বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সরকারি মাল মড়া নদীতে ঢাল…

  •    
  • ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৭:০৯

যদি আখেরে কাজেই না আসে, তাহলে সেই প্রকল্প কেন গ্রহণ করা হয়? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রকল্প মানেই সেখানে টাকার শ্রাদ্ধ। প্রকল্প মানেই মোটা মাইনের কনসালট্যান্ট। প্রকল্প মানেই ভাগ-বাটোয়ারা। কিন্তু টাকাটা তো জনগণের। সরকারি প্রকল্পগুলোর অবস্থা হলো, কোনো একটি প্রকল্পে সাফল্য খতিয়ে দেখতেও আরেকটি প্রকল্প নেয়া হয়।

জাতীয় সংসদের পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সম্প্রতি ঢাকার অদূরে সাভারের হেমায়েতপুরে গড়ে তোলা ট্যানারি-পল্লি বন্ধের সুপারিশ করেছে। অভিযোগ, এই ট্যানারি-পল্লি থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই ফেলা হয় ধলেশ্বরী নদীতে। যে কারণে এই নদীটির পরিণতিও বুড়িগঙ্গার মতো হতে পারে বলে শঙ্কা। যে বুড়িগঙ্গার দূষণের নেপথ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই ট্যানারির বর্জ্য।

সংসদীয় কমিটির তরফে বলা হচ্ছে, ট্যানারি-পল্লিতে প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য সৃষ্টি হয়। কিন্তু এখানে বর্জ্য শোধন ক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার ঘনমিটার। ফলে বাকি ১৫ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোনো ধরনের শোধন ছাড়াই ফেলা হচ্ছে নদীতে।

স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগেও কয়েকবার পরিবেশদূষণের কারণে ট্যানারি-পল্লিতে অবস্থিত অনেক কারখানাকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু যতবারই জরিমানা করা হয়েছে, ততবারই তারা এর বিরুদ্ধে আপিল করেছে। ফলে বিষয়টি দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়ে যায়। এরকম বাস্তবতায় জরিমানা নয়, বরং পরিবেশদূষণকারী এই ট্যানারি শিল্পের পল্লিটি বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীর পাশের এলাকা সাভারের ফুলবাড়িয়া গ্রামের মানুষদের বরাতে গণমাধ্যমের খবর বলছে, ধলেশ্বরী নদীতীরের অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষের সুখ কেড়ে নিয়েছে ট্যানারি। একসময় যার দুই বিঘা জমি ছিল, তার ঘরে কোনো অভাব থাকত না। এখন পাঁচ বিঘা জমির মালিকও ভাত পায় না।

বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রায় সব জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। ট্যানারি বর্জ্যের প্রভাবে চালের টিন ফুটো হয়ে যাচ্ছে। মরে ভেসে উঠছে নদীর মাছ। বেকার হয়ে পড়ছেন এলাকার কৃষক ও জেলেরা। এলাকায় মশা-মাছির উপদ্রব বেড়ে গেছে। তবে শুধু ধলেশ্বরী নয়। ট্যানারির অপরিশোধিত তরল বর্জ্যে ধলাই বিল এবং বংশী নদীর পানিও দূষিত হচ্ছে।

এই ইস্যুতে দুটি প্রশ্ন সামনে আসছে-

১. যে বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণে ট্যানারি-পল্লি রাজধানীর হাজারিবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তর করা হলো, সেই পল্লি যদি বুড়িগঙ্গার পরে ধলেশ্বরীকেও দূষিত করে, তাহলে এই স্থানান্তরে কী লাভ হলো?

২. সংসদীয় কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী যদি ট্যানারি-পল্লি বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষদের জীবিকার কী হবে? এই খাতে যে বিপুল পরিমাণ আয় হয়, তার কী হবে? নদীদূষণ করছে বলে একটি শিল্প বন্ধ করে দিতে হবে?

দুই.

