বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ছাত্রলীগ ঐতিহ্যের ধারায় আছে তো? 

  •    
  • ৫ জানুয়ারি, ২০২২ ১৩:৩৯

মানুষ যেহেতু আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে তাই ভোটের পর মানুষের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বিএনপির বিজয় আওয়ামী লীগ ছিনিয়ে নিয়েছে এমনটা মানুষের কাছে মনে হয়নি। তবে সব মিলিয়ে নির্বাচনকে ঘিরে যা হয়েছে তা মানুষকে হতাশ করেছে। আওয়ামী লীগের হয়তো একটি পরিকল্পনা ছিল যে নির্বিঘ্নে সরকার চালাতে গেলে বিরোধী দলকে দুর্বল করতে হবে। তারা সেটা করেছে। ভোটের পর ঠিকই বিরোধী দলের দিক থেকে কোনো বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়নি।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি নাঈমুদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের যে সংগঠনটির যাত্রা শুরু, তারই নাম এখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পাকিস্তান নামক একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস পরই একটি নতুন ছাত্র সংগঠন কেন তৈরি করা হয়েছিল, তার নিশ্চয়ই কারণ আছে। সে কারণ জানা আছে প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তাদের। ভাষা, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার যে ধারাবাহিক সংগ্রাম তার সঙ্গে ছাত্রলীগের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ছাত্রলীগের ইতিহাস– বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাস।

মোটেও বাড়িয়ে বলা কথা নয়। বাংলাদেশ তো প্রতিষ্ঠিতই হয়েছে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবের সোপান ধরে। বঙ্গবন্ধুর একক অবদান যেমন এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অসামান্য, তেমনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছাত্র লীগের অবস্থানও অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তনকারী সব ঘটনার স্রষ্টাই ছাত্রসমাজ। আর ছাত্রদের মধ্যে ছাত্রলীগ প্রায় পুরো সময়ই ছিল সামনের কাতারে। ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকাও অসামান্য, তবে আজ যেহেতু ছাত্রলীগের জন্মদিন তাই আলোচনা ছাত্রলীগকে নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে।

ছাত্রলীগ অবশ্যই একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। কিন্তু ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিতে আমরা একটু পোস্টমর্টেম করতে পারি, দেখতে পারি ছাত্রলীগ ঐতিহ্যের ধারায় আছে কি না।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাণী উদ্ধৃত করা আছে। শেখ হাসিনা বলছেন: ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবন- এই হোক তোমাদের জীবনাদর্শ’।

খুব ভালো পরামর্শ। শেখ হাসিনা যেহেতু ছাত্রলীগের ‘আদর্শিক নেত্রী’ সেহেতু তার আদেশ-নির্দেশ, পরামর্শ অবশ্য অবশ্যই ছাত্রলীগের মেনে চলা উচিত। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যে ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবনযাপন’ করছেন না সেটা অনেকেই লক্ষ করছেন। ছাত্রলীগের অনেক নেতাই বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কেউ কেউ নাকি গাড়ি-বাড়িরও মালিক। ছাত্রলীগের কমিটিতে ঢোকার জন্যও নাকি মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়।

ছাত্রলীগের অভিভাবক দল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতু ও সড়ক যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বছর কয়েক আগে বলেছিলেন, ছাত্রলীগকে নাকি নতুন মডেলে সাজানো হবে। নতুন মডেলটা কেমন তার কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি। আমরা ধরে নিতে পারি ছাত্রলীগ সাম্প্রতিক সময়ে যে বদনামের মডেল বহন করছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসাই নতুন মডেল। কিন্তু সেই নতুন মডেল কি দেখা গেছে?

ওবায়দুল কাদের নিজে দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। সভাপতিও ছিলেন। তারপর আওয়ামী লীগে থেকেও তিনি ছাত্রলীগ দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তাই ছাত্রলীগ সম্পর্কে তার জানাবোঝা অন্যদের থেকে বেশি। তিনি ছাত্রলীগকে দেখেন ভেতর থেকে। যারা সমালোচনা করেন তারা করেন বাইরে থেকে এবং বাইরেরটা দেখে। তাতে ন্যায্যতা এবং অন্যায্যতা দুটোই থাকে।

