বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নির্বাচন কমিশন গঠনে সংলাপেই হোক সমাধান

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স   
  • ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৩:২৫

কমিশন চাইলে ভালো নির্বাচন করতে পারে আবার ‘মাগুরা মার্কা’ নির্বাচনও করতে পারে। আমাদের নির্বাচনের মডেল কী আর কমিশনেরইবা মডেল কী সেটা আমরা আজও ঠিক করতে পারিনি। এম এ আজিজ কমিশন এক কোটি ভুয়া ভোটারের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। এটা যেমন আমানতের খেয়ানত, আবার আসল ভোটারদের ভোট বঞ্চনাও আমানতের খেয়ানত।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু হয়েছে। রাষ্ট্রপতি এই সংলাপ শুরু করেছেন। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা হয়েছে। তারা সার্চ কমিটির জন্য তিনজন ও নির্বাচন কমিশনের জন্য একজনের নামও প্রস্তাব করেছেন। অবশ্য এর পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একটি অংশও রাষ্ট্রপতির আহ্বানে আলোচনায় অংশ নিয়েছে।

এর আগেও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনও গঠন করা হয়েছে। সার্চ কমিটির সদস্যও মনোনীত হয়েছে দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে। সেই সার্চ কমিটির প্রস্তাবনার ভিত্তিতেই পরপর দুটি কমিশন গঠন করা হয়েছে।

কাজেই তৃতীয় দফা সার্চ কমিটির প্রস্তাবনার মাধ্যমে আগামী কমিশন কেমন হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ এখনও চলমান। আমরা ভালো কিছু আশা করি। কারণ, এর সঙ্গে আগামী জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সম্পর্ক রয়েছে।

নির্বাচনের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের ভিত রচিত হয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে আসে। সব গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়। অন্যান্য দেশে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে। কোনো রাজনৈতিক দলই কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। কমিশন বিদ্যমান আইনানুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন করে যায়।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের কোনো কোনো পদক্ষেপ কোনো কোনো দলের বিপক্ষে যেতে পারে। কিন্তু তারপরও কোনো দলই দিনশেষে কমিশনের এখতিয়ারকে অস্বীকার করে না, তাদের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে না। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন আজ পর্যন্ত নিজের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি।

সাংবিধানিকভাবে আমাদের কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী এতে সন্দেহ নেই। এছাড়া নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট আইনেও কমিশনের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। অতীতে আমরা দু’একটি কমিশনকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে দেখেছি।

সংবিধান ও আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলেই তারা তাদের ভূমিকা পালন করেছে। তাতে তাদের চাকরি হারাতে হয়নি। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল এটা সত্যি, কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা সেসব কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছিল।

নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করতে গেলে সব সিদ্ধান্তে সবাই খুশি হবে না। কমিশনের কাজ রাজনৈতিকদলগুলোকে তুষ্ট করা নয়। তার কাজ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা। এটা কমিশনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট। নির্বাচন কমিশনের জবাবদিহি শুধু সংবিধান, আইন ও বিবেকের কাছে। কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে নয়।

সংবিধানের তৃতীয় তফশিল অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্যান্য কমিশনাররা ‘আইনানুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত (I will faithfully discharge the duties of my office according to law)’ দায়িত্ব পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কমিশনের কাজ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট আইনগুলো প্রয়োগ করা, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আইন কমিশনের হাতে যে ক্ষমতা দিয়েছে তার পুরোপুরি প্রয়োগ করা। কিন্তু শুধু এই বর্তমান কমিশনই নয়, ইতিপূর্বের প্রায় সব কমিশনকেই আইন প্রয়োগের বিষয়ে উদাসীন হতে দেখা গেছে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে নির্বাচন। কমিশন শুধু যদি তাদের এই শপথবাক্যটির ওপর গুরুত্ব দিত তবে অনেক প্রশ্নেরই সুরাহা হয়ে যেত।

‍জাতীয় নির্বাচনের কথা যদি বাদও দেই, সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও সব মিলিয়ে অর্ধ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনি অনিয়মতো রয়েছেই। এই নির্বাচনে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু তারপরও কমিশনকে অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। অন্য স্থানীয় নির্বাচনগুলোতেও কমিশনের ভূমিকাই ছিল একই রকম।

সংবিধানের তৃতীয় তফশিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্যান্য কমিশনাররা যে শপথবাক্য পাঠ করেন তা তারা মান্য করেন না। আইনানুযায়ী সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা করণীয় তা করতে তারা আইনত বাধ্য। কিন্তু বিভিন্ন অজুহাতে বিশেষ করে কমিশনের কাছে লিখিত কোনো অভিযোগ আসেনি এমন অজুহাতে আইন প্রয়োগে তারা এগিয়ে আসে না। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের তফশিলে যে ‘বিশ্বস্ততা’র কথা বলা হয়েছে তা মূলত জনগণের ওপর তাদের দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত। কিন্তু আজ অবধি কটি কমিশন সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পেরেছে?