দূষণ ও দখলের কারণে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর বেহালের কারণে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীকে ঘিরে যে ওয়াটার বাস চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেটি ব্যর্থ হয়েছে। বছরের পর বছর এ নিয়ে আলোচনা আর নানারকম কর্মকাণ্ডের পরেও এই প্রকল্প আলোর ‍মুখ দেখার আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে।

একাধিকবার চেষ্টার পরেও ঢাকার সদরঘাট–গাবতলী, টঙ্গী–নারায়ণগঞ্জ এবং বুড়িগঙ্গায় ওয়াটার বাস দিয়ে পারাপারের প্রকল্প ব্যর্থ হয়। যে ১২টি ওয়াটার বাস নামানো হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছাড়া বাকিগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ওই একটি ওয়াটারবাস সদরঘাট এলাকায় যাত্রী পারাপার করে। দূরে কোথাও যায় না।

স্মরণ করা যেতে পারে, সদরঘাট-গাবতলী নৌপথে তিনবার ওয়াটার বাস চালু হয়। প্রথম দুবার বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) তত্ত্বাবধানে চলে। কিন্তু তারা লোকসানে পড়লে তৃতীয়বার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি)।

প্রথমবারের মতো ‘ওয়াটার ট্যাক্সি’ যাত্রা শুরু ২০০৪ সালে। কিন্তু মাসখানেক চলে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১০-এর আগস্টে। এ যাত্রায় টেকে মোটে ১১ মাস। ওই বছর এই সেবা চালু রাখতে ভারত থেকে ১০টি ওয়াটার বাস আনার বন্দবস্ত চূড়ান্ত হলেও তা বন্ধ হয়ে যায়।

আর তৃতীয়বার শুরু হয় ২০১৩ সালের ৪ জুলাই। এগুলো চালাতে বিভিন্ন রুটে স্থাপন করা হয় মোট ১২টি ল্যান্ডিং স্টেশন বা ঘাট। বৃত্তাকার নৌপথের সদরঘাট-গাবতলী প্রথম পর্বের দূরত্ব ছিল ২৯ কিলোমিটার। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রম আশুলিয়া ও শ্যামপুর পর্যন্ত বিস্তৃত করার কথা বলা হয়। কিন্তু চালু করা যায়নি সেখানকার ব্রিজগুলো নিচু বলে। তখন রাজধানীর ১৩টি সেতু প্রতিস্থাপন করার কথা বলা হয়। কিন্তু আদতে কিছুই হয়নি।

সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সদরঘাটে পারাপারে দুর্ঘটনা রোধে বন্ধ থাকবে ডিঙ্গি, চলবে ওয়াটার বাস। এ জন্য কেরানীগঞ্জ বুড়িগঙ্গা নৌকা মাঝি-শ্রমিক শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডকে গত বছরের ২২ আগস্ট থেকে ছয় মাসের জন্য আটটি ওয়াটার বাস দেয়া হয়। তবে লোকসানের পর তারাও চারটি বুঝিয়ে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিসিকে। বাকি চারটি ওয়াটার বাস আরও এক বছরের জন্য চালানোর অনুমতি পেলেও চলছে না এখনও।

প্রশ্ন হলো, বার বার উদ্যোগ নেয়ার পরেও কেন রাজধানীর চারপাশের পাঁচটি নদীকে ঘিরে এই ওয়াটার বাস চালু করা গেল না? এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় নদীদূষণকে। সেইসাথে ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে সদরঘাটে যেতে ভয়াবহ যানজটে পড়তে হয়— সেটিও এই প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।দিনের যেকোনো সময়ে সদরঘাটে যেতে নাগরিকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এমনকি খুব ভোরেও পুরো ঢাকা শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে একটানে ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত পৌঁছানো গেলেও বিপত্তি বাধে এর পরেই। বিশেষ করে লালকুঠি ঘাটে পৌঁছাতে সরু গলির দুধারে পেঁয়াজ আলুসহ নানা পণ্যের পাইকারি বাজারে ট্রাক ও ভ্যানের যে চাপ, সেটি ঠেলে ঘাটে পৌঁছানো এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা।

ঢাকার এই পুরোনো অংশের চরিত্রই এমন যে, চাইলেই এখানের রাস্তাঘাট প্রশস্ত করা যাবে না। কিন্তু এখান থেকে এই পেঁয়াজ ও আলুর আড়ৎগুলো ঘাট থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া গেলে নাগরিক দুর্ভোগ কিছুটা কমবে। কিন্তু সেটি আদৌ সম্ভব কি না—তা বড় প্রশ্ন।

যাত্রীর অভাবে ওয়াটার বাসগুলো সময়মতো ছাড়তে না পারাও এই প্রকল্প ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি কারণ। সেইসঙ্গে নাব্যতা সংকটে কম উচ্চতার সেতুগুলো বর্ষায় ওয়াটার বাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে যে ওয়াটার বাস দিয়ে যানজটে নাকাল রাজধানীবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেটি স্বপ্নই থেকে গেছে। এখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং বাস্তবায়নকারীদের অদক্ষতার প্রশ্নগুলোও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