একবার ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোনো সিন্ডিকেট দ্বারা ছাত্রলীগ চলবে না। কারো পকেট কমিটি দিয়ে ছাত্রলীগ হবে না। ছাত্রলীগ চলবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, শেখ হাসিনার নির্দেশনায়। এর বাইরে কোনো চিন্তা-ভাবনার অবকাশ নেই’।

ওবায়দুল কাদেরের এসব বক্তব্য শুনতে ভালো লাগলেও তিনি কাদের উদ্দেশে এসব বলেন সে প্রশ্ন সামনে আসে। ছাত্রলীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শে এবং শেখ হাসিনার নির্দেশনায় চলবে- এ কথা বলার মানে কী? ছাত্রলীগ কি অন্য কারো আদর্শ বা নির্দেশনায় চলেছে? সিন্ডিকেট ও পকেট কমিটির কথাও ওবায়দুল কাদের বলেছেন। তিনি হয়তো অসত্য বলেননি। সম্মেলন এলেই নাকি ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের পছন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে ওই সিন্ডিকেট ও পকেটরাই সব কিছু ঠিক করে থাকে।

ওবায়দুল কাদের আরও বলেছিলেন, ‘অনুপ্রবেশকারী পরগাছারা যেন সংগঠনের নেতৃত্বে আর না আসতে পারে’। ছাত্রলীগের এই সাবেক নেতার কথা থেকে এটাও পরিষ্কার যে, ছাত্রলীগে ‘অনুপ্রবেশকারী পরগাছা’ আছে এবং তারা সংগঠনের নেতৃত্বেও চলে আসে।

এটাও অবশ্য নতুন নয়। স্বাধীনতার পর পর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন শফিউল আলম প্রধান। তিনি ছিলেন আইয়ুব-মোনায়েম খানের শিষ্য গমিরউদ্দিন প্রধানের ছেলে। শফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগ এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারকে এক চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছিলেন মহসিন হলে সাত খুনের ঘটনা ঘটিয়ে। কেউ কেউ বলে থাকেন, পিতার দোষের জন্য ছেলে কেন অভিযুক্ত হবেন? ছেলে যদি পিতার রাজনৈতিক ধারারই অনুসারী হন তাহলে তো তাকে আলাদা করা যাবে না। তাই ছাত্রলীগে ‘অনুপ্রবেশকারী’দের সম্পর্কে সতর্ক হতেই হবে।

ছাত্রলীগে গত কয়েক বছরে ছাত্র শিবির-ছাত্রদল থেকে ব্যাপক ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটেছে বলে শোনা যায়। কোটাবিরোধী আন্দোলনে সেটার প্রমাণও পাওয়া গেছে। শিবির-ছাত্রদল ছাত্রলীগে ঢুকেছে ছাত্রলীগের শক্তি বাড়ানোর জন্য নয়, ছাত্রলীগকে ভেতর থেকে ধ্বংস করার জন্য। ইতোমধ্যে তারা তাদের উদ্দেশ্য কিছুটা পূর্ণ করতে পেরেছে বলেও মনে হয়।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ছাত্রলীগকে আদর্শের মহাসড়কে আসতে হবে। সুনামের ধারায় ফিরে আসতে হবে। ছাত্রলীগকে অতীতের ধারায় ফিরে আসতে হবে। ছাত্রলীগে যেন আর কোনো অনুপ্রবেশকারী ঢুকতে না পারে, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। টাকা-পয়সার কর্মীরা থাকবে না। জবরদস্তি করে অযোগ্যদের নেতা বানাবেন না। সাহসী, মেধাবী ও চরিত্রবান নেতা তৈরি করুন সর্বত্র। এসব কথার সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই।

শেখ হাসিনার রাজনীতি করার কথা ছিল না। তার জনক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনটা চাননি বলেই তার বিয়ে দিয়েছিলেন একজন রাজনীতির বাইরের মানুষ, পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, শেখ হাসিনাকেই দায়িত্ব নিতে হয়েছে পিতার স্বপ্ন পূরণের। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন, তা বাস্তবায়নের কঠিন সাধনায় নিজেকে ব্রতী করেছেন শেখ হাসিনা। প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে শেখ হাসিনা অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন।