এককভাবে শুধু নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করলেই চলবে না। বিশ্বস্ততার বিষয়টি সবক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়ে থাকে। পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে সবাই শুধু নিজের চাকরির কাছেই দায়বদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ বলছে-

“নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।”

কিন্তু পদে আসীন হওয়ার পর আইন ও সংবিধানের কথা ভুলে গিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে দায়বদ্ধতা প্রকাশ সংবিধানের লঙ্ঘন। অতীতে এম এ সাদেক কমিশন বা এম এ আজিজ কমিশনের দৃষ্টান্ত আমাদের হাতে আছে। আছে শামসুল হুদা কমিশনের নজিরও। কাজেই কমিশন চাইলে ভালো নির্বাচন করতে পারে আবার ‘মাগুরা মার্কা’ নির্বাচনও করতে পারে।

আমাদের নির্বাচনের মডেল কী আর কমিশনেরইবা মডেল কী সেটা আমরা আজও ঠিক করতে পারিনি। এম এ আজিজ কমিশন এক কোটি ভুয়া ভোটারের একটি তালিকা তৈরি করেছিল। এটা যেমন আমানতের খেয়ানত, আবার আসল ভোটারদের ভোট বঞ্চনাও আমানতের খেয়ানত।

আসছে ফেব্রুয়ারিতে শেষ হচ্ছে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ। গঠিত হবে নতুন কমিশন। রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ ডেকেছেন। লক্ষ্য একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন। বর্তমান কমিশনও সংলাপের মাধ্যমেই গঠন হয়েছে।

কমিশন গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতি সংলাপ করতে বাধ্য নন। তিনি চাইলে তার পছন্দমতো (প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে, যা তিনি সাংবিধানিকভাবে মানতে বাধ্য) লোক নিয়ে কমিশন গঠন করতে পারেন। ‘সংলাপ’ তার ইতিবাচক মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। জনগণ এই ইতিবাচক মনোভাবের বাস্তবায়ন দেখতে চায়।

সংবিধানের ১১৮ (১) [১] অনুচ্ছেদ বলছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া এবং রাষ্ট্রপতি সময়ে সময়ে যেরূপ নির্দেশ করিবেন, সেই রূপ সংখ্যক অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।”

সংবিধান পেয়েছি ৫০ বছর, কিন্তু কমিশন গঠনের ওই আইনটি আজও হয়নি। অর্থাৎ সংবিধানের এই বিধানটি আজও কার্যকর হয়নি। এটা সংবিধানের ব্যত্যয়। যেহেতু এই বিধানটির দ্বিতীয় অংশটি বাস্তবায়িত হয়নি, তাই বিধানের প্রথম অংশ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিজেই কমশিন গঠন করে থাকেন। কাজেই, কমিশনের ভালো-মন্দ পুরো ক্রেডিট রাষ্ট্রপতির ‍ওপরই বর্তায়। যেহেতু আইন নেই, তাই রাষ্ট্রপতি কেমন কমিশন চান সেটাই বড় কথা। সেটা তিনি দশজনের সঙ্গে আলোচনা করেও করতে পারেন, না করেও করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি দেশের অভিভাবক।

তিনি ভয়-ভীতি, অনুগ্রহ-অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে (without fear or favour, affection or ill-will) নিজের দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়েছেন। কাজেই এ সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তাদের ইতিবাচক মনোভাব রাষ্ট্রপতিকে একটি মডেল কমিশন গঠনে সহায়তা করবে। বিএনপি এখনও এ সংলাপে সাড়া দেয়নি। এটি তাদের অতীত ভুলেরই ধারাবাহিকতা। সংলাপে সব দলেরই ইতিবাচক ও কার্যকর অংশগ্রহণ কাম্য।

লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক

এ বিভাগের আরো খবর