রধানমন্ত্রী হতে গেলে ন্যূনতম ২৫ বছর হলেই হয়, সেখানে নির্বাচন কমিশনার হতে গেলে তার বয়স কেন ৫০ হতে হবে— এ প্রশ্ন জনমনে রয়েছে। মূলত এই বিধানটি যুক্ত করে অবসরপ্রাপ্ত আমলা, বিচারক এবং সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের পদগুলো নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বা অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে কারো বয়স যদি ৫০-এর কম হয় এবং তিনি যদি নির্বাচনের আইন-কানুন জানেন-বোঝেন এবং তার যদি প্রশাসনিক দক্ষতা থাকে, তাহলে তিনি কেন সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন না?
মূলত আমাদের পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই যে আমলানির্ভর, সদ্য পাস হওয়া ইসি আইনে সেটিরই প্রতিফলন স্পষ্ট। যারা সারা জীবন সরকারের নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন; অবসরে গিয়ে মোটা অংকের পেনশন পেয়েছেন আবার সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে আদর্শের রং ও ভোল পাল্টেছেন, তারাই ঘুরেফিরে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদগুলোর দায়িত্ব পান। বছরের পর বছর ধরে এই যে দুষ্টুচক্র গড়ে উঠেছে, এটি ভাঙার সাহস কেউ করেন না।
এবার আসা যাক ভালো নির্বাচন বলতে কী বোঝায়?
ভালো নির্বাচন মানে ১. তফসিল ঘোষণার পর আগ্রহী সব প্রার্থী নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন; ২. তার মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা রাজনৈতিক কারণ বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবিত হবেন না; ৩. প্রতীক বরাদ্দের পরে প্রার্থীরা আচরণবিধি মেনে প্রচার-প্রচারণা চালাবেন এবং সেখানে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে যা নিশ্চিত করবে নির্বাচন কমিশন; ৪. কোনো প্রার্থীকে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার বা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে সরকার, সরকারি দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কোনো এজেন্সির তরফে চাপ প্রয়োগ করা হবে না; ৫. নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ভোটের একটি সুন্দর ও উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় থাকবে; ৬. ভোটের দিন ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন এবং পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্ভয়ে ফিরবেন; ৭. জাল ভোট, কেন্দ্রদখল বা সহিংসতা হবে না; ৮. ভোট গণনায় কোনো ধরনের কারচুপি করা হবে না; ৯. কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে জয়ী করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা উৎসাহ দেখাবেন না বা তাদের ওপর কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় চাপ থাকবে না; ১০. ভোটের ফল ঘোষণার পরে প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী সেটি মেনে নেবেন। মোটা দাগে এই শর্তগুলো পূরণ হলে সেটিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বলা যেতে পারে।
অনেক সময় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোটকে গুলিয়ে ফেলা হয়। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াটি শান্তিপূর্ণ হওয়ার পরও সেই ভোট গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। যেমন, একটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের ফল ঘোষণা পর্যন্ত হানাহানি হলো না; কোনো প্রার্থীর প্রচারে বাধা দেয়া হলো না, কাউকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাপ দেয়া হলো না, কিন্তু দেখা গেল মানুষ ভোটকেন্দ্রে যায়নি বা ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। যেহেতু আমাদের সংবিধানে এটি বলা নেই যে, ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পেতে হবে, বরং ২০ শতাংশ ভোট পেয়েও যেহেতু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া যায়, সুতরাং কোনো একটি ভোটে যদি ২০ শতাংশ মানুষও ভোট দেয়, তারপরও ওই ভোটকে অবৈধ বলার সুযোগ নেই। ওই সামান্য সংখ্যক ভোট পেয়ে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন, তাকেও অবৈধ বলা যাবে না। কিন্তু এই নির্বাচনটি কি গ্রহণযোগ্য হলো?
