বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সুগন্ধা নদীতে পোড়া লাশের গন্ধ

  • চিররঞ্জন সরকার   
  • ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ১৫:৫৭

দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না। তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়। ফলে দায়ী কেউ-ই শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো শাস্তি পায় না। বিদ্যমান আইনে লঞ্চমালিক ও চালকদের শাস্তির যে বিধান আছে, তা কার্যকর করা খুবই কঠিন। তাছাড়া এই আইনের ফাঁকফোকরও অনেক বেশি। ফলে আইনটির সংশোধন হওয়াটা জরুরি।

আগুন নেভাতে দরকার হয় পানি। যে লঞ্চ পানির ওপর দিয়ে চলছিল, সেই লঞ্চেই আগুনে পুড়ে মারা গেল প্রায় অর্ধশত মানুষ। আরও মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগুন নেভানোর কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা যায়নি। না ছিল পানি তোলার ব্যবস্থা, না ছিল অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থাই লঞ্চটিতে ছিল না। কতটা অবহেলা থাকলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে! সত্যি এদেশের মানুষগুলো বড়ই হতভাগা!

আমাদের দেশে লঞ্চডুবির ঘটনা নিয়মিত ঘটলেও লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে এত মানুষের পুড়ে মরার ঘটনা এর আগে দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান–১০ নামে যে লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছে। সুগন্ধা নদীতে এখন কেবল লাশের গন্ধ! হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন শতাধিক দগ্ধ মানুষ। ঢাকা থেকে বরগুনাগামী ওই লঞ্চটিতে প্রায় ৭শ যাত্রী ছিল।

গভীর রাতে ইঞ্জিন থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপ দিয়েছেন নদীতে। তাদের অনেকে আবার সাঁতার জানতেন না। এতেও অনেকের মৃত্যু হয়। এখনও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন বলে গণমাধ্যম জানাচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় এমভি অভিযান-১০ নামে লঞ্চটি যখন বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করে, তখন থেকেই এর গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান ত্রুটি মেরামতে কাজ করছিলেন। এ জন্য পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিক লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।

শুক্র ও শনিবার দুদিন বন্ধ থাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী ছিল লঞ্চে। সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার পক্ষে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে লঞ্চের চালক-কর্মচারীসহ লঞ্চ কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু এমন একটি লঞ্চ কীভাবে চলাচলের অনুমোদন পেল, সে প্রশ্নটি সবার আগে আসে। যদিও এসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তাই বলে।

সরকারি হিসেবেই বাংলাদেশের মানুষের ৩৫ ভাগ যাতায়াতই সম্পন্ন হয় নৌপথে। আর এই নৌপথেই লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মারা যায় শত শত মানুষ। এধরনের দুর্ঘটনা অনেকেটা নিয়মিত হলেও, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে খুব সামান্যই। এখনও অনেক লঞ্চ রয়েছে ফিটনেসবিহীন, জীবন রক্ষাকারী যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই অধিকাংশ লঞ্চে। অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েও এসব লঞ্চে যাত্রী পরিবহন করা হয়।

লঞ্চ দুর্ঘটনা বা লঞ্চডুবির ঘটনা এদেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। প্রায় প্রতিবছরই লঞ্চডুবিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ আহত, নিহত ও নিখোঁজ হন। তখন চোখে পড়ে স্বজনহারানো ব্যক্তিদের আহাজারির দৃশ্য। এ নিয়ে কিছুদিন হৈ চৈ হয়। গণমাধ্যমে ফলাও করে এ-সংক্রান্ত খবরাখবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। আর যথারীতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তখন চিরায়ত প্রথা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টরা বলে থাকেন, ঘটনার সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর কিছুদিন পরেই দেশে অন্য কোনো চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে।

তখন লঞ্চ দুর্ঘটনার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। কেউ জানতে পারে না ওই লঞ্চডুবির পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা আদৌ নেয়া হয়েছে কি না। কিংবা লঞ্চডুবির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আদৌ আলোর মুখ দেখেছে কি না। এভাবেই চাপা পড়ে যায় লঞ্চ দুর্ঘটনার মতো মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক ঘটনাগুলো।

আমাদের দেশে লঞ্চ দুর্ঘটনা যেমন যুগ যুগ ধরে চলছে, লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণগুলোও যুগ যুগ ধরেই অপরিবর্তিত রয়েছে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রীবহন, চালকদের অদক্ষতা-অনভিজ্ঞতা, লঞ্চের নকশায় সমস্যা, লঞ্চের ফিটনেস তদারকির অভাব ইত্যাদি যেসব কারণে লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তা নিয়ে কথা ওঠে কেবল তখনই, যখন কোনো লঞ্চডুবিতে শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে৷ অন্য সময় এ বিষয়গুলো দেখভাল করার কেউ থাকে না৷

লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রতিবছর শত শত মানুষের মৃত্যু বন্ধ করতে হলে প্রথমেই কঠোর শাস্তির বিধান করা উচিত৷ লঞ্চ দুর্ঘটনা প্রতিরোধের লক্ষ্যে এ দেশে পর্যাপ্ত আইন-কানুন নেই৷ অনেক সময় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা আটক হলেও শেষ পর্যন্ত আইনের ফাঁকফোকরে বা রাজনৈতিক প্রভাবে কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে ছাড় পেয়ে যায়। লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী লঞ্চ মালিক কিংবা মাস্টারদের বিরুদ্ধে মামলা হয় নৌ-আদালতে। বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল অধ্যাদেশ, ১৯৭৬ (আইএসও-১৯৭৬) অনুযায়ী, রাষ্ট্রপক্ষ দোষী ব্যক্তিদের পক্ষে শক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে না।

মামলাগুলো দীর্ঘদিন চলার পর নিষ্পত্তি হলেও দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে এমন নজির খুবই কম। তাছাড়া দুর্ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি সরাসরি নৌ-আদালতে মামলা করতে পারেন না। তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিংবা সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে মামলা করতে হয়। ফলে দায়ী কেউ-ই শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো শাস্তি পায় না। বিদ্যমান আইনে লঞ্চমালিক ও চালকদের শাস্তির যে বিধান আছে, তা কার্যকর করা খুবই কঠিন। তাছাড়া এই আইনের ফাঁকফোকরও অনেক বেশি। ফলে আইনটির সংশোধন হওয়াটা জরুরি।

অতিরিক্ত যাত্রীবহন রোধ করা, সঠিক নকশা অনুযায়ী লঞ্চ নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখা, লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামাদিসহ সার্ভে সনদ অনুযায়ী মাস্টার ও ড্রাইভার যথাযথভাবে আছে কি না তাও নিশ্চিত করা দরকার। কোনো লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করলে এবং ওই লঞ্চে জীবন রক্ষাকারী পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জামাদি না থাকলে ওই লঞ্চের যাত্রা স্থগিত করাসহ সংশ্লিষ্ট নৌ-আদালতে মামলা দায়েরের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন নৌপথে নিরাপদে চলাচলের স্বার্থে পর্যাপ্ত পরিমাণে আধুনিক নৌসহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা দরকার। কোথাও লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটলে দ্রুত উদ্ধারাভিযানের লক্ষ্যে প্রয়োজন আধুনিক জাহাজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার ও সিপ্লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। সঠিক নকশা অনুযায়ী লঞ্চ নির্মাণ, লঞ্চের ফিটনেস নিয়মিত তদারকি ও চালক-সহযোগীদের দক্ষতা-অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে এই পুরো খাতটির ওপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে৷

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, রাষ্ট্র সবসময় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সামাজিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পক্ষে ভূমিকা পালন করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার জন্যই আইন তৈরি করা থাকে। তাইতো ফি বছর দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিদের স্বজনের আহাজারি, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, সমালোচনার পরও কেন শক্ত আইন প্রণয়ন করা হয় না।

দুর্ঘটনা সারা পৃথিবীতেই রয়েছে। কিন্তু সেসব দুর্ঘটনা কোনো পক্ষের অসতর্কতার জন্য ঘটলে কঠিন আইনের আওতায় দায়ীদের শাস্তি পেতে হয়। সঠিক বিচার হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। দুর্বল আইনি কাঠামো, আর দীর্ঘসূত্রতায় হারিয়ে যায় ন্যায়বিচারের দাবি।

লঞ্চ দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই গভীরভাবে ভাবতে হবে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। শত শত মানুষকে বহনকারী একটি যান সারারাত চলার পর সকালে গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়, সেই যানের কী ধরনের ফিটনেস দরকার, কী ধরনের নিরাপত্তাসরঞ্জাম ও সক্ষমতা দরকার। প্রশ্ন হলো- সেটা কে নিশ্চিত করবে? এটা কি নৌ মন্ত্রণালয় করবে, মালিকপক্ষ করবে?

চালক-সহকারীরা করবে? নাকি এভাবেই চলবে যুগের পর যুগ? যেকোনো উপায়ে টাকা বানানোর লোভের কাছে, দায়িত্বহীনতার কাছে মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাতেই থাকবে?

রাষ্ট্র যদি প্রতিটি নাগরিককে মানুষ হিসেবে গণ্য করে, তাহলে অবশ্যই এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। আর রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের কীট-পতঙ্গ বা ইতরপ্রাণী মনে করে তাহলে অবশ্য বলার কিছু নেই!

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, প্রবন্ধকার।

এ বিভাগের আরো খবর