বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নতুন বছরের প্রত্যাশা

  • নাসির আহমেদ   
  • ২ জানুয়ারি, ২০২২ ১৯:০৫

রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা স্থিতিশীল অবস্থা দীর্ঘদিন ব্যবসা-বাণিজ্য কলকারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রেখেছিল। করোনার থাবা না থাকলে দেশের অগ্রগতি আরও দ্রুত হতে পারত। কিন্তু বিগত বছরের মাঝামাঝি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে রাজনৈতিক অঙ্গন যেভাবে সরগরম হয়ে উঠছে তাতে নতুন বছরে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটুক এটা অন্তত শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে আমরা কেউই চাই না। বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়টি একদিকে যেমন আদালত ও বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে মানবিকতার প্রশ্ন তুললে সেটি পাল্টা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করে।

শীতের পাতা ঝরার সঙ্গে সঙ্গে এই পৌষের হিমেল পরশে অতিক্রান্ত হয়ে গেল খ্রিস্টীয় বছর ২০২১। অতিক্রান্ত হয়ে গেল বাংলাদেশের ইতিহাসেরও এক অবিস্মরণীয় বছর। একইসঙ্গে অতিক্রান্ত হলো স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং সেই স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষের আয়োজনে বর্ণিল মুজিব বর্ষও! কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে খ্রিস্টীয় বছর ২০২১, কিন্তু তারপরও সবটুকু হারিয়ে যাবে না এই বছরটির!

অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে, ইতিহাসের উপাদান হয়েই বেঁচে থাকবে আমাদের জাতীয় জীবনে বিদায়ী বছর, ২০২১। অন্যান্য বছরের সঙ্গে এই বছরটির বিদায় এ কারণেই ব্যতিক্রমী। গিয়েও যেন গেল না সে, রয়ে গেল ইতিহাসের উপাদান হয়ে।

নতুন বছরকে আমরা বরণ করে নিয়েছি, বরণ করে নিয়েছে সারা পৃথিবী। কিন্তু নতুনের কাছে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যখন সামনের দিকে তাকাই তখন সংগত কারণেই মনে পড়বে পেছনের কথাও। কী পেয়েছি, কী পাইনি, সে হিসাব মেলাতে গেলে প্রাপ্তির পাল্লাটাই যে ভারী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ তার ইতিহাসের ৫০টি বছর অতিক্রম করেছে। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসতে হয়েছে এই দীর্ঘ পথ।

আজ ২০২২-এর এই আলোকোজ্জ্বল বাংলাদেশ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ যেখানে এসে পৌঁছেছে তা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয়। শিক্ষার হার, মাথাপিছু গড় আয়, জাতীয় প্রবৃদ্ধি, মানুষের গড় আয়ু, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান, সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানা দিকে দৃষ্টিপাত করলে মনে হয় না অতৃপ্তির হাহাকারে দগ্ধ হওয়ার মতো কিছু আছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, এই পঞ্চাশটি বছরের দীর্ঘ পথ, মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছে বাংলাদেশ, সেখানে অনেক অশ্রু, অনেক রক্ত আর অনেক গ্লানির কালিমাও আমাদের ইতিহাসকে কম কলঙ্কিত করেনি। ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি যখন বিভক্ত হয়ে সংঘাতের মধ্য দিয়ে যায় তখন সে দেশ এতখানি অগ্রসর হবার কথা নয়, যতখানি এগিয়েছে বাংলাদেশ।

অনৈক্যের সেই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পঁচাত্তরের কলঙ্কের কালিও কালক্রমে মোচন করেছেন বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা এবং তার সরকার। একদিন যে বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে বিরূপ সমালোচনা করেছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, আজ তারাই সমৃদ্ধির আলোয় উদ্ভাসিত বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এরই নাম ইতিহাসের শিক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে মানুষ ইতিহাস রচনা করে বটে, কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা খুব কমই গ্রহণ করে। সেজন্যই সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে ইতিহাসের সত্যকে মেনে নিয়ে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যাওয়া।

সেই এগিয়ে যাওয়ার পথেই আজ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে খ্রিস্টীয় নতুন বছর ২০২২-এ। কিন্তু নতুন বছরেও বিগত বছরের রেশই থেকেই যাবে। সব কিছু ফেলে যেতে পারব না। হিসেবের খাতায় যেমন বিগত বছরের দেনা-পাওনা লিপিবদ্ধ থাকে, সময়ের খাতায়ও থেকে যায় বিগত বছরের আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি, অর্জন আর হারানোরও অনেক স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতা যা পথ দেখাবে আগামী দিনগুলোতে।