মূল প্রশ্ন হলো, যদি আখেরে কাজেই না আসে, তাহলে সেই প্রকল্প কেন গ্রহণ করা হয়? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রকল্প মানেই সেখানে টাকার শ্রাদ্ধ। প্রকল্প মানেই মোটা মাইনের কনসালট্যান্ট। প্রকল্প মানেই ভাগ-বাটোয়ারা। কিন্তু টাকাটা তো জনগণের।

সরকারি প্রকল্পগুলোর অবস্থা হলো, কোনো একটি প্রকল্পে সাফল্য খতিয়ে দেখতেও আরেকটি প্রকল্প নেয়া হয়। সুতরাং, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোয় কেন ওয়াটার বাস চালু করা গেল না বা এই প্রকল্পটি কেন ব্যর্থ হলো, সেটি খতিয়ে দেখতেও আরেকটি প্রকল্প নেয়া হবে কি না— সেটিই প্রশ্ন।

এই যে জনগণের পয়সায় একেকটি প্রকল্প নেয়া হয় এবং বার বার যদি সেই প্রকল্প ব্যর্থ হয় বা জনগণ এর সুফল পেতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কি কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে? সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কি ওই টাকা ফেরত নেয়া বা জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা আছে? নেই।

বরং ‘সরকারি মাল দরিয়ামে ঢালা’র যে প্রবাদ, বুড়িগঙ্গার ওয়াটার বাস এর উজ্জ্বল উদাহরণ। শুধু এই ওয়াটার বাসই নয়, বরং ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দখলদালদের হাত থেকে রক্ষা করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নদী রক্ষা করা যাচ্ছে না। নদীর দূষণও বন্ধ করা যাচ্ছে না।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পরের বছর বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুদ্ধারে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু ভুল পরিকল্পনার কারণে দশ বছর পেরিয়ে গেলেও প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়নি। যেসব কাজ করা হয়, সেগুলোও দৃশ্যমান নয়।

বুড়িগঙ্গা নদীর পানির প্রবাহ দৃশ্যমান করার জন্য যেভাবে নদী খননের কথা ছিল, সেই নকশায় ছিল গলদ। জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে, সে বিষয়ে কোনো সমীক্ষা করা হয়নি। বুড়িগঙ্গা নদী উদ্ধার করতে গিয়ে ২২টি সেতু ক্ষতির মুখে পড়তে পারে— সে বিষয়েও কোনো ধারণা ছিল না কর্মকর্তাদের। ফলে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় প্রায় এক হাজার ২০০ কোটিতে গিয়ে ঠেকে।

বুড়িগঙ্গা নদীর কাজ চলমান অবস্থার মধ্যেই ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর অবৈধ দখল বন্ধ করতে আরেকটি প্রকল্পে ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের তীরভূমি অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এই প্রকল্পেও ভুল পরিকল্পনার কারণে পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে। দুই বছর পর এসে ভুল পরিকল্পনা সংশোধন করে এখন নতুন করে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানো হয়।

তার মানে একদিকে ভুল নকশা, অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা, মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পেরে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো এবং সর্বোপরি সরকারি অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেও কোনো ধরনের জবাবদিহির মধ্যে না আসার যে সংস্কৃতি চলে আসছে, তার মাশুল দিচ্ছে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো।

অথচ ২০১৯ সালে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ (লিভিং এনটিটি) হিসেবে ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তার মানে দেশের নদীগুলো এখন থেকে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর মতোই আইনি অধিকার পাবে। আদালতের রায় অনুযায়ী নদীগুলো এখন ‘জুরিসটিক পারসন’ বা ‘লিগ্যাল পারসন’।

এর মধ্য দিয়ে মানুষের মতো নদীরও মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হলো। কিন্তু ঢাকার চারপাশের নদীগুলো দেখলে এই সত্য অনুধাবনের সুযোগ নেই। মুশকিল হলো নদীরা মানুষের মতো কথা বলতে পারে না। পারলে তারা হয়তো বলতো, ‘‘হে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকগণ, দয়া করে আমাদের ‘উন্নয়নে’ কোনো প্রকল্প গ্রহণ না করে আমাদের আমাদের মতো থাকতে দিন।’’

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

এ বিভাগের আরো খবর