আবার পুরো নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ হলো, প্রচুর মানুষ ভোট দিল, কিন্তু ফল পাল্টে দেয়া হলো, সেটিকে সুষ্ঠু নির্বাচন বলা গেলেও গ্রহণযোগ্য বলার সুযোগ নেই। অর্থাৎ সহিংসতামুক্ত নির্বাচন মানেই সেটি গ্রহণযোগ্য ভোট নয়। বরং একটি ভোটকে গ্রহণযোগ্য হতে গেলে তার কিছু মানদণ্ড রয়েছে এবং সেগুলো নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। সতুরাং নতুন আইনের আলোকে গঠিত সার্চ কমিটি সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে কাদেরকে সার্চ করে নিয়ে আসবে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং কেবল সংবিধান ও আইনের অধীন। কিন্তু তাদের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত হলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা এরকম যে, নির্বাচন কমিশন সরকারের অধীন এবং সরকার ও সরকারি দল যা চায় তার বাইরে গিয়ে কিছু করা কমিশনের পক্ষে অসম্ভব।
এর একটি বড় কারণ নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক পদে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়, অনেক সময়ই সেখানে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে, সব প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সমান সুযোগ নিশ্চিত করবে, সরকারি দলের প্রভাবশালী প্রার্থী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও তাকে শাস্তির আওতায় আনবে বা নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়ায় তারা নিরপেক্ষ থাকবে বা থাকতে পারবে— সাধারণ মানুষ এটি এখনও বিশ্বাস করে না। এই যে জন-আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট, এটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে একটি বড় অন্তরায়।
এটিও ঠিক যে, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেই। ভোট পরিচালনায় যে বিপুলসংখ্যক জনবল দরকার, সে পরিমাণ লোক তার নেই। ফলে তাকে পুরো নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্ভর করতে হয় নির্বাহী বিভাগ তথা সরকারের ওপর। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন ভোট পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে যে সহায়তা চাইবে, সরকার সেটি দিতে বাধ্য। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন তারা সরাসরি নির্বাচন কমিশনের কর্মী নন। বরং তারা সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োজিত এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তিরা যা বলবেন, যে নির্দেশনা দেবেন, তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
স্মরণ করা যেতে পারে, সম্প্রতি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথদিঘি ইউনিয়নের একটি ভোটকেন্দ্র থেকে সাংবাদিকদের বের হয়ে যেতে নির্দেশ দিলে এ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের এসআই চিরঞ্জীবের কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় তিনি বলেন, ‘আমি এসপি সাহেবের ডিউটি করছি, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মানার সময় নেই (প্রথম আলো ২৬ ডিসেম্বর ২০২১)।’ একজন পুলিশ অফিসারও যদি মনে করেন বা বিশ্বাস করেন যে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মানার সময় নেই তাহলে সেই নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কী ধারণা হবে এবং তাদের অধীনে কেমন নির্বাচন হবে?
নির্বাচনে হারতে ভয় পাওয়া বা হারতে না চাওয়াও গ্রহণযোগ্য বা ভালো ভোটের অন্তরায়। দেখা যায়, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো দল সরকার গঠন করলেও তারা ছোটখাটো উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে ভয় পায়। যদিও দুয়েকটি উপনির্বাচন অথবা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের সঙ্গে সরকার বদলের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারপরও সরকার বা সরকারি দল এসব নির্বাচনে হারতে চায় না। কারণ তাদের মধ্যে এরকম একটি ভয় থাকে যে, ছোটখাট নির্বাচনে হেরে গেলে মানুষ মনে করবে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে গেছে। ফলে তারা ঝুঁকি নিতে চায় না। যে কারণে নির্বাচনগুলো অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয় না।
এরকম বাস্তবতায় পরবর্তী সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যারাই নিয়োগ পাবেন, তাদের সামনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটিকে গ্রহণযোগ্য করা। বিশেষ করে গত কয়েকটি জাতীয় এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাটি যেরকম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং যেসব কারণে নির্বাচন কমিশনও বিতর্কিত হয়েছে, সেই জায়গা থেকে নির্বাচনি ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনকে সরিয়ে আনা। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবেন, এমন ব্যক্তিরা যদি ইসিতে নিয়োগ না পান, তাহলে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগে আইন করা হলেও তার ফলাফল হবে শূন্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।