করোনার ছোবলে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের যাপিত জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে কর্মহীন হয়েছেন। আবার উঠে দাঁড়াবার জন্য লড়াই শুরু হয়েছে। আবার আমাদের সমাজজীবন থেকেও হারিয়ে গেছেন অনেক প্রিয়জন। যদি গত একটি বছর পিছনে ফিরে তাকাই, দেখব কত প্রিয় মুখই না চলে গেছেন চিরতরে না ফেরার দেশে। সেসব জাতীয় ব্যক্তিত্বের শূন্যতা বয়ে নিয়েই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

যা হারিয়েছি তা আর ফিরে পাব না, একথা সত্য, কিন্তু এসব মহৎ মানুষের জীবনের আদর্শ মনে রাখলেই আমরা অনেক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারি। শুধু মৃত্যুর নয়, বিগত বছরের অনেক কিছুর অভিজ্ঞতা থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমরা পূর্ণতায় ভরিয়ে তুলতে সচেষ্ট হতে পারি আমাদের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা।

শুধরে নিতে পারি বিগত বছরের ভুলভ্রান্তিও। করোনার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হয়তো আমরা মুছে ফেলতে পারব না চাইলেই। এখন মড়ার উপর খাড়ার ঘা ওমিক্রণ ভাইরাস। কিন্তু সতর্ক হলে তা থেকেও প্রাণ রক্ষা করে চলা যায়। মহামারি ভাইরাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগও এড়ানো কঠিন। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার মতো প্রাণঘাতী বিপর্যয় থেকে তো চাইলেই আমরা অনেকখানি পরিত্রাণ পেতে পারি।

গণপরিবহনসহ সড়কে যে অসংখ্য যানবাহন চলছে, সেসব যানবাহনের চালক এবং মালিকরা যদি সতর্ক থাকেন, তাহলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যায়, ঠেকানো যায় অনেক অকাল মৃত্যুর হাহাকার। লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, এসব থেকে আমাদের সড়কগুলোকে নিরাপদ রাখা গেলে, আমরা অনেক বিপর্যয় সহজে এড়াতে পারি।

বছরের শেষপ্রান্তে এসে বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযান চালিয়ে নৈরাজ্য কিছুটা হলেও কমাতে সক্রিয় হয়েছেন। নতুন বছরের প্রত্যাশা থাকবে সড়ক পরিবহনের জন্য একটা শৃঙ্খলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকার আপসহীন অবস্থান গ্রহণ করে।

সড়কে যেভাবে ঝরে যাচ্ছে অগণিত মানুষের প্রাণ তা কোনো সভ্য সমাজে কাম্য হতে পারে না। বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত সড়কে নজরদারি বাড়ানোর পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি আশা করা যাচ্ছে। কথা হচ্ছে আইন দিয়ে সব হয় না। পরিবহন মালিকসহ সংশ্লিষ্টদেরও সদিচ্ছা থাকতে হয়।

বিগত বছরে সড়কের নৈরাজ্য নিয়ে দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সচেতনতা দেখা গিয়েছে তা একদিকে আশার, অন্যদিকে সড়ক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার চরম দৃষ্টান্ত। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে হবে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নগর পরিবহন পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে, আশা করতে চাই সুশৃঙ্খল একটি পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নতুন বছরেই আশাব্যঞ্জক উন্নতি ঘটবে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা স্থিতিশীল অবস্থা দীর্ঘদিন ব্যবসা-বাণিজ্য কলকারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক রেখেছিল। করোনার থাবা না থাকলে দেশের অগ্রগতি আরও দ্রুত হতে পারত। কিন্তু বিগত বছরের মাঝামাঝি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে রাজনৈতিক অঙ্গন যেভাবে সরগরম হয়ে উঠছে তাতে নতুন বছরে কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটুক এটা অন্তত শান্তিপ্রিয় নাগরিক হিসেবে আমরা কেউই চাই না।

বেগম খালেদা জিয়ার বিষয়টি একদিকে যেমন আদালত ও বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, অন্যদিকে মানবিকতার প্রশ্ন তুললে সেটি পাল্টা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করে। একহাতে তালি বাজে না। একটি কবিতা পড়েছিলাম অনেকদিন আগে, সম্ভবত কবি অরুণাভ সরকারের লেখা :‘ভালোবাসা দিলে ভালোবাসা পাবে /ঘৃণা দিলে পাবে ঘৃণা.../তুমি বিস্মরণও নিতে পারো/ শুধু আমি তা পারি না!’

প্রেমের ক্ষেত্রে শেষের চরণটুকু সত্য হলেও রাজনীতিতে তা সত্য নয়। এখানে বিস্মরণের সুযোগ খুব কম। তবু আশা করতে চাই আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বের করে নেবে সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ।

শান্তির পথ ধরে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ নতুন বছরে আমজনতার প্রত্যাশা এটুকুই। কেননা শান্তি বিঘ্নিত হলে রুটিরুজি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তো আমাদের আছে।

লেখক: কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক। সাবেক পরিচালক (বার্তা), বাংলাদেশ টেলিভিশন।

এ বিভাগের আরো খবর