চিরবৈরী বিএনপিকে তিনি ‘বাধ্য’ করতে পেরেছেন। অন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও তিনি নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা চলছিল তার অনেকটাই দূর করেছেন। তিনি শত্রুকে মিত্র করার রাজনৈতিক কৌশলে সিদ্ধহস্ত। তবে এতে মিত্ররা বিশ্বাস হারাচ্ছে কি না তা নিয়ে তাকে খুব চিন্তিত বলে মনে হয় না। সমালোচকদের কেউ কেউ বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য নীতি-আদর্শের সঙ্গে আপস করতে পিছপা হন না। ক্ষমতায় না থাকলে নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন করা হবে কীভাবে, সেটা অবশ্য তারা বলেন না। ক্ষমতায় থাকতে হবে আবার নীতি-আদর্শও বাস্তবায়ন করতে হবে। কাজটি কঠিন। কঠিন পথেই হাঁটছেন শেখ হাসিনা।

রাজনীতিতে বিশ্বব্যাপী একটি নতুন প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আদর্শবাদী অবস্থান দুর্বল হয়ে ক্ষমতায় থাকার কৌশল বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। রাজনীতিতে ‘ক্ষমতা’ যেহেতু শেষ কথা, সেহেতু ক্ষমতায় থাকার জন্য যা যা করা দরকার তাই সফলভাবে করতে পারাটাই হালের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। এটা যে কেবল বাংলাদেশে শেখ হাসিনা অনুসরণ করে সুফল পেয়েছেন তা নয়, বাংলাদেশের মতো আরও কিছু দেশেও এই রীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।

ক্ষমতার গর্ভে জন্ম নেয়া বিএনপি নামক দলটি ক্ষমতার মোহে অন্ধ, তাই সব সময় নিজেদের ক্ষমতার আসনে ভাবতে পছন্দ করে। কিন্তু ক্ষমতায় যেতে হলে ক্ষমতার যেসব কেন্দ্রের ছাড়পত্র লাগে বিএনপি তা জোগাড়ের চেষ্টা করেও সফল হয়নি বলেই নির্বাচনে ভালো করতে পারছে না। অন্যদিকে কিছু বিরূপতা থাকলেও মানুষ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে। বিএনপি নানা কারণেই ব্যাপক মানুষের পছন্দের তালিকায় ছিল না।

গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোটের আগে থেকেই জেতার ব্যাপারে ছিল আত্মবিশ্বাসী। তারা যদি অনিয়ম-কারচুপির আশ্রয় না নিত তাহলে হয়তো তাদের আসনসংখ্যা হয়তো কমতো। বিএনপি হয়তো ঠিকই ৬০/৭০ আসনে জিতত। কিন্তু তারা সঠিক পথে না হেঁটে ভুল পথে হেঁটেছে। মানুষ যেহেতু আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছে তাই ভোটের পর মানুষের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বিএনপির বিজয় আওয়ামী লীগ ছিনিয়ে নিয়েছে এমনটা মানুষের কাছে মনে হয়নি। তবে সব মিলিয়ে নির্বাচনকে ঘিরে যা হয়েছে তা মানুষকে হতাশ করেছে।

আওয়ামী লীগের হয়তো একটি পরিকল্পনা ছিল যে নির্বিঘ্নে সরকার চালাতে গেলে বিরোধী দলকে দুর্বল করতে হবে। তারা সেটা করেছে। ভোটের পর ঠিকই বিরোধী দলের দিক থেকে কোনো বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের সামনে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের দল এবং সহযোগী সংগঠনগুলো। আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত মোহাম্মাদ নাসিম একদিন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগে ভেজাল ঢুকে পড়েছে। খাদ্যে ভেজাল যেমন মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি দলের ভেজাল একই সঙ্গে দল ও সরকারের জন্যও বিপজ্জনক। দেশে ভেজালবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে দলের ভেতরও ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন আওয়ামী লীগের এই অভিজ্ঞ নেতা।

এই ভেজালের দৌরাত্ম্যে আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি যেন পণ করেছে যে তারা শেখ হাসিনার সব সাফল্য ম্লান না করে ছাড়বে না। তারা নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়াবেই। অপরাধ এবং ছাত্রলীগ একসঙ্গে চলার প্রতিজ্ঞা করে কার্যত সরকারকে এক বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। ছাত্রলীগকে ব্যধিমুক্ত করার অঙ্গীকার হোক সংশ্লিষ্ট সবার।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এ বিভাগের আরো খবর